হুমকির মুখে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার শিখ আন্দোলনকারীরা

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৩ আগস্ট ২০২৪, ২১:২৫

কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী শিখ আন্দোলনকারীরা ক্রমাগত হুমকির মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের বিভিন্নভাবে হেনেস্তা করা হচ্ছে বলে রয়টার্সের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে শিখদের জন্য খালিস্তান নামের স্বাধীন একটি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে সরব আছেন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বসবাসরত ভারতীয় বংশদ্ভুত শিখ সম্প্রদায়ের অনেকে।
তেমনই একজন শিখ অধিকার আন্দোলনকারী ভারতীয়-আমেরিকান চিকিৎসক ডা. জাসমিত বেইনস। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার আইন পরিষদে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই নানা ধরণের হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন।
১৯৮৪ সালে পাঞ্জাবের অমৃতসরে শিখদের পবিত্র তীর্থস্থান স্বর্ণমন্দিরে অভিযান চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। তাদের লক্ষ্যস্থল ছিল মন্দিরে অবস্থান নেওয়া সশস্ত্র শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। ওই অভিযানে অনেক মানুষ নিহত হন। তাঁদের মধ্যে তীর্থযাত্রীরাও ছিলেন।
এর চার মাস বাদে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করেন তাঁর দুই শিখ দেহরক্ষী। এরপর রাজধানী নয়াদিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শিখদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। নিহত হন হাজার হাজার শিখ।
এই হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে ঘোষণার জন্য গত বছরের অগাস্টে ক্যালিফোর্নিয়ার আইন পরিষদে প্রস্তাব তোলেন বেইনস আর তা গৃহীত হয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই চার ব্যক্তি তার দপ্তরে এসে তাকে হুমকি দিয়ে যায়। দেখতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মনে হওয়া ওই ব্যক্তিরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “তোমাকে হটানোর জন্য যা যা করা দরকার তাই করবো আমরা।”
বেইনস বলেন, এরপর থেকে তিনি ১০০টিরও বেশি হুমকিমূলক বার্তা পেয়েছেন। তিনি পার্ক করা ট্রাক থেকে কাউকে তার বেকার্সফিল্ডের বাড়ির ছবি তুলতে দেখেছেন এবং তার মেলবক্সের তালাটি বারবার ভাঙা হয়েছিল।
বেইনস তার অফিসের ঘটনাটি স্থানীয় পুলিশকে জানান এবং তার বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য অঙ্গরাজ্য আইনসভার সার্জেন্ট-অ্যাট-আর্মসকে অনুরোধ করেন।
২০২৩ সালের ১৮ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় একটি শিখ মন্দিরের সামনে শিখ আন্দোলনকারী হারদীপ সিং নিজ্জারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দেশটির পার্লামেন্টে জানান, কানাডার গোয়েন্দারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারত সরকারের যোগাযোগ থাকার ‘বিশ্বাসযোগ্য’ তথ্য পেয়েছেন।
এরপর থেকে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী শিখ আন্দোলনকারীরা ক্রমাগত হুমকির মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন।
বেইনস বলেন, সার্জেন্ট-অ্যাট-আর্মস তার বাড়িতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন। তাকে সতর্কতা অবলম্বন করার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
বেইনস বলেন, এফবিআই অক্টোবরে তার অফিসে হুমকির বিষয়ে তার সাথে যোগাযোগ করেছিল।
"আমার জীবন বদলে গেছে," রয়টার্সকে বলেন বেনস।
বেইনস আরও বলেন, হুমকির মুখে পড়ে তিনি একা বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। নিজের সঙ্গে সবসময় নিরাপত্তাকর্মী রাখেন। তিনি খুব হতাশ হয়েই বলেন, তারমতো স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য এমন বন্দী জীবন খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রয়টার্স তিনজন নির্বাচিত মার্কিন কর্মকর্তাসহ ১৯ জন শিখ সম্প্রদায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলেছে। তারা জানিয়েছেন, তারা বা তাদের সংগঠনগুলি গত বছর যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় হুমকি ও হয়রানির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি কানাডায় একজন শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার হত্যা এবং যুক্তরাষ্ট্রে অন্য আরেকজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার হত্যার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার বিষয়ে ফৌজদারি তদন্ত চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হুমকি ধামকি কমেনি।
শিখ সম্প্রদায়ের আন্দোলনকারীরা অনলাইনে হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে।
