যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘অপরাধ ও হোমলেস মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে কারণে জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাজধানী শহরকে ফেডারেল নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। তার পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে নিউইয়র্ক সিটি, এমন আভাসও তিনি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে শিগগিরই তিনি নিউইয়র্ক সিটিকেও দেখবেন। তবে নিউইয়র্ক সিটিকে ফেডারেল নিয়ন্ত্রণে নেয়া টাম্পের পক্ষে সহজ হবে না। কারণ ওয়াশিংটন ডিসিকে যে আইনে ফেডারেল আওতায় নেয়া হয়েছে, সে আইন নিউইয়র্কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
ওয়াশিংটনের স্থানীয় স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য ফেডারেল অনুমোদন দেওয়ার পর সেখানে ৮০০ ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের প্রতিবাদে হোয়াইট হাউসের কয়েক ব্লক দূরে বিক্ষোভকারীরা জড়ো হন। তাঁরা ‘বু’ ধ্বনি দিয়ে তাঁর পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন। ট্রাম্পের দাবি, ওয়াশিংটন ডিসিতে অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় ফেডারেল কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়েছে। ট্রাম্পের নির্দেশে ন্যাশনাল গার্ডের সৈন্যরা ওয়াশিংটন ডিসির রাস্তায় উপস্থিত হতে শুরু করে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সাঁজোয়া যান দেখা গেছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মোট ৮০০ জন ন্যাশনাল গার্ড সদস্য এবং ৫০০ জন ফেডারেল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এজেন্ট মোতায়েন করা হবে। সাংবাদিকদের ট্রাম্প জানান, ওয়াশিংটন এখন পুরোপুরি আইনশৃঙ্খলাহীন পরিস্থিতিতে রূপ নিচ্ছে। তবে শহরের মেয়র মুরিয়েল বাউসার প্রেসিডেন্টের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩ সালে অপরাধ বেড়ে গেলেও পরে তা কমে এসেছে। সহিংস অপরাধ এখন গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম পর্যায়ে রয়েছে। ট্রাম্প বলেন, ‘অপরাধ, রক্তপাত, বিশৃঙ্খলা ও নোংরামি থেকে আমাদের রাজধানীকে উদ্ধার করার জন্য আমি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিচ্ছি।’ এ সময় তার পাশে ছিলেন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি। মূলত ফেডারেল নিয়ন্ত্রণে থাকাকালে শহরের পুলিশ বাহিনী তিনিই পরিচালনা করবেন।ট্রাম্পের অভিযোগ, ওয়াশিংটন ডিসি সহিংস গ্যাং, রক্তপিপাসু অপরাধী, মাদকাসক্ত ও গৃহহীনদের দখলে চলে গেছে। তবে মেট্রোপলিটন পুলিশ বিভাগের তথ্য বলছে, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে হত্যাকাণ্ড ৩২ শতাংশ কমেছে, যা ২০১৯ সালের পর সর্বনিম্ন। এ বছরও আরও ১২ শতাংশ কমেছে।
তবে বিক্ষোভকারীরা বলছেন, এটি নিছক অজুহাত রাজধানীর ওপর ক্ষমতা দখলের ন্যায্যতা প্রমাণের কৌশল। ওয়াশিংটন ডিসির বাসিন্দাদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করা সংগঠন ফ্রি ডিসির নির্বাহী পরিচালক কেয়া চ্যাটার্জি বলেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ দীর্ঘদিন অবহেলিত ওয়াশিংটন ডিসির বাসিন্দাদের অধিকারের ওপর আঘাত। এটি বড় ধরনের উত্তেজনা উসকে দেবে।
কেয়া চ্যাটার্জি বলেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে নজিরবিহীন বা অস্বাভাবিক বলে আখ্যা দিলে কম হয়ে যাবে। এটা নিরেট কর্তৃত্ববাদ। ওয়াশিংটন ডিসির লাখ লাখ বাসিন্দার রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে বহু বছর ধরে বিতর্ক চলে আসছে। একইসঙ্গে শহরের পুলিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণও নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও প্রেসিডেন্ট ডিসি মেট্রো পুলিশকে সরাসরি ফেডারেল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য হোম রুল অ্যাক্টের ৭৪০ ধারা ব্যবহার করেছেন। এটি কখনো অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা পায়নি এবং ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণেই আছে। যদিও ১৯৭৩ সালের ‘হোম রুল আইন’ কিছু স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু স্থানীয় আইন ও বাজেট অনুমোদন করে কংগ্রেস। কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠ শহর হওয়ায় সমান নাগরিক অধিকার নিয়েও জটিলতা রয়েছে।
নাগরিক অধিকার নেতা রেভারেন্ড এল শার্পটন ট্রাম্পের পদক্ষেপকে ‘ন্যায়বিচার ও নাগরিক অধিকারের সর্বোচ্চ অবমাননা’ বলে অভিহিত করেছেন এবং বলছেন এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের একটি কৌশল। বিক্ষোভকারীরা মনে করেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত আবারও প্রমাণ করেছে যে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত নীতির ওপর তাদের প্রভাব নেই বললেই চলে। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ২০ বছর বয়সী কলেজছাত্র আমারি জ্যাক বলেন, তিনি এই পদক্ষেপকে পুরোপুরি শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ট্রাম্প বহু বছর ধরে হোয়াইট হাউসের আশপাশের মহানগরীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কথা বলছেন।
