যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে অভিবাসীদের মধ্যে নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে এক অদৃশ্য আতঙ্ক। আইস (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট) হঠাৎ হানা দিচ্ছে কর্মস্থলে, কিছু জায়গায় চলছে চেকপয়েন্ট তল্লাশি, এবং সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে নানা গুজব। এসব মিলিয়ে বৈধ-অবৈধ উভয় অভিবাসী সম্প্রদায় এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, ক্যালিফোর্নিয়া, মিশিগান, টেক্সাস ও ফ্লোরিডার মতো অভিবাসীবহুল অঙ্গরাজ্যগুলোর গ্রোসারি, রেস্টুরেন্ট, কার ওয়াশ, নির্মাণ সাইট—এসব এখন আইসের নজরদারির আওতায়। ব্রঙ্কস ও জ্যাকসন হাইটসে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অভিযানে আইস কর্মীদের দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এক অভিবাসী নারী যিনি পরিবারসহ নিউজার্সিতে বসবাস করছেন, বলেন—“আমার স্বামী রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। হঠাৎ একদিন কাজ থেকে ফোন এলো—তাঁকে আটকানো হয়েছে। এখন আমি সন্তানদের নিয়ে একা। কাজ করতে পারি না, আইনি সহায়তা নিতে পারছি না, শুধু কাঁদছি।”
২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে এফ-১ শিক্ষার্থী ভিসায় প্রায় ১৩ হাজার শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। আগের বছরগুলোর শিক্ষার্থীসহ এ সংখ্যা এখন প্রায় ৫০ হাজার ছুঁইছুঁই। অনেকেই আর্থিক চাপ সামলাতে ক্যাম্পাসের বাইরে নগদে কাজ শুরু করেছেন—রেস্টুরেন্ট, গ্রোসারি, অ্যামাজন ডেলিভারি, রাইড শেয়ারিং ইত্যাদিতে।
কিন্তু এই কাজ সরাসরি ভিসার শর্ত লঙ্ঘন। আইসির জন্য এটি একটি স্পষ্ট টার্গেটিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমি জানতাম এটা ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু দেশে পরিবারটা আমার টাকার ওপর নির্ভর করে। এখন শুনছি, আমাদের অ্যাপার্টমেন্টেও আইস এসেছিল। রাতে ঘুম আসে না।”
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার মানুষ বি-১/বি-২ ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। ভ্রমণের উদ্দেশ্য থাকলেও অনেকেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, কাজ শুরু করেন নগদে। রেস্টুরেন্ট, স্টোর, কিংবা ডেলিভারি কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন—যা পুরোপুরি বেআইনি। এক অভিভাবক জানান,“আমার ছেলে ভিজিটর ভিসায় এসে একটা দোকানে কাজ শুরু করেছিল। এখন সে কোথাও বের হয় না। শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।”
আইন অনুযায়ী, এসাইলাম আবেদন করলেও কাজের অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত কাজ করা নিষিদ্ধ। অথচ বহু আবেদনকারী জীবনধারণের তাগিদে নিয়ম ভাঙছেন। এসব তথ্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, মোবাইল ট্র্যাকিং, সোশ্যাল মিডিয়া, এমনকি প্রতিবেশীর অভিযোগের মাধ্যমেও আইসের কাছে পৌঁছাচ্ছে।
বর্তমানে ইমিগ্রেশন বিভাগ শুধু কাগজপত্রই নয়, বরং আবেদনকারীদের ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টগুলো পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করছে।
“দুই বছর আগে আমি একটা পোস্ট করেছিলাম—‘আমেরিকা আমাদের ঠিক বুঝতে পারে না।’ এখন শুনছি এসবও কেসে প্রভাব ফেলে। খুব দুশ্চিন্তায় আছি।”
কমিউনিটির নেতা নাসির খান পল বলেন, “অনেকে না বুঝেই ফেসবুকে দেশবিরোধী মন্তব্য করে বসেন। পরে ভিসা বা আশ্রয়ের আবেদন করতে গিয়ে বিপদে পড়েন। এটা বড় ভুল।”
যুক্তরাষ্ট্র এখনো সত্যিকারের নির্যাতিতদের জন্য আশ্রয় দেয়। তবে মিথ্যা তথ্য, সাজানো গল্প দিয়ে কেউ অ্যাসাইলাম পেতে চাইলে তারা বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনেন। আইনজীবী মঈন চৌধুরী বলেন,“যারা বৈধভাবে এখানে থাকতে চান, তাদের জন্য এখনও সুযোগ রয়েছে। কিন্তু যারা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে সুবিধা নিতে চান, তাদের জন্য এই দেশ কঠোর।” তিনি আরও বলেন,“এই দেশ সুযোগের পাশাপাশি নিয়মেরও দেশ। আপনি যদি সততার সঙ্গে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তাহলে আইন মানতেই হবে।”
ভয় নয়—প্রয়োজন সচেতনতা, সঠিক তথ্য, ও আইনগত সহায়তা। অভিবাসীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বহু সংগঠন কাজ করছে যারা বিনামূল্যে বা স্বল্প খরচে লিগ্যাল সহায়তা প্রদান করে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার নাম ও যোগাযোগ: নিউ ইয়র্ক ইমিগ্রেশন কোয়ালিশন ( ফোন ২১২-৬২৭-২২২৭), ন্যাশনাল ইমিগ্রেন্ট জাস্টিস সেন্টার
( ফোন ৩১২-৬৬০-১৩৭০), ইমিগ্রান্ট ডিফেন্স প্রজেক্ট হটলাইন (ফোন: ২১২-৭২৫-৬৪২২)সহ নিউইয়র্ক এবং অভিবাসীবহুল এলাকায় বেশ কিছু সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অভিবাসীদের সাহায্যে কাজ করছে। অভিবাসন সংক্রান্ত যে কোনো প্রয়োজনে তাদের সাথে সহজেই যোগাযোগ করা যেতে পারে।
অভিবাসী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করলে নিয়ম জানা ও মেনে চলা একান্ত জরুরি। সামাজিক মাধ্যমে দায়িত্বশীল হোন, অনুমতি ছাড়া কাজ করবেন না, এবং কোনো অবস্থায় মিথ্যা তথ্য দেবেন না। যুক্তরাষ্ট্র এখনো অভিবাসীদের স্বপ্নপূরণের দেশ। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তব করতে হলে সততা, আইন মেনে চলা এবং সচেতনতা—এই তিনটিই আপনার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।