সাতজন শিখ অধিকারকর্মী রয়টার্সকে বলেছেন, গত বছর এফবিআই বা রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছিল।
এফবিআইয়ের এক কর্মকর্তা রয়টার্স কে বলেন, হুমকির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেলে ব্যুরো এ ধরনের সতর্কতা জারি করে, তবে এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
সাম্প্রতিক আলোচিত এক মামলার প্রতিক্রিয়ায়, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা শিখ কর্মীদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য হুমকির তদন্ত করছে।
২০২৩ সালের জুনে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারে গুরুদুয়ারার বাইরে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী হরদীপ সিং নিজ্জরকে হত্যার ঘটনায় চার ভারতীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে। এদিকে, শিখ নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিখিল গুপ্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। ভারতীয় নাগরিক গুপ্তা নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন এবং বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন।
ভারত নিজ্জর হত্যা এবং পান্নুনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও পরে তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
কানাডায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার সঞ্জয় কুমার ভার্মা জুনে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "নিজ্জর একজন সন্ত্রাসী ছিলেন।”
শিখ আন্দোলনকারীরা রয়টার্সকে যেসব হুমকির কথা বলেছেন তার বেশিরভাগই এক্স-এ বেনামী অ্যাকাউন্ট থেকে এসেছে। বাকিগুলো এসেছে অজ্ঞাত ফোন নম্বর ও বেনামি টেক্সট মেসেজ থেকে।
রয়টার্স এই হুমকির উৎস নির্ধারণ করতে পারেনি।
অন্তত ছয়জন সক্রিয় শিখ কর্মী বলেছেন, হয়রানির পেছনে ভারত সরকার বা তার সমর্থকদের হাত থাকতে পারে।
ভারতের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা মুশকিল। কারণ বেশিরভাগ হুমকিই অজ্ঞতানামা।
পাঞ্জাবভিত্তিক দল খালসা গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সম্পাদক কানওয়ারপাল সিং অভিযোগ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বদনাম ও তাদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে।
মন্তব্যের জন্য রয়টার্সের পক্ষ থেকে ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূতাবাস এবং মোদীর দপ্তরকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি।
শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী ও অন্যান্য অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে হুমকি বা কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফৌজদারি মামলা সম্পর্কিত প্রশ্নে ভারতীয় হাইকমিশনার ভার্মা কোনও ইমেলের জবাব দেননি।
সম্প্রতি রয়টার্সের সঙ্গে এক ফোনালাপে এফবিআই কর্মকর্তারা বলেছেন, শিখ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হুমকির পেছনে ভারত সরকারের হাত আছে কিনা তা তারা নিশ্চিত করতে পারছেন না। কারণ বিদেশি রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন।
খালিস্তান আন্দোলনের সমর্থক শিখ নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুন জানিয়েছেন, অজ্ঞতানামা একাউন্ট থেকে একটি গোষ্ঠী তার হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে বার্তাসহ অনলাইনে সহিংস হুমকি দেওয়া অব্যাহত রেখেছে।
পান্নুনের সংগঠন 'শিখস ফর জাস্টিস'কে ২০১৯ সালে বেআইনি ঘোষণা করে ভারত। পান্নুন এবং অন্যদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কিত অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল, যা তারা অস্বীকার করেছেন।
আরেক শিখ সমাজকর্মী প্রীতপাল সিং এফবিআইয়ের সতর্কবার্তা পাওয়ার পরও তার বাড়িতে নজরদারি চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। এক শিখ নেতার হত্যার বর্ষপূর্তিতে তাকে লক্ষ্যস্থল করার হুমকি দেওয়া হয় অনলাইনে।
ফ্রিডম হাউজের নেট শেনকান এই পরিস্থিতিকে আন্তঃদেশীয় নিপীড়নের একটি গুরুতর ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন। তারা বলেন, একটি রাষ্ট্র বিদেশে সমালোচকদের চুপ করানোর জন্য অবৈধ পদ্ধতি ব্যবহার করছে।
তিনি উল্লেখ করেন যে, ভারত এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কূটনৈতিক ও আইনি পরিণতিকে উপেক্ষা করছে বলে মনে হচ্ছে, যার প্রমাণ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় চলমান বিচার প্রক্রিয়া।
বেইনস রয়টার্সকে বলেছেন, তিনি নিশ্চিত নন যে তিনি ভারত সরকারের দ্বারা আন্তঃদেশীয় দমনপীড়নের শিকার হয়েছেন কিনা।
মে মাসে, ক্যালিফোর্নিয়ার আইন পরিষদে তার প্রবর্তিত একটি বিল পাস হয়েছে। এটা অঙ্গরাজ্য আইন প্রয়োগকারীদের আন্তঃদেশীয় নিপীড়ন শনাক্ত এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করবে।