তবে এমন একটি পদক্ষেপের জন্য কংগ্রেসকে ১৯৭৩ সালের হোম রুল আইন বাতিল করতে হবে। জ্যাক আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমি আজ এখানে এসেছি। কারণ, ডিসি যতটুকু স্বায়ত্তশাসন পায়, সেটাও হারিয়ে যাবে বলে আমার আশঙ্কা হচ্ছে। আমরা ডিসির স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে নিজেরা নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই এবং আমাদের সম্প্রদায়কে এগিয়ে নিতে চাই। আমরা চাই না, কোনো প্রেসিডেন্ট এসে আমাদের শহর শাসন করুক।’
ট্রাম্প ‘অপরাধ বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় সরকারকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, অপরাধের হার কেন্দ্রীয় সরকারের কাজকর্মের জন্য অগ্রহণযোগ্য ঝুঁকি তৈরি করছে। ট্রাম্প বড় ধরনের অভিযান চালিয়ে অপরাধী গোষ্ঠী, মাদক ব্যবসায়ী ও অপরাধীদের দমন করতে চান।
তিনি শহরটিকে বস্তিমুক্ত এবং হোমলেসমুক্ত করার কথাও বলেছেন। যদিও এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছুই জানাননি। তবে ওয়াশিংটন ডিসির অ্যাটর্নি জেনারেল ব্রায়ান শোয়ালব এই পদক্ষেপকে ‘নজিরবিহীন, অপ্রয়োজনীয় এবং অবৈধ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ওয়াশিংটন ডিসিতে কোনো ‘অপরাধ বৃদ্ধির কারণে জরুরি অবস্থা’ নেই। বাস্তবে ডিসিতে সহিংস অপরাধের হার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে কমেছে। ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালে ৩৫ শতাংশ কমে গেছে এবং চলতি বছর আরও ২৬ শতাংশ কমেছে। বিক্ষোভকারী রাধা ট্যানারসহ অনেকেই মনে করেন, ট্রাম্প অপরাধ দমনের অজুহাত দেখিয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের চেষ্টা করছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিসহ ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত শহরগুলোকে ‘অরক্ষিত ও অপরাধপ্রবণ’ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছেন।
ডিসির ডেমোক্র্যাট মেয়র বাউসার স্বীকার করেন, ২০২৩ সালে অপরাধের হার বেড়েছিল, তবে বর্তমানে কোনো অপরাধ হ্রাস পেয়েছে। তিনি হোয়াইট হাউস কর্মকর্তা কর্তৃক ওয়াশিংটনকে বাগদাদের চেয়ে বেশি সহিংস বলে করা মন্তব্যকে ‘অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা’ বলেও আখ্যায়িত করেন।
এ ছাড়া ট্রাম্প ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া হোম রুল অ্যাক্টের আওতায় শহরের পুলিশ বিভাগকে সরাসরি ফেডারেল নিয়ন্ত্রণে নেবেন। এই আইন প্রেসিডেন্টকে বিশেষ জরুরি পরিস্থিতিতে ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণ নিতে লিখিতভাবে কংগ্রেসকে জানানোর সুযোগ দেয়, তবে সর্বোচ্চ ৩০ দিনের বেশি নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে না।গত রোববার এই সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মেয়র বাউসার বলেন, আমাদের আইনে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত আছে যেগুলোর কোনোটিই এখন কার্যকর নয়। তিনি ন্যাশনাল গার্ড দিয়ে স্থানীয় আইন প্রয়োগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি ট্রাম্পের আদেশকে ‘অশান্তিকর ও নজিরবিহীন’ বলে আখ্যা দেন।ইস্ট ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনাল জাস্টিস অ্যান্ড ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ডঃ হেইডি বোনার জানান, এই প্রথম কোনও রাষ্ট্রপতি ডিসি মেট্রো পুলিশকে ফেডারেলাইজ করার জন্য হোম রুল অ্যাক্টের ৭৪০ ধারা ব্যবহার করেছেন। এর অর্থ কী তা বলা অবশ্যই কঠিন।
ট্রাম্পের নজর এবার নিউইয়র্কে
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, ওয়াশিংটন ডিসির পুলিশ বিভাগের অস্থায়ী ফেডারেল নিয়ন্ত্রণের পর নিউইয়র্ক শহর হতে পারে তার পরবর্তী লক্ষ্য। তিনি বলেন, আমি শিগগিরই নিউইয়র্ক দেখব… চলুন এটা একসাথে করি। ১২ আগস্ট সোমবার হোয়াইট হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পর নিউইয়র্কের মেয়র এরিক অ্যাডামস প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, শহরের অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং ফেডারেল হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি যুক্তি দেন, অপরাধের হার কমছে, তবে ট্রাম্প এখনও শহরটি ‘পরিচ্ছন্ন’ করতে ফেডারেল পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছেন।আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিউইয়র্কে ট্রাম্পের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হবে। ওয়াশিংটন ডিসির ক্ষেত্রে ট্রাম্প ‘হোম রুল অ্যাক্ট’ ব্যবহার করে পুলিশ বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন। যা কেবল ডিসির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
নিউইয়র্কের ক্ষেত্রে এমন আইনি সুযোগ নেই। তবে, ফেডারেল সম্পত্তি সুরক্ষার জন্য জাতীয় গার্ড মোতায়েন করা সম্ভব হতে পারে। ডেমোক্র্যাট নেতারা ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে ‘বাড়াবাড়ি ধরনের হস্তক্ষেপ’ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে সমালোচনা করেছেন। তারা বলেন, শহরের অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, এবং ফেডারেল হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে স্থানীয় নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তবে আইনি জটিলতার কারণে ফেডারেল হস্তক্ষেপের বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।