আটলান্টিকে হারিকেন মওসুম শুরু হয়েছে। এনওএএ জানাচ্ছে এবছর আমেরিকানদের ঝড়-ঝঞ্ঝা বেশিই ভোগাবে। এরই মধ্যে সমুদ্রে সৃষ্টি হয়েছে ২১টি ঘুর্ণিঝড়। যার মধ্যে ১৪টির নামকরণ করা হয়েছে। যার মধ্যে ৬ থেকে ১টি হারিকেনে পরিণত হতে পারে। আর ২ থেকে ৫টি মারাত্মক রূপ নেবে। ক্যাটেগরি-৩ কিংবা তার চেয়েও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে সে ঝড়। প্রথম মৌসুমি ঝড়টির নামকরণ করা হয় ২ জুন।
আরলিন নামের এই ঝড়টির সূত্রপাত ঘটে মেক্সিকো উপসাগরে। প্রথমে গ্রীস্মমণ্ডলীয় নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে তা বৃষ্টি বয়ে আনে আর বিক্ষিপ্তভাবে বজ্রপাত তার সঙ্গী হয়। যার ছোঁয়া পড়ে ফ্লোরিডার কোনো কোন অংশ। আর সবশেষে স্বল্পস্থায়ী আরলিন কিউবার দিকে ধাবিত হয়।
পরের ঝড়টির নাম ব্রেট। যা সৃষ্টি হয় হত ১৯ জুন আটলান্টিক ওশেনে। ২০২৩ সালের এটি দ্বিতীয় ঝড় হিসেবে নাম পেলো। কিউবা সাগরে ব্রেট ঘুরপাক খেতে থাকে। পরে এটি ভারী বৃষ্টি বয়ে আনে। আরও পরে ক্যারিবীয় আয়ল্যান্ডসের কিয়দশং পারি দিয়ে বারবাডোস থেকে সেন্ট লুসিয়া পর্যন্ত বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাস বইয়ে শেষ হয়।
সিন্ডিনামের ঝড়টি সৃষ্টি হয় মধ্য আটলান্টিকে ২২ জুন। তিন দিন ধরে গ্রীস্মমণ্ডলীয় ঝড়ের তকমা নিয়ে ঘূর্ণি খাওয়ার পর ধীরে ধীরে তা শক্তি হারাতে থাকে। বেশিরভাগ সময় সমুদ্রে কাটিয়ে ঝড়টি লেসার অ্যান্টিলেসর কাছে আঘাত হাবে। তখন বাতাসে গতিবেগ ছিলো ঘণ্টায় ৬০ মাইল। ২৫ জুন নাগাদ ঝড়টি শান্ত হয়।
ডন নামের ঝড়টি কিছুটা অদ্ভুত ধরনের ছিলো। আটলান্টিকে সৃষ্ট ঝড়টি দানা বাঁধে ১৪ জুলাই। ২০২৩ আটলান্টিক হারিকেন মৌসুমে নাম পাওয়া চতূর্থ ঝড় এই ডন। প্রথম কিছুদিন সাবট্রপিক্যাল স্টর্ম হিসেবে পার করার পর ১৭ জুলাই এটি গ্রীস্মমণ্ডলীয় ঝড়ের তকমা পায়। পরে সকলকে বিস্মিত করে ডন ক্যাটেগরি ১ হারিকেনে রূপ নেয় ২২ জুলাই। এবং আটলান্টিক বেসিনে সেটাই ছিলো এই মৌসুমের প্রথম ক্যাটেগরি-১ হারিকেন। ১২ ঘণ্টা পর সেটি আবার গ্রীস্মমণ্ডলীয় ঝড়ের চেহারা ফিরে পায়। ২৪ জুলাই তা শান্ত হয়ে আসে।
এমিলি নামের ঝড়টি গ্রীস্মমণ্ডলীয় ঝড় হিসেবে দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে ২০ আগস্ট। আর এক দিনের মধ্যেই তা পোস্ট ট্রপিক্যাল স্টর্মের স্ট্যাটাসে চলে যায়। উন্মুক্ত সমুদ্রেই সে ঝড় ঘুরপাক খেয়ে নিজে নিজেই শান্ত হয়ে আসে।
