বাণিজ্যযুদ্ধের পালে আবার হাওয়া দিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

চীনের ওপর ১০০% পর্যন্ত শুল্ক বৃদ্ধির হুমকি

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:২৫

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল শুক্রবার বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে আবারও বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করলেন। বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে কয়েক মাসের অস্বস্তিকর যুদ্ধবিরতির অবসান ঘটিয়ে তিনি জানান, চীনের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপের পাল্টা জবাবে এবার যুক্তরাষ্ট্র আমদানি শুল্ক বাড়াবে।
ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, চীন থেকে আমদানি করা পণ্যে অতিরিক্ত ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হবে। সেই সঙ্গে সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যার রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ জারি করা হবে। আগামী ১ নভেম্বরের মধ্যে এসব করা হবে। বিদ্যমান শুল্কবিরতির মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯ দিন আগে তিনি এ ঘোষণা দিলেন।
ট্রাম্প আরও বলেছেন, তিন সপ্তাহ পর দক্ষিণ কোরিয়ায় চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, তা এখন অনিশ্চিত। ট্রাম্প নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, ‘এখন মনে হচ্ছে, সেই বৈঠকের আর মানে নেই।’
তবে হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘আমি এখনো বৈঠক বাতিল করিনি, তা হতেও পারে।’ চীন অবশ্য কখনো এ বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।
চীন বিরল ধাতুর রপ্তানিতে আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার পরিপ্রেক্ষিতে চীন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্বের বিরল ধাতুর বাজারের প্রধান সরবরাহকারী চীন। এ বিরল খনিজ ধাতু আজকের প্রযুক্তিগত বিপ্লবের জন্য অপরিহার্য। যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব এখন পৃথিবীতে ঘটছে, সে বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি হলো চিপ বা সেমিকন্ডাক্টর। সেই চিপ তৈরিতে এই বিরল খনিজ অপরিহার্য। সেই সঙ্গে অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রেও এই চিপ প্রয়োজন।
এ ঘটনায় ছয় মাস পর আবারও ওয়াশিংটন-বেইজিং সম্পর্কের বড় ভাঙন দেখা দিয়েছে। অনেকেই এখন প্রশ্ন তুলছেন—ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর যে সাময়িক অর্থনৈতিক সমঝোতা অর্জিত হয়েছিল, তা আদৌ টিকে থাকবে কি না।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনে সফটওয়্যার রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করলে তা দেশটির ক্লাউড কম্পিউটিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিল্পের জন্য বড় ধাক্কা হবে। ট্রাম্প বিমান ও যন্ত্রাংশের রপ্তানিতেও নিয়ন্ত্রণের হুমকি দিয়েছেন। প্রশাসন আরও নতুন লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করছে বলেও জানা গেছে।

বেইজিং বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের নিন্দা জানিয়ে আসছে। তারা মনে করছে, এতে বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থা দুর্বল হচ্ছে।
বাজারে ধস, অনিশ্চয়তায় বৈশ্বিক অর্থনীতি
ট্রাম্পের এসব ঘোষণায় বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির সম্পর্ক যেমন টালমাটাল হয়েছে, তেমনি বড় ধাক্কা লেগেছে বাজারে। বর্তমানে বিশ্বের ৯০ শতাংশের বেশি প্রক্রিয়াজাত বিরল ধাতু ও চুম্বক তৈরি করে চীন। এ মহার্ঘ বস্তু বৈদ্যুতিক গাড়ি, বিমানের ইঞ্জিন ও সামরিক রাডারের মতো পণ্যে ব্যবহৃত হয়।
ট্রাম্পের আকস্মিক ঘোষণার পর মার্কিন শেয়ারবাজারের এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ২ শতাংশের বেশি পড়ে গেছে। এপ্রিলের পর এটি সবচেয়ে বড় পতন। বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে সোনা ও মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। ফলে অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে ডলার দুর্বল হয়েছে। এ ছাড়া প্রযুক্তি খাতের শেয়ারের দরও মূল লেনদেনের পরবর্তী লেনদেনে পড়ে যায়।
বিশ্লেষক ক্রেইগ সিঙ্গেলটন বলেন, ট্রাম্পের ঘোষণা হয়তো শুল্কবিরতির অবসান ঘটানোর সূচনা। তাঁর মতে, ওয়াশিংটন চীনের এই বিরল খনিজ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখছে—বেইজিং হয়তো নিজের হাতের তাস নিয়ে বেশিই খেলে ফেলছে।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, চীন নাকি বিভিন্ন দেশে চিঠি পাঠিয়ে জানাচ্ছে, তারা বিরল ধাতুর উৎপাদনসংক্রান্ত প্রতিটি উপাদানে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে। তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েকটি দেশ আমাকে জানিয়েছে, তারা চীনের এ পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ।’
‘শত্রুভাবাপন্ন নির্দেশ’, চীনকে দুষলেন ট্রাম্প
চীনের পদক্ষেপকে ট্রাম্প ‘শত্রুভাবাপন্ন নির্দেশ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তাদের পদক্ষেপের জবাবে আমাদের আর্থিকভাবে প্রতিরোধ গড়তে হচ্ছে। যে উপাদানগুলোতে তারা একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়, আমাদের কাছে তার দ্বিগুণ বিকল্প আছে।’
হোয়াইট হাউস বা ওয়াশিংটনের চীনা দূতাবাস কেউই এ বিষয়ে মন্তব্য করেনি। মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর ও ট্রেজারি বিভাগও প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
এর আগে ট্রাম্প প্রশাসন চীনা বিমান সংস্থাগুলোর ওপর নতুন বিধিনিষেধ আরোপের প্রস্তাব দেয়। লক্ষ্য, চীনের বিমান যেন রাশিয়ার আকাশসীমা ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রে আসা-যাওয়া করতে না পারে। একই দিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশন জানায়, বড় অনলাইন খুচরা বিক্রেতারা লক্ষাধিক নিষিদ্ধ চীনা ইলেকট্রনিক পণ্যের তালিকা থেকে সরিয়ে ফেলেছেন।
চীন বৃহস্পতিবারই পাঁচটি নতুন ধাতু ও সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াজাত প্রযুক্তিকে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার তালিকায় যুক্ত করেছে। এমনকি বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো যারা চীনের কাঁচামাল ব্যবহার করে, তাদেরও নতুন নিয়ম মানতে হবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, অক্টোবর মাসের শেষ দিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় শুরু হতে যাওয়া এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো–অপারেশন (অ্যাপেক) সম্মেলনের ফাঁকে সম্ভাব্য ট্রাম্প–সি বৈঠকের আগে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
চীন–মার্কিন সম্পর্ক বিশ্লেষক স্কট কেনেডি বলেন, উভয় পক্ষই মনে করছে, চাপ বাড়ালে অপর পক্ষ ছাড় দেবে। হয়তো তারা ধরে নিচ্ছে, অ্যাপেকে সমঝোতা হবে না এবং সে কারণে পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য আগেভাগেই শক্তি বাড়াচ্ছে।