নিউইয়র্ক সিটিতে চলে চারটি ফেরি রুট। ম্যাস ট্রানজিটের এই নগরে ৩৬টি সাবওয়ে লাইন। রয়েছে শত শত বাসরুট। আছে কমিউটার রেল। যা চেপে শহরতলীগুলোতে যাতায়ত চলে। লং আয়ল্যান্ড কানেটিকাট, নিউজার্সি ও হাডসন ভ্যালিতে মানুষ নিত্য যাতায়ত করে। কিন্তু আটলান্টিকের পাড়ের এই নগরীর পাঁচটি বোরোর চারটিই কোনো না কোনো দ্বীপে গড়ে ওঠা। ফলে ফেরি এখানকার জন্য অবাক হবার বিষয় নয়। বরং অতিপরিচিত, অতিব্যবহৃত একটি পরিবহন মাধ্যম। এবং সিটির ট্রানজিট নেটওয়ার্কের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আসুন আপনাদের এই ফেরির গল্প শোনাই।
প্রথমেই আসে স্ট্যাটান আয়ল্যান্ড ফেরি'র নাম। পাঁচটি বোরোর একটি এই স্ট্যাটান আয়ল্যান যাকে চেনাই যায় সেখানে যাওয়ার ফেরি দিয়ে। যা স্ট্যাটান আয়ল্যান্ডবাসীর জন্য রীতিমতো গর্বের প্রতীক। এই ফেরি সার্ভিস পুরোপুরি ফ্রি। চলে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা। ম্যানহাটানের দক্ষিণের শেষ সীমায় হোয়াইট হল টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায় আর ওপারে ফেরি ভেরে স্ট্যাটান আয়ল্যান্ডের উত্তর শোরে সেন্ট জর্জ টার্মিনালে। আজ থেকে ১১৯ বছর আগে ১৯০৫ সালে সিটি নিজেই চালু করে এই ফেরি। তারও আগে সেই উনবিংশ শতাব্দী থেকেই নানা ফর্মে, নানা ব্যবস্থায় স্ট্যাটান আয়ল্যান্ডের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সংযোগ ঘটতো ফেরির মাধ্যমে। ১৯০৫ সালে প্রকল্পটির নেতৃত্ব দেন স্ট্যাটান আয়ল্যান্ডের বাসিন্দা করনেলিয়ার ভ্যানডারবিল্ট। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ধনীদের একজন ছিলেন এই ভেন্ডারবিল্ট।
নিউইয়র্ক সিটি ফেরি বা এনওয়াইসি ফেরি সিটির প্রাথমিক ফেরি সিস্টেম। হর্নব্লোয়ার নামে একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি এর সরকারি নেটওয়ার্কটি পরিচালনা করে। ২০১৭ সালের মে মাসে শুরু হয় এটি ফেরি। যা চলাচল করে দক্ষিণ ব্রুকলিন, ইস্ট রিভার, রকওয়ে, সাউন্ডভিউ, অ্যাস্টোরিয়া ও সেন্ট জর্জের মথ্যে। মৌসুবে এটি গভর্নর আয়ল্যান্ডেও যাত্রী পরিবহন করে। নগরীর ভেতর ও বাইরে ৭০ নটিক্যাল মাইলে ৩৫টি পিয়ারকে যুক্ত করে এই ফেরি রুট। এনওয়াইসি ফেরির দাবি এটি দেশের সবচেয়ে বড় প্যাসেন্জার ফ্লিট। যার ৩৮টি ভেসেল রয়েছে।
এনওয়াই ওয়াটারওয়ে আরেকটি প্রাইভেট কোম্পনি যা পোর্ট অথরিটি, ডিপার্টমেন্ট অব ট্রানজিট ও এমটিএর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এই সার্ভিসটি শুরু হয় ১৯৮০'র দশকে। যা প্রাথমিকভাবে হাডসন নদীর এপার ওপার যাত্রী আনা নেওয়া করতো। সিটির উত্তরের কাউন্টিসমূহ কিংবা নিউজার্সির যে বাসিন্দারা নিউইয়র্ক যাতায়ত করেন তারাই ছিলেন এর যাত্রী। এখন এই সার্ভিসটি মিডটাউনের পিয়ার ৭৯ থেকে রেডহুক পর্যন্ড যাওয়া আসা করে। সপ্তাহান্তে এই ফেরির যাত্রা থাকে ফ্রি।
