ইউক্রেনে প্রায় তিন বছর ধরে যুদ্ধে লিপ্ত রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তাদের মতে, তিন মাস আগে দেওয়া পূর্বাভাসের চেয়েও দ্রুততম গতিতে ঘটবে এই বৃদ্ধি। মঙ্গলবার (৩১ জানুয়ারি) আইএমএফ প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে এই তথ্য উঠে এসেছে। রুশ অর্থনীতির এমন অগ্রগতি দেশটির ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। মার্কিন সাময়িকী নিউজউইক এই খবর জানিয়েছে।
আইএমএফ বলেছে, ২০২৪ সালে রাশিয়ার অর্থনীতি দুই দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে যা দেশটির অক্টোবরের জিডিপি বৃদ্ধির চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। তখন দেশটির মোট জিডিপি এক দশমিক এক শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
অন্যদিকে, আইএমএফের পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি বছর মার্কিন অর্থনীতি মাত্র ২ দশমিক এক শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। মঙ্গলবার আইএমএফ প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে দেখা গেছে, রাশিয়ার এ বৃদ্ধি অন্য যে কোনও দেশের অর্থনীতির চেয়ে অনেক বেশি।
নভেম্বরে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দিয়েছিল তার তুলনায় আইএমএফ-এর এই পূর্বাভাস আরও বেশি ইতিবাচক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছিল, দেশটির প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক পাঁচ থেকে এক দশমিক পাঁচ শতাংশের মধ্যে হতে পারে।
দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর দুই দশমিক তিন শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন-বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
জানুয়ারিতে বিশ্ব ব্যাংকের দেওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, ২০২৪ সালে রাশিয়ায় এক দশমিক তিন এবং ২০২৫ সালে শূন্য দশমিক নয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।
এ বিষয়ে ইনভেস্ট ডট কনটক্সিয়া ডট কমের বাজার বিশ্লেষক জারগ্রোস দ্রজড বলেছেন, ‘আইএমএফ ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়ার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি আগের পূর্বাভাসের চেয়েও দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাবে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো দেশটির এই অগ্রগতি ঠেকাতে পারবে না। এতে অবশ্য আমাদের অবাক হওয়ার কিছু নেই।’
ইউক্রেনের সর্বাত্মক আক্রমণের পর বিশ্ব অর্থনীতি থেকে রাশিয়াকে একঘরে করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাশিয়ার তিন হাজার কোটি ডলার জব্দ করেছিল। এরপর রাশিয়ার প্রধান রফতানি পণ্য তেল ও গ্যাসকে লক্ষ্যবস্তু করে তারা।
এর প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় রাশিয়া। তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে মনোযোগ দেয় দেশটি। ব্যবসায়িক কৌশলের অংশ হিসেবে জ্বালানি পণ্য রফতানিতে ছাড়ের ঘোষণা দেয় মস্কো। এতে অপরিশোধিত জ্বালানি পণ্য ক্রয় করে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে চীনা ও ভারত।
দ্রজড আরও বলেন, ‘এই নিষেধাজ্ঞা রাশিয়া নয় বরং পশ্চিমাদের ওপরই প্রভাব ফেলেছে। তারা তেল ও গ্যাসের মতো স্বল্প মূল্যের জ্বালানি উৎস থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বঞ্চিত হয়েছে।’
তবে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসের পাশাপাশি কিছু বিষয়ে সতর্কও করেছে আইএমএফ। সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ফিনান্সিয়াল টাইমসকে জানিয়েছেন, প্রাথমিক তত্ত্ব-উপাত্তের ভিত্তিতে এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তবে তারা রাশিয়ার পরিসংখ্যানের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের চেষ্টা করছেন।
ইউরোপীয় কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনস (ইসিএফআর)-এর ভূ-অর্থনীতির নীতিবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক আগাথে ডেমারেজ। ২০২৩ সালের মার্চে ফরেন পলিসি সাময়িকীতে এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, রাশিয়ার অর্থনীতির উন্নয়ন বিষয়ক ক্রেমলিনের পরিসংখ্যান ‘বিশ্বাস করা যায় না’।
এদিকে, ফিনান্সিয়াল টাইমসকে গৌরিঞ্চাস বলেছেন, রাশিয়ার অর্থনীতি ‘অবশ্যই…আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে ভালো করছে।’ তবে যুদ্ধকালীন অর্থনীতির প্রণোদনা ও শক্তিশালী ভোগ্যমূল্য সে তুলনায় আংশিক কম। রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির এ সম্ভাবনা দেশটির জন্য আশা জাগানিয়া হলেও প্রকৃত অর্থে এটি ইউক্রেনে আক্রমণের পূর্বের প্রবৃদ্ধির তুলনায় কম।
গত মাসে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, ২০২৩ সালে রাশিয়ার অর্থনীতির আকার আনুমানিক ২ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছিল। তবে ‘প্রত্যাশিত পুনরুদ্ধারের চেয়ে শক্তিশালী এ বৃদ্ধির পেছনে অতিরিক্ত সামরিক ব্যয় ও যথেষ্ট রাষ্ট্রীয় অর্থ সহায়তা মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।’
২০২৪ সালে বর্ধিত বাজেট ব্যয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থায়নের জন্য প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ করার পরিকল্পনা করেছে রাশিয়া।
এ বিষয়ে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এলভিরা নাবিউলিনা অর্থনীতির লাগামহীনতার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, আরও বেশি করে ঋণ গ্রহণ এবং ভর্তুকি দিয়ে দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়াচ্ছে রুশ সরকার।
ডিসেম্বরে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি যদি একটি গাড়িকে তার কার্যক্ষমতার চেয়ে দ্রুত চালানোর চেষ্টা করেন...তাহলে ইঞ্জিনটি আগে-পরে অতিরিক্ত গরম হয়ে যাবে এবং আমরা বেশি দূর এগোতে পারব না।’