হারিকেন ফ্র্যাঙ্কলিনের কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। ক্যারিবীয় সাগরে এই ঝড় দানা বাঁধে ২০ আগস্ট। এরপর কিছুদিন সমুদ্রে ঘুরপাক খেয়ে ২৩ আগস্ট ডমিনিকান প্রজাতন্ত্রের স্থলভাগে আঘাত হনে। ঝড় আর প্রবল বৃষ্টিপাতে বন্যার সৃষ্টি হয়। তাতে ২ জনের প্রাণহানিও ঘটে। পরে ঝড়টি আবার পশ্চিম আটলান্টিকে ঘণীভূত হয়ে মারাত্মক হারিকেনে রূপ নেয়। ২৮ আগস্ট মৌসুমের প্রথম বড় হারিকেন হয়ে উঠে ফ্র্যাঙ্কলিন। ঝড়টি যুক্তরাষ্ট্রের উপর সরাসরি আঘাত না হানলেও এর প্রভাবে পূর্বাঞ্চলীয় সমুদ্র উপকূল প্লাবিত হয়ে থাকে কয়েকদিন।
গ্রেট নামের ঝড়টিকে আবহাওয়াবিদরা জম্বি ঝড় নাম দিয়েছেন। প্রথমেও এটি অনেকটা মরে গিয়েও ফের প্রাণ ফিরে পায়। আর কেন্দ্রীয় আটলান্টিকে সেটি ঘোঁট পাকিয়ে ওঠে ২২ আগস্ট। পরে সেটি লিওয়ার্ড আয়ল্যান্ডসের দিকে ধাবিত হতে শুরু করে। তবে শুষ্ক আবহাওয়া ও বায়ুর চাপে তা আয়ল্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই শক্তি হারায়।
মেক্সিকো উপসাগরে ২২ আগস্ট সৃষ্টি হয় হ্যারল্ড নামের হারিকেনটি। যা দ্রুতই পশ্চিমের দিকে অগ্রসর হতে থাকে আর প্যাড্র আয়ল্যান্ড, টেক্সাসের ওপর আঘাত হানে। ফলে দক্ষিণ টেক্সাস ও উত্তর মেক্সিকো প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। এরপর ১ সেপ্টেম্বর মধ্য আটলান্টিকে আবারও ঘনীভূত হয় এই ঝড়। তবে প্রথম বারের মতো এবারও ঝড়টি বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। ইডালিয়ার ট্রপিকাল হাওয়া এই ঝড়কে কাবু করে দেয়।
হ্যারল্ড সৃষ্টি হয় মেক্সিকো উপসাগরে আগস্টের ২২ তারিখ। পশ্চিম মুখে অগ্রসর হয়ে টেক্সাসের প্যারেড আয়ল্যান্ডে আছড়ে পড়ে ওই সকালের পরের দিকেই। স্থলভাগে এসে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে দক্ষিণ টেক্সাস ও উত্তর মেক্সিকোকে ভারী বৃষ্টিপাতে ভিজিয়ে দিয়ে যায়।
