সিবিএসের প্রতিবেদন

ইরানে হামলার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন ট্রাম্প

ইরান বিষয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে তুলসী গ্যাবার্ডের বিরোধ
ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৯ জুন ২০২৫, ১৩:১২

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে হামলার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন। তবে দেশটিতে হামলার বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএসের প্রতিবেদনে এমনটাই জানানো হয়েছে।
গোপন এক গোয়েন্দা সূত্র সিবিএসকে জানিয়েছে, ট্রাম্প এখনই হামলা শুরু করতে চান না। তিনি চাইছেন, ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করে দিক। তিনি ইরানের গোপন পারমাণবিক স্থাপনা ফর্দো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে হামলার বিষয়টি বিবেচনা করছেন।
এরই মধ্যে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ট্রাম্পের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের’ দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ট্রাম্প বলেছেন, তাঁর ধৈর্যের সীমা ফুরিয়ে গেছে।
ইরানে হামলার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে গতকাল বুধবার ট্রাম্প বলেন, ‘আমি এটা করতেও পারি, না–ও করতে পারি।’
আয়াতুল্লাহ খামেনি গতকাল তাঁর ধারণ করা এক ভাষণে ট্রাম্পের বক্তব্যের কড়া জবাব দেন। বলেন, ‘যেকোনো মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের খেসারত দিতে হবে। ইরানি জাতি কখনোই আত্মসমর্পণ করবে না।’
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার এই প্রত্যাখ্যানকে গুরুত্ব না দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘শুভকামনা রইল’। তবে তিনি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, ‘আমি কী করব, সেটা কেউ জানে না।’
ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও বলেন, ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, এর অর্থ হচ্ছে আমার ধৈর্য শেষ।’
ট্রাম্পের ইরানে হামলার পরিকল্পনা অনুমোদনের খবর প্রথম প্রকাশ করে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
ইসরায়েল ইরানে নতুন করে হামলা করেছে, যার লক্ষ্য ছিল ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক স্থাপনা। জবাবে ইরান হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে বলে জানায়। অবশ্য ইসরায়েল দাবি করেছে, এতে তাদের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

