যুক্তরাষ্ট্রের ক্ল্যামেথ নদীতে বাঁধ ভাঙতে না ভাঙতেই ১০০ বছর পর দেখা গেল স্যামন মাছ

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৪১

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় হোপা উপত্যকার কাছে ট্রিনিটি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে ক্ল্যামেথ নদী। এ নদী থেকে অপসারণ করা হয়েছে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নির্মিত বড় আকারের চারটি বাঁধ
যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন অঙ্গরাজ্যে ক্ল্যামেথ নদীর অববাহিকায় ১০০ বছরের বেশি সময় পর দেখা গেছে স্যামন মাছ। ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের একটি বৃহৎ বাঁধ অপসারণের প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ওই নদীতে মাছটি ফিরে এসেছে।
ক্ল্যামেথ নদীর একটি উপনদীতে গত অক্টোবরে অরিগন মৎস্য ও বন্য প্রাণী বিভাগের মৎস্যবিজ্ঞানীরা একটি শরৎকালীন চিনুক প্রজাতির স্যামন মাছ শনাক্ত করেছিলেন। একসময় ওই নদীর উজানে জে সি বয়েল বাঁধ ছিল। এর আগে শেষ ১৯১২ সালে ক্ল্যামেথ অববাহিকায় এই প্রজাতির মাছের দেখা মিলেছিল। ওই বছরই সেখানে চারটি জলবিদ্যুৎ বাঁধের প্রথমটি নির্মিত হয়েছিল।
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোর দাবির মুখে আগস্টে চারটি বাঁধের শেষটি ভেঙে ফেলা হয়। এসব জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যাশা ছিল, বাঁধ অপসারণ করলে স্যামন মাছ ফিরে আসবে। এই মাছ ক্ল্যামেথ নদীর তীরবর্তী জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য খাবারের গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস।
অরিগনস ক্ল্যামেথ ফিশারিজ রেইনট্রোডাকশন প্রোগ্রাম প্রকল্পের প্রধান মার্ক হেয়ারফোর্ড বলেন, ‘ওই নদীতে স্যামন মাছ শনাক্ত হওয়ার এক দিন আগে ভোরবেলায় আমরা নদীতে বড়সড় একটি মাছকে ভাসমান অবস্থায় দেখতে পাই। তবে আমরা শুধু এটির পিঠের পাখনা দেখতে পেয়েছিলাম। আমি ভাবলাম, এটি কি স্যামন নাকি বড়সড় কোনো রেইনবো ট্রাউট মাছ ছিল?’ এরপর টানা দুই দিন দলটি সেখানে যায় এবং উচ্ছ্বসিতভাবে নিশ্চিত করে, এটি ছিল স্যামন মাছ।
ক্ল্যামেথ নদীর আরও উজানের দিকে আদিবাসীদের এলাকায়ও স্যামন মাছ ফিরে এসেছে এবং প্রত্যাশার চেয়ে কিছুটা আগেই ফিরে এসেছে।
ইউরোক আদিবাসীর জ্যেষ্ঠ মৎস্যবিজ্ঞানী ব্যারি ম্যাককোভি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, এ বছর বাঁধের ওপর কিছু মাছ ফিরে আসবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিপুল পরিমাণ মাছ ফিরে এসেছে। মাছের বসবাসের ভৌগোলিক পরিসরও বেড়েছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, অরিগনে এসব মাছ দেখা গেছে। এটা অবিশ্বাস্য খবর ছিল।’
ক্ল্যামেথ নদীর উপনদী ও শাখানদীগুলোর উৎপত্তি অরিগন অঙ্গরাজ্যে। নদীটি ক্যাসকেড পর্বতমালার মধ্য দিয়ে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় ঢুকে প্রশান্ত মহাসাগরে গিয়ে মিশেছে। এটির দৈর্ঘ্য ২৬৩ মাইল (৪২৩ কিলোমিটার)। একসময় যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে তৃতীয় বৃহত্তম স্যামন মাছ উৎপাদনকারী নদী ছিল ক্ল্যামেথ। নদীটি ছিল উরোকসহ আমেরিকার অসংখ্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর প্রাণশক্তি। স্যামন মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করার কারণে এসব আদিবাসী ‘স্যামন মানুষ’ নামেও পরিচিত।
কিন্তু জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নির্মিত বাঁধগুলো মাছের চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে তুলেছিল। এর ফলে একের পর এক মাছ মরে সাফ হয়ে যায়। কমে যায় পানির গুণমানও। নদীতে চিনুক স্যামনের সংখ্যা বাঁধ নির্মাণের আগের তুলনায় ৯০ শতাংশের বেশি কমে যায়। আর বসন্তকালীন চিনুক কমে যায় ৯৮ শতাংশ। স্টিলহেড ট্রাউট, কোহো স্যামন ও প্যাসিফিক ল্যাম্প্রের সংখ্যাও মারাত্মক হ্রাস পেয়েছে।
১৯২২ সালে কপকো ১ বাঁধের নির্মাণ শেষ হওয়ার পর থেকে ক্ল্যামেথ নদী অববাহিকার আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলো এক শতাব্দী ধরে স্যামন মাছ চাষ করতে পারেনি। ইউরোকস, কারুকসহ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলো কয়েক দশক ধরে এসব বাঁধের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে আসছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাঁধগুলো ভেঙে ফেলা হয়। শেষ বাঁধটি অপসারণ করা হয়েছে আগস্টের শেষের দিকে।
বাঁধ অপসারণের পর ক্ল্যামেথ নদীতে চিনুক ও কোহো স্যামন, স্টিলহেড ট্রাউট ও প্যাসিফিক ল্যাম্প্রের মতো অ্যানাড্রোমাস মাছ ফিরিয়ে আনতে আদিবাসীরা অরিগন ও ক্যালিফোর্নিয়ার বন্য প্রাণী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ করছে। অনেকে বছরের পর বছর ধরে এসব মাছ ফিরে আসার প্রত্যাশাও করেননি। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার জীববিজ্ঞানীরাও এখন দুর্গম খাঁড়িতে স্যামন মাছ দেখতে পাচ্ছেন।

