চলতি বছরের নির্বাচনের মধ্য দিয়েই দেশ হিসেবে আমেরিকার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে । গত প্রায় দুই শতাব্দীর চেনা যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বদলে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের এ বদলে যাওয়ার বাঁক বদলের নির্বাচন হতে পারে ২০২৪ সালের নভেম্বরের নির্বাচন।
সাম্প্রতিক মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসে এবারই প্রথম এক ব্যতিক্রম উত্তেজনায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আইওয়া ককাসের মধ্য দিয়ে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের প্রাইমারি শুরু হয়ে গেছে বছরের গোড়া থেকেই। সামনের কয়েকমাস প্রাইমারি নির্বাচন নিয়েই উত্তেজনা থাকবে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী। ফলে দলটির প্রাইমারি নিয়ে কোনো উত্তেজনা নেই। শেষ মুহূর্তে কোন ঘোষণা আসলে ভিন্ন কথা।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান দলের এগিয়ে থাকা প্রার্থী। রিপাবলিকান দলের প্রাইমারি নিয়ে উত্তেজনা রয়েছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত নিকি হ্যালি ট্রাম্পকে কতটা চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন বা ট্রাম্পের রানিং মেট হয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন কি না , এসব নিয়ে উত্তেজনা রয়েছে।
জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকার ইতিহাসে নজিরবিহীন বাস্তবতায় দুই প্রার্থীই নির্বাচনের মুখোমুখি হচ্ছেন। ১৯৪৫ সালে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্র্যুম্যানের পর সর্বনিম্ন জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট বাইডেন পুনর্নিবাচনে দাঁড়াচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা এখন ৩৫ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশের মধ্যে উঠানামা করছে। রিপাবলিকান সমর্থকদের কাছে প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্পের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও সার্বিক জনপ্রিয়তা জরীপ ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। আমেরিকার অধিকাংশ জনগণই উভয় প্রার্থীকে অপছন্দ করেন। এনপিআর এবং পিবিএস পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে ৫৩ শতাংশ মার্কিনিদের অপছন্দ জো বাইডেনকে। অপরদিকে ৫৬ শতাংশ লোকজনের অপছন্দ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে।
ভাবাদর্শের দিকে দীর্ঘদিন থেকে আমেরিকা ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান দলে বিভক্ত ছিল। উভয় দলের মধ্যেই ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন কর্মকৌশল নিয়ে জোরালো বিতর্ক চলে আসছিল দীর্ঘদিন থেকেই। এখন আর সে পরিস্থিতি নেই। উভয় দলের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ মতাদর্শিক বিভেদ এখন প্রকাশ্য এবং চরমে পৌঁছেছে। ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে চরম উদারনৈতিক ও মধ্যপন্থীদের সংঘাত চরমে। অপরদিকে রিপাবলিকান দলে রক্ষণশীল এবং অতিরক্ষণশীলদের সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার কোন সুযোগই এখন আর অবশিষ্ট নেই।
আমেরিকায় তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক দলও গড়ে ওঠেনি। এমন কোনও সম্ভাবনাও নেই। তবে ব্যাপক সংখ্যক মার্কিনিরা স্ব স্ব দলের তালিকা থেকে নিজেদের নাম সরিয়ে ফেলতে দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা জীবনের নানা পর্যায়ে দুই দলের পক্ষে তাদের নাম তালিকাভুক্ত করে থাকেন। প্রতিটি দল জানে , তাদের তালিকাভুক্ত সমর্থকদের খবর। এ তালিকাভুক্তির লোকজন দল পরিবর্তনও করতে পারেন নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে। সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা গেছে আমেরিকার প্রায় চল্লিশ শতাংশ লোকজন এখন উভয় দল থেকেই নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এসব লোকজনকে ইন্ডেপেন্ডেন্ট বা স্বতন্ত্র ভোটার হিসেবে দেখা হয়। নির্বাচনে এ স্বতন্ত্র, দলের তালিকাভুক্তিহীন ভোটারই শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। আসছে নির্বাচনে এ গ্রুপটিই জয় পরাজয়ের নির্ধারণী শক্তি হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদটি খুবই গুরুত্বের। প্রেসিডেন্টের প্রভাবে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এ প্রভাবে দেশের ভাবাদর্শ পরিবর্তন আনা সম্ভব। আইন আদালতে পরিবর্তন, যুদ্ধ শুরু ও শেষ করা , বিশ্ব মঞ্চে আমেরিকার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজ মার্কিন প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে থাকে।
