ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শীতল যুদ্ধ

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪:১৪

ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক এখন এক গভীর সংকটের মুখোমুখি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, অভিবাসন নীতি ও ইউক্রেন যুদ্ধ কেন্দ্র করে দীর্ঘদিনের মতবিরোধ এবার প্রকাশ্য রাজনৈতিক সংঘাতে রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে ইলন মাস্কের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় অঙ্কের জরিমানা এ উত্তেজনাকে আরও তীব্র করেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে ইউরোপকে কার্যত প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরায় প্রশ্ন উঠেছে—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পশ্চিমা ঐক্য কি ভেঙে পড়তে চলেছে? এ প্রেক্ষাপটে ইউরোপ-আমেরিকা সম্পর্ক এক নতুন মোড়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার নতুন এ শীতল যুদ্ধ নিয়ে বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস।
বিষয়টি কেন গুরুত্বপূর্ণ: ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সম্প্রতি ইলন মাস্কের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সকে ১৪ কোটি ডলার জরিমানা করেছে। এ সিদ্ধান্তই মূলত ওই দ্বন্দ্বের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। তবে বাস্তবে ট্রাম্প প্রশাসন আগে থেকেই ইউরোপের সঙ্গে সংঘাতের জন্য প্রস্তুত ছিল।
ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজিতে (জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল) ইউরোপকে কার্যত একটি ভূ-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ট্রাম্প নিজেই ইউরোপীয় দেশগুলোকে আক্রমণ করে বলেন—‘ওরা নিজেদের দেশ ধ্বংস করছে। ইউরোপ দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু।’
এ উত্তেজনার মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ চলছে।
বিস্তারিত প্রেক্ষাপট: ইইউ কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে যে, এক্স তার ব্যবহারকারীদের বিভ্রান্ত করেছে, বিজ্ঞাপন-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করেছে এবং গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত তথ্যের প্রবেশাধিকার বন্ধ করেছে। এ কারণে মাস্কের প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। এর জবাবে ইলন মাস্ক ইইউকে অভিযুক্ত করেন যে, তারা ‘আমলাতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা দমন করছে’। তিনি অ্যাবোলিশদ্যইইউ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে ইইউ বিলুপ্তির আহ্বান জানান, যা ইউরোপের কট্টর ডানপন্থিদের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন পায়। পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাদোস্লাভ সিকোরস্কি পাল্টা কটাক্ষ করে বলেন, ‘মঙ্গল গ্রহে চলে যান। সেখানে নাৎসি স্যালুটে কোনো সেন্সরশিপ নেই।’
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া: মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, এ জরিমানা শুধু এক্স নয়, বরং সমগ্র আমেরিকান প্রযুক্তি খাত ও মার্কিন জনগণের ওপর আক্রমণ।
ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, যিনি প্রকাশ্য ইউরোপ-বিরোধী হিসেবে পরিচিত, এই জরিমানাকে ‘আবর্জনা’ বলে আখ্যা দেন এবং বলেন, এটি ইউরোপের ‘সেন্সরশিপ’ চাপিয়ে দেওয়ার ফল। সিনেটর টেড ক্রুজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানান—যা সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র তার শত্রু দেশগুলোর ক্ষেত্রেই করে থাকে।
ট্রাম্পের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থনীতি ও মতপ্রকাশ দমিয়ে রাখা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দুর্বল করা—
এ অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছে গণঅভিবাসন। ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, ইউরোপের শাসকগোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে সীমান্ত খুলে দিয়ে সমাজের জনসংখ্যাগত কাঠামো বদলে দিচ্ছে এবং যারা এর সমালোচনা করছে, তাদের কণ্ঠরোধ করছে।
ইলন মাস্ক ও ভ্যান্স প্রকাশ্যে ইউরোপের কট্টর ডানপন্থি দলগুলোকে সমর্থন করেছেন, যেমন জার্মানির এএফডি। ট্রাম্পের কৌশলপত্রে আরও বলা হয়েছে, ইউরোপের তথাকথিত ‘সভ্যতা ধ্বংস’ ঠেকাতে ইইউ সদস্য দেশগুলোর ভেতরে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য।
ইউরোপের প্রতিক্রিয়া: ট্রাম্পকে লক্ষ্য করে ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও কস্তা বলেন, ‘মতপার্থক্য স্বাভাবিক, কিন্তু ইউরোপের গণতান্ত্রিক জীবনে হস্তক্ষেপ আমরা মেনে নিতে পারি না।’
সাবেক ইইউ শীর্ষ কূটনীতিক জোসেপ বোরেল আরও কঠোর ভাষায় বলেন, এটি ইইউর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক যুদ্ধ ঘোষণা। ট্রাম্প চান একটি বিভক্ত, শ্বেতাঙ্গ-প্রধান ইউরোপ, যা তার নির্দেশ মেনে চলবে।
ন্যাটো ও রাশিয়ার প্রসঙ্গ: ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলপত্রে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, কিছু ইউরোপীয় দেশ ভবিষ্যতে বিশ্বস্ত ন্যাটো সদস্য নাও থাকতে পারে।
ন্যাটো আর অনির্দিষ্টভাবে সম্প্রসারিত হবে না, এ বিভাজনে রাশিয়া খুশি। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সব মিলিয়ে, এ ঘটনাগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্কের একটি বড় ভাঙন নির্দেশ করে। ইউরোপের জন্য সময়টা আরও খারাপ, কারণ—
ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের নেতারা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করেছেন, এ আশঙ্কায় যে, ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপের মত উপেক্ষা করে একটি সমঝোতা চাপিয়ে দেবেন। হোয়াইট হাউস এরই মধ্যে ইউরোপের অবস্থানকে ‘অবাস্তব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে, যা ইউরোপকে নিজের নিরাপত্তা বিষয়ক সিদ্ধান্ত থেকে এক ধরনের কোণঠাসা করে দিচ্ছে।