দুই যুগ আগে যুক্তরাষ্ট্রে যে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা পৃথিবীকে পাল্টে দিয়েছিল, সেই নাইন-ইলেভেনের ষড়যন্ত্রের দায় স্বীকার করতে রাজি হয়েছেন গুয়ানতানামোর তিন বন্দি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার শর্তে ওই তিনজন আদালতে দোষ স্বীকার করে নিতে সম্মত হয়েছেন। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেছেন তারা।
প্রাক-বিচার চুক্তিতে পৌঁছানো তিন ব্যক্তি হলেন– খালিদ শেখ মোহাম্মদ, ওয়ালিদ মুহাম্মদ সালিহ মুবারক বিন আতাশ এবং মুস্তাফা আহমেদ আদম আল-হাওসাভি। তারা বিনা বিচারে কিউবার গুয়ানতানামো বে’তে মার্কিন নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে বছরের পর বছর ধরে আটক রয়েছেন।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আল-কায়েদার সেই হামলায় নিউ ইয়র্ক, ভার্জিনিয়া ও পেনসিলভেনিয়ায় প্রায় তিন হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এর জের ধরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তান ও ইরাকে শুরু হয় অভিযান।
১৯৪১ সালে হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের পার্ল হারবারে জাপানি হামলার পর ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে সবচেয়ে বড় প্রাণঘাতী হামলার ঘটনা।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের বরাতে বিবিসি লিখেছে, দুই যুগ আগের সেই হামলায় যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের স্বজনদের কাছে কৌঁসুলিরা চিঠি পাঠানোর পর প্রাক-বিচার চুক্তির বিষয়টি প্রকাশ পায়।
প্রধান কৌঁসুলি রিয়ার অ্যাডমিরাল অ্যারন রুঘের চিঠিতে বলা হয়, "মৃত্যুদণ্ডের সম্ভাব্য শাস্তি না দেওয়ার শর্তে অভিযোগপত্রে তালিকাভুক্ত ২,৯৭৬ জনকে হত্যাসহ সব অপরাধের দোষ স্বীকার করতে সম্মত হয়েছেন তিন অভিযুক্ত।”
তাদের বিরুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা, আইন লঙ্ঘন করে হত্যা, উড়োজাহাজ ছিনতাই, সন্ত্রাসবাদসহ নানা অভিযোগ আনা হয়েছে।
টাইমস জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতে তাদের দায় স্বীকার করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অভিযুক্তদের মধ্যে খালিদ শেখ মোহাম্মদ হামলার পরিকল্পনাকারী বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য। হামলাকারীরা যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ ছিনতাই করে নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রতিরক্ষাদপ্তর পেন্টাগনের বাইরে বিধ্বস্ত করে। চতুর্থ বিমানটি পেনসিলভানিয়ার একটি মাঠে বিধ্বস্ত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করা প্রকৌশলী খালিদকে ২০০৩ সালের মার্চে পাকিস্তান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কৌঁসুলিরা বলছেন, উড়োজাহাজ ছিনতাই করে যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পরিকল্পনা আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের কাছে তুলে ধরেছিলেন খালিদ। পরে তিনি কিছু ছিনতাইকারী নিয়োগ ও প্রশিক্ষণে সহায়তা করেছিলেন।
গ্রেপ্তারের পর গুয়ানতানামোর বন্দিশালায় খালিদের ওপর অন্তত ১৮৩ বার ‘ওয়াটারবোর্ডিংয়ের’ মত ‘জিজ্ঞাসাবাদের কৌশল’ প্রয়োগ করা হয়েছিল।
এ পদ্ধতিতে বন্দির মুখ তোয়ালে দিয়ে ঢেকে নাক-মুখের ওপর পানি ঢালা হয়। এর মাধ্যমে তার মনে পানিতে ডুবে মরার আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পরে ওই কৌশল নিষিদ্ধ করে।
প্রধান কৌঁসুলি রুঘ তার চিঠিতে লিখেছেন, তিন আসামির সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে বলে বিষয়টি হালকা হয়ে যাচ্ছে তা মনে করার কিছু নেই। বিচারের জন্য এটি ‘সবচেয়ে ভালো পথ’।
গত সেপ্টেম্বরে খালিদসহ গুয়ানতানামোতে আটক পাঁচজনের এমন একটি চুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল বাইডেন প্রশাসন। তারা মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে নিশ্চয়তা চাইছিলেন যে, তাদের নির্জন কারাবাসে রাখা হবে না এবং ট্রমা চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হবে।
হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ জানিয়েছে, প্রেসিডেন্টের কার্যালয়কে বুধবার নতুন চুক্তির কথা জানানো হয়েছে এবং তারা আলোচনায় কোনো ভূমিকা রাখেনি।
৯/১১ হামলায় নিহত জিম স্মিথের স্ত্রী চুক্তির খবরে ক্ষোভ প্রকাশ করে নিউ ইয়র্ক পোস্টকে বলেন, “এই পশুগুলো আমাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে যা করেছে, তার বিচার আদালতে দেখতে জন্য নিহতদের পরিবারগুলো ২৩ বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে।
"তারা (রাষ্ট্রপক্ষ) আমাদের কাছ থেকে সেই সুযোগ (বিচার পাওয়ার) কেড়ে নিয়েছে। নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের (আসামিদের) সর্বোচ্চ শাস্তিই পাওয়া উচিত।”
অভিযুক্তদের সঙ্গে চুক্তি করায় বাইডেন প্রশাসনকে আক্রমণ করছে রিপাবলিকানরাও।আমেরিকাকে রক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের যে দায়িত্ব সরকারের রয়েছে, এই চুক্তির মাধ্যমে তা প্রতিপালনে সরকার ‘ব্যর্থ হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন সেনেটের বিরোধী দলীয় নেতা মিচ ম্যাককনেল।
তিনি বলেন, “সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সমঝোতার চেয়েও এখানে খারাপ বিষয়টা হল, হেফাজতে থাকার পরও তাদের সঙ্গে সমঝোতা করা হচ্ছে।”