অভ্যন্তরীণভাবে আমেরিকা এখন এক অস্থির সময় পার করছে। আমেরিকার সমাজ, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে অর্থনীতি, প্রযুক্তি - সব বিষয়গুলো ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে সংঘাতময় মার্কিন পক্ষগুলো নিজেদের অবস্থান নিয়ে জয় পাওয়ার চেষ্টা করছে।
এ বছরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কোন ভাবাদর্শের জয় হবে আমেরিকায়, এ নিয়ে জোরালো আলোচনা শুরু হয়েছে। অবশ্য সাম্প্রতিক প্রতিটি নির্বাচনেই জনসমাজের এমন বিভক্তি দেখা গেছে। ১৯৮৪ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টই ৫৩ শতাংশের বেশি ভোট পাননি। ১৮২৪ সালের পর থেকে মাত্র ৪ বার নির্বাচনে প্রেসিডেন্টরা ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন। সিভিল ওয়ারের পর আমেরিকার সামাজিক ও রাজনৈতিক বিতর্ক এখন এমনই তুঙ্গে যে বিষয়গুলোকে আর বিতর্ক বলা যায় না। রীতিমতো রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ বলে এখন বিবেচনা করা হচ্ছে।
কী নিয়ে বিভক্তি নেই আমেরিকার? জলবায়ু , অভিবাসন, গর্ভপাত, আগ্নেয়াস্ত্র আইন, শিক্ষা ব্যবস্থা , চিকিৎসা ব্যবস্থা, আবাসন, সামাজিক নিরাপত্তা - কোনোকিছু নিয়েই এখন আর কোন ন্যূনতম ঐক্য নেই। এমনকি গণতন্ত্র রক্ষা নিয়েও যুদ্ধ ঘোষনা করতে হচ্ছে আমেরিকার নির্বাচনে প্রার্থীকে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, এবারের নির্বাচন গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই। রক্ষণশীলরা দেখছে আমেরিকা বদলে যাচ্ছে নিজেদের চিন্তার উল্টো পথে। দুর্বল এবং উদারনৈতিকতার পথে আমেরিকার এমন বদলে যাওয়া ঠেকাতে রক্ষণশীলরাও এখন যুদ্ধংদেহি।
যুক্তরাষ্ট্রের উদারনৈতিক লোকজন দেখছে তাদের মূল্যবোধ প্রতিদিন ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত না নিয়েই ষড়যন্ত্র ও চাপিয়ে দেয়া নীতির কারণে অসহিষ্ণুতার বিস্তার ঘটছে। আমেরিকার নির্বাচন পদ্ধতিতে গত ৮টি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে ৭ বারই ডেমোক্র্যাট পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েছে। যদিও এ সময়ে ডেমোক্র্যাটদের মাত্র পাঁচ জন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে পেরেছেন।
গালাপো পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে ৪০ শতাংশ লোকজনই এখন নিজেদের স্বতন্ত্র বলে দাবি করছে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে আমেরিকার ৬০ শতাংশ ভোটারই ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকানদের পছন্দ করছে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে দুই দলের বাইরে থাকা ৪০ শতাংশ লোকজনের মধ্যে কোন আদর্শিক ঐক্য নেই । ফলে এ লোকজনের উপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রে অন্য কোনো দলের উত্থানও সম্ভব নয়।
সার্বিকভাবে আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে এ দেশের লোকজন হতাশ। গালাপো জরিপেই দেখা গেছে পাঁচজনের মধ্যে চারজন নাগরিকই এ নিয়ে তাদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে আমেরিকানদের এখন প্রকাশ্য অভিমত, তারা বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বেশি বয়স্ক বলে মনে করছে। অর্থনীতি, কর্মসংস্থান সহ নানা ক্ষেত্রে সাফল্য থাকলেও ইমিগ্রেশন এবং ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে বাইডেনের প্রতি আমেরিকান মানুষের অপছন্দ এখন প্রকাশ্য। জরিপে দেখা গেছে ৫৩ শতাংশ লোকজন প্রকাশ্যেই বাইডেনের প্রতি তাদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছে। এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি ৫৬ শতাংশ লোকজন তাদের অপছন্দের কথা জানিয়েছে।