ইডালিয়া সৃষ্টি হয় ২৭ আগস্ট উত্তর-পশ্চিম ক্যারিবীয় সাগরে। মেক্সিকো উপসাগরে ঢুকের পড়ার আগে সেখানেই কিছু সময় ঘুর্ণি খেতে থাকে।তবে উপসাগরে পড়ে খুব দ্রুত ঘণীভূত হয়ে ক্যাটেগরি ৪ হারিকেনে রূপ নেয়। ৩০ আগস্ট ফ্লোরিডার কিটন বিচে আছড়ে পড়ার আগেই কিছুটা দুর্বল হয়ে আসে সে ঝড়। তারপরেও ঘণ্টায় ১২৫ মাইল বেগে হাওয়া দিয়ে তছনছ করে যায় কিটন। ১৮৫১ সালের পর এই প্রথম সে এলাকাবাসী ক্যাটেগরি ৩ বা তার চেয়ে শক্তিশালি ঘুর্ণিঝড় দেখলো। ইডালিয়ার আঘাত ও তার প্রভাবে সৃষ্ট বন্যায় বিপর্যস্ত হয় ফ্লোরিডা, জর্জিয়া ও ক্যারোলিনা। ৩১ অক্টোবর ঝড়টি পোস্ট ট্রপিকালে রূপ নেয়। তবে এরপরও দাপট দেখাতে থাকে আর ঝড়ো হাওয়া ও ভারী বৃষ্টিপাতে বারমুডাকে বিপর্যস্ত করে ২ সেপ্টেম্বর থেমে যায়।
জোস নামের ঝড়টি অন্য অনেকগুলোর মতো খুব বেশি স্থায়ী হয় নি। মধ্য আটলান্টিকে ৩১ আগস্ট সৃষ্টি হয়ে ১ সেপ্টেম্বর ফ্র্যাঙ্কলিনের মাঝে বিলিন হয়। কাতিয়া নামে অপর ঝড়টি সৃষ্টি হয় পূর্ব আটলান্টিকে ২ সেপ্টেম্বর সেটি গ্রীস্মমণ্ডলীয় ঝড়ে রূপ নেয়। তবে ৩ সেপ্টেম্বর নিম্বচাপে সেটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ৪ সেপ্টেম্বর থেমে যায়।
ঘূর্ণিঝড় লি সৃষ্টি হয় ৫ সেপ্টেম্বর। আর তা হারিকেনে রূপ নেয় একদিন পরেই। দ্রুতই তা ঘণীভূত হতে থাকে আর পশ্চিম মুখে ধাবিত হয়। ৭ সেম্পেম্বর সেটি বড় হারিকেনে রূপ নেয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা ক্যাটেগরি ৫ এ পরিণত হয়। বাতাসের গতিবেগ হয়ে দাঁড়ায় ঘণ্টায় ১৫০ মাইল। প্রথম দিকে ক্যারিবীয় সাগরের যথেষ্ট উত্তরে অবস্থান করছিলো আর সেখান থেকেই ক্যারিবীয়, বারমুডা ও যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর উপকূলে ঝাপটা ফেল যাচ্ছিলো। তবে নিউ ইংল্যান্ড উপকুলের অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা পানিতে পড়ে লি পোস্ট ট্রপিকালে রূপ নেয় এবং লং অ্যায়ল্যান্ড ও কানাডার নোভা স্কটিয়ায় ৭০ মাইল বেগে আছড়ে পড়ে।
মাগোট নামের ঘুর্ণিঝড়টি মধ্য আটলান্টিকে সৃষ্টি হয় ৭ সেপ্টেম্বর। এরপর ১০ দিন ধরে সেখানেই ঘোট পাকাতে থাকে। আর ১১ সেপ্টেম্বর সেটি মওসুমের ৬ষ্ট হারিকেনে রূপ নেয়। জলভাগেই ঘুরপাক থেকে নিজে নিজে দুর্বল হয় আসতে থাকে। ১৫ সেপ্টেম্বর সেটি সাধারণ ঝরে রূপ নেয়। আর ক্রমেই আরও দুর্বল হয়ে সমুদ্রেই মিলিয়ে যায়। স্থলভাগে এসে পড়েনি মাগোটের কোনো প্রভাব।