গত শুক্রবার ভোরে ইরানে ইসরায়েলের আগ্রাসনের পর গতকাল খামেনি প্রথম প্রকাশ্য বক্তব্য দেন।
জাতিসংঘে ইরানের প্রতিনিধি এক্সে ট্রাম্পকে কটাক্ষ করে লেখেন, জোরাজুরি করলে ইরান কখনো আলোচনায় বসে না। জোর করে শান্তি আনা যায়—ইরান এমনটা বিশ্বাস করে না। আর আলোচনা অবশ্যই এমন এক ‘যুদ্ধবাজের’ সঙ্গে নয়, যিনি নিজের গুরুত্ব টিকিয়ে রাখতে মরিয়া।
ইরানের প্রতিনিধি আরও লেখেন, ইরানের কোনো কর্মকর্তা কখনো হোয়াইট হাউসের দরজায় গিয়ে মাথা নত করে অনুরোধ জানাননি।
এই প্রতিনিধি বলেন, ট্রাম্পের মিথ্যাচারের চেয়েও ঘৃণিত হচ্ছে তাঁর কাপুরুষোচিত হুমকি, যাতে তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে ‘হত্যার’ কথা বলেন।
এই বাগ্‌যুদ্ধের মধ্যেই দেখা গেছে, লাখ লাখ ইরানি রাজধানী তেহরান ছেড়ে যেতে সড়কে বেরিয়ে পড়েছেন। এই শহরে প্রায় এক কোটি মানুষ বসবাস করেন।
ইসরায়েলের উগ্রবাদী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গতকাল এক ভিডিও বার্তায় দাবি করেছেন, তাঁর দেশের সেনাবাহিনী ‘ধাপে ধাপে’ ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকি নির্মূল করার পথে এগোচ্ছে।
এই উগ্র ইহুদিবাদী নেতা দাবি করেন, ‘আমরা তেহরানের আকাশ নিয়ন্ত্রণ করছি। আমরা আয়াতুল্লাহদের শাসনের ওপর প্রবল শক্তি দিয়ে আঘাত হানছি। পারমাণবিক স্থাপনা, ক্ষেপণাস্ত্র, সদর দপ্তর ও শাসকের প্রতীকগুলোকে নিশানা করছি।’
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ সিনেট কমিটিকে জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেকোনো সময় যেকোনো নির্দেশ দিলে প্রতিরক্ষা বাহিনী তা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত।
হেগসেথের এই মন্তব্য এমন সময়ে এল, যখন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি জড়ো হচ্ছে। ইউএসএস নিমিৎসের নেতৃত্বাধীন বিমানবাহী একটি রণতরি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে উপসাগরীয় অঞ্চলে যাচ্ছে। সেখানে আগে থেকে মোতায়েন ইউএসএস কার্ল ভিনসনের সঙ্গে এই রণতরি যোগ দেবে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অন্যান্য সামরিক বিমান, জ্বালানি ট্যাংকারও ইউরোপ থেকে স্থানান্তরিত হচ্ছে, যার মধ্যে এফ–২২ এবং এফ–৩৫ যুদ্ধবিমান রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও আগামী বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামির সঙ্গে বৈঠক করবেন। আলোচনার মূল বিষয় হবে ইরান।
বিবিসি জানতে পেরেছে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলার জন্য ডিয়েগো গার্সিয়া বা সাইপ্রাসে যুক্তরাজ্যের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে চায়—এমন কোনো কিছু তারা আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাজ্যকে জানায়নি।
সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র যদি এসব ঘাঁটি থেকে হামলা চালাতে চায়, তবে আগেই তারা মিত্রদেশকে জানায়। যুক্তরাজ্যের একটি সূত্র জানিয়েছে, সব বিকল্প বিবেচনায় রয়েছে। তবে মার্কিন পরিকল্পনা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়।
গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের জেরুজালেম দূতাবাস সেখানে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। কতজন মার্কিন নাগরিক ইসরায়েল ছাড়তে চান, কিংবা মার্কিন সেনাবাহিনী তাঁদের সরিয়ে নিতে সাহায্য করবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