মৎস্যবিজ্ঞানী ব্যারি ম্যাককোভি বলেন, ‘উপনদীগুলোয় স্যামন মাছ ডিম ছেড়েছে। ৯ মাস আগে নদীর ৩০ ফুট পানির নিচে ছিল এরা। স্যামন ফিরে আসার বিষয়টি ভবিষ্যতের জন্য অনেক আশা জাগাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে, আমরা ঠিক কাজটিই করেছি, ঠিক পথেই আছি। নদী নিজেই নিজের নিরাময় করছে।’


ক্ল্যামেথ নদীতে থাকা বাঁধগুলো ভাঙার মধ্য দিয়ে মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাঁধ অপসারণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়েছে। বাঁধগুলো স্থানীয় আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর কাছে অত্যন্ত অজনপ্রিয় ছিল। তারা ১৯৯০–এর দশক থেকে এগুলো অপসারণের জন্য প্রচার চালিয়ে আসছিল। ইউরোক জাতিগোষ্ঠীর সদস্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ব্রুক টম্পসন ক্ল্যামেথ অববাহিকা পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছিল, এটি কখনোই সম্ভব হবে না। একটি বাঁধের অপসারণ চাওয়াই বোকামি, যেখানে আমরা চেয়েছিলাম চারটির অপসারণ।’
বেশ কয়েক বছরের আলাপ-আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর অবশেষে ২০২৩ সালে বাঁধ চারটি অপসারণের কাজ শুরু হয়। এ বছরের আগস্টে শেষ বাঁধটি ভেঙে পড়ার পর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে সেখানকার জাতিগোষ্ঠীগুলো। এর ফলে ৪০০ মাইলের (৬৪৪ কিলোমিটার) বেশি নদী আবার উন্মুক্ত হয়েছে।