এদিকে নিগেল সৃষ্টি হয় ১৬ সেপ্টম্বর দক্ষিণ-মধ্য আটলান্টিকে। প্রথমে উত্তরপশ্চিম মুখী হয়ে পরপরই সেটি দিক পরিবর্তন করে উত্তর-পূর্ব দিকে ধাবিত হতে থাকে। আর পরে ক্যাটেগরি ২ হারিকেনে রূপ নেয়। তবে পুরো সময়টি জলভাগেই গুমড়ে গুমড়ে ২২ সেপ্টেম্বর পোস্ট-ট্রপিকালে পরিণত হয়ে ধীরে ধীরে থেমে যায়।
ঝড় ওফেলিয়া সৃষ্টি হয় ২২ সেপ্টেম্বর। ২০২৩ এ এটি আটলান্টিকে ১৫তম ঝড় যার নামকরণ করা হয়েছে। ২৩ সেপ্টেম্বর ঘূর্ণিঝড়টি নর্থ ক্যারোলিনায় আছড়ে পড়ে। ঝড়ো বাতাস, ভারী বৃষ্টিপাত হয় উত্তর ক্যারোলিনা উপকূল থেকে মধ্য আটলান্টিক ও নিউ ইংল্যান্ড পর্যন্ত।
২৩ সেপ্টেম্বরেই মধ্য আটলান্টিকে সৃষ্টি হয় নতুন ঘূর্ণিঝড় ফিলিপ। সেটি ২ অক্টোবার বারবুডায় আঘাত হানে। ভারী বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায় উত্তর ক্যারিবিয়ার কয়েকটি দ্বীপে। পরে উত্তরমুখী হয়ে ফিলিপ এগুতে থাকে বারমুডার দিকে। তবে ততক্ষণে সেটি পোস্ট-ট্রপিক্যালে রূপ নেয় এবং ৬ অক্টোবর দ্বীপরাষ্ট্রটির দক্ষিণভাগে আছড়ে পড়ে। সেখানেও ঝড়ো হাওয়া ও ভারী বৃষ্টিপাত হয়। ফিলিপের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মেইনেতেও ১ থেকে ৪ ইঞ্চি পর্যন্ত বৃষ্টপাত হয়। ৬০ মাইল বেগে বাতায় বয়। আর উপকূলে আছড়ে পড়ে বড় বড় সামুদ্রিক ঢেউ।
ঘুর্ণিঝড় রিনা সৃষ্টি হয় ২৮ সেপ্টেম্বর। পরের দিন কিছুটা ঘণীভূত হয় তবে সক্ষমতায় সেটি ট্রপিকাল স্টম হিসেবেই থেকে যায়। মূলত ঘুর্ণিঝড় ফিলিপের কারণে রিনা তেমনটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে জলভাগে থেকেই ১ অক্টোবর থেমে যায় রিনা।
শন ছিলো এই মৌসুমের ১৮তম নামকরণকৃত ঘূর্ণিঝড়। যার সৃষ্টি হয় ১১ অক্টোবর মধ্য আটলান্টিকে। জলভাগে এতে থাকে উত্তরপশ্চিম মুখি হয়ে। পরে শুষ্ক বাতাসের মুখে পড়ে ১৬ অক্টোবার জলেই বিলিন হয়।
টামি সৃষ্টি হয় ১৮ অক্টোবর। লিওয়ার্ড আয়ল্যান্ডের দিকে প্রথম এগুতে থাকে আর শেষে ২১ অক্টোবর বারবুডার স্থলভাগে আঘাত হানে। ভারী বৃষ্টিপাত হয় এর প্রভাবে। পরে টামি উত্তরমুখে এগুতে থাকে। আর ২৫ অক্টোবর সেটি ক্যাটেগরি ২ হারিকেনে রূপ নেয়। ২৬ অক্টোবর পোস্ট ট্রপিকালে ফিরে আসে ঝড়টি। ২৭ অক্টোবর আবার সেটি ট্রপিকাল স্টর্ম বা গ্রীস্মমণ্ডলীয় ঝড়ে রূপ নেয়। পরের দিনেও একই চেহারায় থাকলেও শুষ্ক বাতাসে তা ধীরে ধীরে কাবু হতে থাকে এবং ২৯ অক্টোবর বারমুডার পূর্ব দিকে অগ্রসহ হয়ে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।