আনডকুমেন্টেড অভিবাসীদের গ্রেপ্তারে কৌশল বদলেছে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস)। প্রতিদিন গড়ে ৩০০ অভিবাসীকে গ্রেপ্তারের টার্গেট দেওয়ার পর আইস ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে। এ কারণে বিভিন্ন মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে আইসের জালে গ্রেপ্তার হচ্ছেন অনেকে। এমনকী বাদ যাচ্ছে না স্কুল শিক্ষার্থীও। অতিসম্প্রতি নিউইয়র্ক সিটির ব্রঙ্কসে আইসের অভিযানে পাবলিক স্কুলের একজন শিক্ষার্থী গ্রেপ্তারের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। ওই শিক্ষার্থী আদালতে একটি নিয়মিত অ্যাসাইলাম শুনানির সময় গ্রেপ্তার হয়। এ ঘটনায় আইসের বিরুদ্ধে মামলা করেছে নিউইয়র্ক সিটি।
একাধিক সূত্র জানায়, মামলাটি দায়ের করা হয়েছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সচিব ক্রিস্টি নোয়েম, ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস)-এর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক টড লায়ন্স এবং তাদের বিভাগগুলোর বিরুদ্ধে, যেখানে শিক্ষার্থীকে আইস হেফাজত থেকে মুক্তির আবেদন জানানো হয়েছে।
নিউইয়র্ক সিটি দাবি করছে, ‘ডিলান’ নামক ওই শিক্ষার্থীকে কোনো কারণ ছাড়াই আটক রাখা হয়েছে এবং এতে তার যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের অধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। ২০ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী এলিস প্রিপ হাইস্কুলের ছাত্র, যাকে দুই সপ্তাহ আগে লোয়ার ম্যানহাটনের ফেডারেল অভিবাসন আদালত থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই গ্রেপ্তার সারা শহরে বিশৃঙ্খল বিক্ষোভের জন্ম দেয়।
মেয়র এরিক অ্যাডামস, যিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং হোয়াইট হাউসের ‘বর্ডার সিজার’ টম হোমানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন, এই গ্রেপ্তারের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ওই শিক্ষার্থী তার কাজের অনুমতি পাওয়ার জন্য এবং পরিবারের জন্য উপার্জনের লক্ষ্যে ‘সঠিক আইনগত প্রক্রিয়া’ অনুসরণ করেছিল। কিন্তু আইন মেনে চলার জন্য তাকে পুরস্কৃত করার পরিবর্তে, তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।’
এক বিবৃতিতে মেয়র বলেন, ‘প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নিউইয়র্ক সিটি বৈচিত্রময় অভিবাসী সম্প্রদায় দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়েছে এবং আমরা সেই সম্প্রদায়গুলোর কাছে বার্তা পাঠাচ্ছি- আমরা আপনাদের পাশে আছি এবং আপনারা স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার রাখেন।’
এরিক অ্যাডামসের সমর্থিত এই মামলা এমন এক সময়ে দায়ের করা হয়েছে, যখন নিউইয়র্কের আদালতগুলোতে আইস-এর গ্রেপ্তার নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। মনে করা হচ্ছে- প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গ্রেপ্তার কোটা বাড়ানোর নির্দেশের প্রতিক্রিয়ায় এমনটা ঘটছে।
কংগ্রেসম্যান ড্যান গোল্ডম্যান সাংবাদিকদের জানান, তিনি গত সপ্তাহে আদালতের নিয়মিত শুনানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রেপ্তার করতে আসা আইস কর্মকর্তাদের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, ‘এরা সবাই আইনি পথে অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চাইছে। ১ জুন রোববার ‘দ্য পয়েন্ট উইথ মার্সিয়া ক্রেমার’ অনুষ্ঠানে গোল্ডম্যান বলেন, ‘এদের কেউ অপরাধী নয়, কেউ খুনি বা শিশু ধর্ষক নয়। এসব কিছুই নয়।’
তিনি আরও বলেন, এই গ্রেপ্তারগুলো অন্য অভিবাসীদের গোপনে থাকার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে ভয়ানক নেতিবাচক বার্তা যায়।’
গোল্ডম্যান আরো বলেন, ‘এটা দেখে অন্যরা ভাববে- আমি যদি আদালতে যাই, তাহলে হয়তো গ্রেপ্তার হবো ও ফেরত পাঠানো হবো। তাই আমি আর আদালতেই যাবো না। গা-ঢাকা দেবো, আর কাজের ভিসা নিয়ে কর দিতেও রাজি হবো না। ফলে আরও বেশি অসহায়ত্ব তৈরি হবে।’
নিউইয়র্ক সিটিতে ৩০ লাখেরও বেশি অভিবাসী বাস করেন, যা শহরের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ এবং যারা স্থানীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি। সিটি তার মামলায় বলছে, অভিবাসন আইন মেনে চলা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা অনৈতিক ও অন্যায়।
নিউইয়র্ক সিটির লোয়ার ম্যানহ্যাটানে অবস্থিত ইমিগ্রেশন কোর্ট প্রাঙ্গণে সম্প্রতি দেখা গেছে এক চরম উদ্বেগজনক দৃশ্য। নিয়ম মেনে আদালতে শুনানিতে অংশ নিতে আসা অভিবাসীরা আদালত থেকে বের হওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের আইস এজেন্টদের হাতে গ্রেপ্তার হচ্ছেন। গত ২৯ মে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ২৯০ ব্রডওয়ের ফেডারেল বিল্ডিং থেকে অন্তত সাতজন অভিবাসীকে আটক করে আইস। আগের দিন একই ধরনের ঘটনা ঘটে পাশের ২৬ ফেডারেল প্লাজা বিল্ডিংয়েও।
ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন ইমিগ্রেশন নীতির আলোকে এই অভিযান চালানো হচ্ছে। নতুন নিয়মে বলা হয়েছে, যারা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন দুই বছরের কম সময় আগে এবং এখনও কোনো বৈধ অভিবাসন অনুমোদন পাননি, তাদের পূর্ণাঙ্গ শুনানি ছাড়াই দ্রুত নির্বাসন আইনের আওতায় সরাসরি ফেরত পাঠানো যাবে।
বৃহস্পতিবার কোর্টরুমে একাধিক মামলায় দেখা গেছে, সরকারি আইনজীবীরা বিচারকের কাছে আবেদন করছেন কেস বাতিল করার, যাতে দ্রুত নির্বাসনের পথ খুলে যায়। আদালতের নিচতলায় তখনও মোতায়েন ছিল প্রায় দুই ডজন আইসিই এজেন্ট, যাঁদের অনেকেই মুখে মাস্ক পরে ছিলেন।
একজন ফরাসি ভাষাভাষী যুবক, যিনি শুনানির পর কোর্ট বিল্ডিং থেকে বের হচ্ছিলেন, ঠিক তখনই আইস এজেন্টরা তাঁকে ঘিরে ফেলেন। হতভম্ব হয়ে তিনি বলেন, এইটা ভিডিও করুন! আমার পরিবার ব্রঙ্কসে। এরপর তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়।
ট্রাম্পের এই নতুন প্রশাসনিক নীতি যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে অভিবাসীদের মধ্যে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি শুধু আইনের শাসন নয়, মানবিকতার জন্যও এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।