ইরান বিষয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে তুলসী গ্যাবার্ডের বিরোধ
ইরান বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ডের বিরোধ দেখা দিয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পদক্ষেপ বিবেচনার প্রেক্ষাপটে তুলসী গ্যাবার্ড মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পছন্দের তালিকা থেকে সরে গেছেন বলেই মনে হচ্ছে। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ট্রাম্প প্রশাসনের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এমনটাই জানিয়েছেন।
আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ৪৩ বছর বয়সী তুলসীকে জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক পদে মনোনীত করেন ট্রাম্প। আলোচনা-সমালোচিত এই মনোনয়ন মার্কিন সিনেটে অনুমোদন পাওয়ার পর গত বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তুলসী দায়িত্ব নেন। আগে গোয়েন্দা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা না থাকলেও দুই দশকের বেশি সময় মার্কিন বাহিনীতে সেনাসদস্য হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তুলসীর।
এনবিসি নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, অতীতে তুলসীকে বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের কড়া সমালোচনা করতে দেখা গেছে।
তুলসীর ঘনিষ্ঠরা জোর দিয়ে বলছেন, ইরান ইস্যুতে হোয়াইট হাউসে কিছুটা টানাপোড়েন আছে। তবে জনপরিসরে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তার অনেকটাই অতিরঞ্জিত।
২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ৪৩ বছর বয়সী তুলসীকে জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক পদে মনোনীত করেন ট্রাম্প। আলোচিত-সমালোচিত এই মনোনয়ন মার্কিন সিনেটে অনুমোদন পাওয়ার পর গত বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তুলসী দায়িত্ব নেন। আগে গোয়েন্দা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা না থাকলেও দুই দশকের বেশি সময় মার্কিন বাহিনীতে সেনাসদস্য হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তুলসীর।
অবশ্য এনবিসি নিউজের সঙ্গে কথা বলা কেউই এটা মনে করেন না যে ট্রাম্পের ইরান নীতির কারণে তুলসী প্রশাসন ছাড়বেন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র যদি এই সংঘাতে সরাসরি জড়িয়েও পড়ে।
রাজনৈতিকভাবে তুলসীর নাজুক অবস্থানটি চলতি সপ্তাহে প্রকাশ্যে আসে, যখন ট্রাম্প গত মার্চ মাসে কংগ্রেসে দেওয়া তাঁর (তুলসী) সাক্ষ্য নিয়ে তাঁকে একপ্রকার আক্রমণ করেন।
কংগ্রেসে তুলসী বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করে না যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে, যা ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
গত মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বহনকারী উড়োজাহাজ এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘সে (তুলসী) কী বলেছে, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি মনে করি, তারা (ইরান) পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর খুব কাছাকাছি রয়েছে।’
বিষয়টি সম্পর্কে অবগত এক ব্যক্তি বলেছেন, গত মার্চে কংগ্রেসে তুলসীর সাক্ষ্যের পর থেকে এ পর্যন্ত ইরান বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
কিন্তু একজন প্রেসিডেন্ট যদি প্রকাশ্যে তাঁর জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালকের বক্তব্য অস্বীকার করেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এই ইস্যুতে তুলসী কি এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া থেকে ছিটকে পড়েছেন?
এনবিসি নিউজের সঙ্গে কথা বলা কেউই অবশ্য এটা মনে করেন না যে ট্রাম্পের ইরান নীতির কারণে তুলসী প্রশাসন ছাড়বেন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র যদি এই সংঘাতে সরাসরি জড়িয়েও পড়ে।
তা ছাড়া এই বিরোধের বিষয়টি ট্রাম্পের ‘মেগা’ (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) জোটের মধ্যকার একটি বিভাজনও প্রকাশ করে। মেগার কিছু সমর্থক ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যেকোনো সামরিক পদক্ষেপে পাশে থাকার পক্ষপাতী। আর অন্যরা বলছেন, এ ধরনের হস্তক্ষেপ ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতির পরিপন্থী হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইসরায়েল-ইরান সংঘাত নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ আলোচনা থেকে তুলসীকে কার্যত দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে।
ইসরায়েল-ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা নিয়ে আলোচনার জন্য ৮ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের ক্যাম্প ডেভিডে শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক হয়। এই বৈঠকে যোগ দেননি তুলসী। এতে করে প্রশাসনে তাঁর অবস্থান নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন ওঠে।
তবে হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা এনবিসি নিউজকে বলেছেন, ক্যাম্প ডেভিডের বৈঠকটিতে তুলসী উপস্থিত থাকতে পারেননি। কারণ, ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য হিসেবে তখন তাঁকে পূর্বনির্ধারিত প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হচ্ছিল।
গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেন, তুলসী একজন সাবেক সেনাসদস্য, একজন দেশপ্রেমিক, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একনিষ্ঠ সমর্থক। ২০২৪ সালে ট্রাম্প যে জোট গড়েছেন, তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিনি। তুলসী যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা দলের অবিচ্ছেদ্য সদস্য। যুক্তরাষ্ট্রকে বিদেশি হুমকি থেকে নিরাপদ রাখতে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার জন্য তাঁরা কৃতজ্ঞ।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক কে এই তুলসী গ্যাবার্ড
তবে তুলসীর সাম্প্রতিক ইরান-সংক্রান্ত মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন কিছু রিপাবলিকান। তাঁদেরই একজন লুইজিয়ানার রিপাবলিকান সিনেটর জন কেনেডি। গত সপ্তাহে তিনি তুলসীকে কটাক্ষ করে মন্তব্য দেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের দুই কর্মকর্তা বলেন, তুলসী অনেক দিন ধরেই ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পদক্ষেপের বিরোধিতা করে আসছেন। পাশাপাশি তিনি পর্দার আড়ালে কূটনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।