নিউইয়র্ক ওয়াটার ট্যাক্সি একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন সেবে। আর সেটি ভাড়াও করা যায় বিশেষ কিছু রুটে চলাচলের জন্য। পাঁচটি বোরো তথা নিউ জার্সির বিভিন্ন অংশকে সংযুক্ত করে এই ফেরি। তবে এক যাত্রায় সর্বোচ্চ ৩০ জন যাত্রী চলতে পারে এই ওয়াটার বাসে। প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন কর্পোরেট ইভেন্ট, বিয়ে, সিনেমার স্যুটিং ও ইস্ট রিভারে ভ্রমণের জন্য চালু করা হলেও পরে তা যাত্রী চলাচলের বাহন হয়ে উঠেছে। এদের প্যারেন্ট কোম্পানি সার্কল লাইন ম্যানহাটানের চারিদিকে সাইটসিয়িং ক্রুজও পরিচালনা করে।
একটি হিসাব দেখাচ্ছে ২০২৩ সালে এনওয়াইসি ফেরিতে যাত্রী চলাচলের হার বেড়েছে। আগের বছরের তুলনায় এ বছর এই রুটে ১২ লাখ বেশি যাত্রী চলাচল করেছে। মোট যাত্রী চলাচল করেছে ৬৬ লাখেরও বেশি। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৫৪ লাখ। তবে প্যানডেমিকের আগে এই সংখ্যা ২০১৯ সালে ছিলো ৫৭ লাখ। তবে ২০১৭ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত এই ফেরি পার করেছে ৩ কোটি ১০ লাখ যাত্রী। এর মধ্যে ইস্ট রিভার রুটটি সবচেয়ে জনপ্রিয়। এখানে প্রতিদিন গড়ে ৭,৭০০ জন যাত্রী চলাচল করে। সপ্তাহান্তে তা ১১ হাজার ছাড়িয়ে যায়। দ্বিতীয় যাত্রীবহুল রুটটি হচ্ছে অ্যাস্টোরিয়া। এই রুটে প্রতিদিন চলাচল করে ৪২০০ জন যাত্রী। সপ্তাহান্তে তা ৫৭০০ ছাড়িয়ে যায়।
স্ট্যাটান আয়ল্যান্ড ফেরি এখানে সর্বাধিক জনপ্রিয়। ডিপার্টমেন্ট অব ট্রানজিটের একটি হিসাব বলছে প্রতিদিন গড়ে ৩৫০০০ যাত্রী পরিবহন করে এই রুটের ফেরিগুলো। ৫টি জাহাজ ১১৭টি ট্রিপ পরিচালনা করে প্রতিদিন। রাশ আওয়ারে প্রতি ১৫ মিনিটে এবং অফ-পিক আওয়ারে প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর এই পথে ফেরি চলাচল করে। বছরে ১২ কোটি যাত্রী পারাপার করে স্ট্যাটান আয়ল্যান্ড ফেরি।
এখন নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষ এই ফেরি সার্ভিস আরও বিস্তৃত করতে চায়। কনি আয়ল্যান্ডের সঙ্গে ফেরি সংযোগ স্থাপন করার উদ্যোগ রয়েছে। ২০২১ সালে এই লক্ষ্যে কনি আয়ল্যান্ডের কাইজার পার্কে একটি ল্যান্ডিং টার্মিনালও স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তবে বালুর কারণে সেটি স্থায়ী নাও হতে পারে এই আশঙ্কায় তা স্থগিত রয়েছে। পরিবেশবিদরাও সেখানে টার্মিনাল স্থাপনের বিরোধী।
কোনি আয়ল্যান্ড ফেরি নেটওয়ার্কে না এলেও তা মেট্রো রেল নেটওয়ার্ক দিয়ে সংযুক্ত। তবে ফেরি দিয়ে নিউইয়র্ককে যাত্রীর জন্য অত্যন্ত উপযোগী করে তোলা হয়েছে। যা অনেকের জন্য স্বস্তির ও আনন্দের।