বিশ্বের কোথাও কোথাও ধাক্কা পড়লেও বাংলাদেশে ক্রমশ বড় হচ্ছে দুর্নীতিবাজদের দুনিয়া। শত-হাজার কোটি টাকা পাচার-দুর্নীতি-কারচুপি-জালিয়াতি এখানে বড় সমস্যা হচ্ছে না। উপরন্তু এটি সম্ভাবনার বিষয়। এতে কিছুটা ছেদ-লুকোচুরি দেখা দেয় বছরখানেক আগে। বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা ব্যক্তিদের অবৈধ টাকা এবং সম্পত্তি যুক্তরাষ্ট্র বাজেয়াপ্ত করবে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ায় কয়েক দিন একটু দম ধরার প্রবণতা দেখা দেয়। এরপর ফের শুরু হয় বিপুল উদ্যমে। রাখঢাকও উঠে যায়। নির্বাচনের পূর্বাপরে তা আরও বেগবান। এর মাঝেই মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী সুখবাতার নিউইয়র্কে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট বাজেয়াপ্তের ঘোষণা দেশে দেশে রাজনৈতিক ব্যক্তি বা আশীর্বাদপুষ্টদের মাঝে একটি কম্পন তৈরি করেছে। নিউইয়র্কের ইউএস ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্টের প্রসিকিউটররা ঘোষণা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র মঙ্গোলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি প্রকল্পের অর্থ দিয়ে কেনা নিউইয়র্ক সিটির বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বাজেয়াপ্ত করতে চাইছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, মামলাটি মঙ্গোলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বাটবোল্ড সুখবাতারের নিউইয়র্কে দুটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ইউনিট সম্পর্কিত, যা ১৪ মিলিয়নে কেনা হয়েছিল। বিজ্ঞপ্তিতে সন্দেহজনক আত্মসাৎ, মানি লন্ডারিং স্কিম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য অবৈধ তহবিল ব্যবহার সম্পর্কে আরও বিশদ বর্ণনা রয়েছে। এতে বলা হয়, অ্যাপার্টমেন্টগুলো কেনা হয়েছিল বেআইনিভাবে মঙ্গোলিয়ার খনির চুক্তির অর্থ দিয়ে। চার মাস পর মঙ্গোলিয়ায় পার্লামেন্ট নির্বাচন। এমন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের এ ভূমিকা মঙ্গোলিয়ার বর্তমান সরকারের জন্যই নয়, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা মঙ্গোলিয়ার জনগণকে আরও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করারও চেষ্টা। ভবিষ্যতে তা দেশে দেশেও সম্প্রসারণ হতে পারে।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এ হাত বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের দিকেও সম্প্রসারণ হচ্ছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য দিল্লিতে নিযুক্ত শীর্ষ মার্কিন কূটনীতিককে ডেকে পাঠিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দেওয়ার এক দিন পর আবারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের দুটি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মন্তব্য করেছে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে দ্বিতীয় দিনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি এবং সংশ্লিষ্ট আইনি পদক্ষেপের ওপরে নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া ভারতের আয়কর বিভাগ তাদের কিছু ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ‘ফ্রিজ’ করে দিয়েছে বলে ভারতের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় কংগ্রেস যে অভিযোগ তুলেছে, তা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র নজর রাখছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার। বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়েও কথা আছে মিলারের। ‘আমরা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চেয়েছিলাম’ মন্তব্য করে বলা হয়, বাংলাদেশে অবাধ, পূর্ণ ও উন্মুক্ত গণতন্ত্রকে আমরা অব্যাহত সমর্থন দিয়ে যাব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আরও দৃঢ় হয়।
একাত্তরের পর এ উপমহাদেশের সকল শাসকগোষ্ঠীকে সময়ে সময়ে ধাপে ধাপে ওলটপালট করে দিয়েছে তারা। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এসবে একটুও কেয়ার করতে নারাজ। আপাতত এর সুফলও পাচ্ছে সরকার। দেশে দেশে জেঁকে বসা কর্তৃত্ববাদী পন্থার সাফল্যকেই মডেল হিসেবে নিয়ে এগোতে আগ্রহী সরকার। কয়েক দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন বাড়ছে। জনগণও তা মেনে নিচ্ছে। ক্ষমতার সব ধরনের বলয় রাজনৈতিকীকরণের মধ্য দিয়ে একনায়কতন্ত্রের উত্থান এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকাসহ বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলেই এখন কম-বেশি প্রতিষ্ঠিত। তা বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশের উদাহরণ ভারতেও।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মোদি ক্ষমতায় আসার পর সংখ্যাগরিষ্ঠবাদকে পুঁজি করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছেন। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি রামমন্দির নির্মাণ করে আধিপত্যশীল সংখ্যাগুরুদের মনও জয় করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠবাদকে উসকে দিয়ে তিনি ভারতীয়দের কাছে জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো ও শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশ যুক্তরাষ্ট্রই গাজায় ইসরায়েলি হামলাকে বৈধতা দিয়েছে; অস্ত্র সরঞ্জামসহ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছে। বৈশ্বিক রাজনীতিতে ক্ষমতার অন্যতম শক্তিশালী চীনেও কর্তৃত্ববাদ। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সফল হয়েই চলছেন সেই ২০১২ সাল থেকে। দীর্ঘ দিন ধরে তার বিরুদ্ধে উইঘুর সংখ্যালঘুদের ওপর অমানবিক নিপীড়ন চালানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। জাতিসংঘ এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। জিনপিং সরকার এসবে কেয়ার করে না। কর্তৃত্ববাদের অন্যতম নজির বিশ্বের আরেক সুপারপাওয়ার রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট পুতিন আবারও ক্ষমতাবান। এবার ইউক্রেনকে পুরোদস্তুর ধূলিসাৎ করে দিতে বদ্ধপরিকর তিনি। পুতিন দেশটির জনগণের কাছে স্থিতিশীলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। পুতিনবিরোধীদের দিয়েও বলিয়ে ছাড়া হচ্ছে তাকে ছাড়া কেবল উন্নয়ন নয়, রাশিয়াকেও চালানো যাবে না। বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদের উত্থান আরও গতি পাওয়ার যাবতীয় নমুনা এখন বিদ্যমান। দেশে দেশে শাসকেরা ক্ষমতার পাটাতন সেভাবেই বসিয়েছেন। যার জেরে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনগণই শাসকের শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের ‘ভাটা’ স্বৈরাচারীকরণের এমন ঢেউ বিশ্বের নিয়তি না পরিণতিÑএ নিয়ে গবেষণা-বিশ্লেষণ চলছে রাজনীতিক-কূটনীতিক-সমরবিদ-শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন সেক্টরে।