যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

আফগানিস্তান ইস্যু হলেও গুরুত্ব পাচ্ছেন কি শরণার্থীরা 

ডেস্ক রিপোর্ট
  ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:০০

যুক্তরাষ্ট্রে আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন না নাসরিন (ছদ্মনাম)। ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর সেখান থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে আসেন ২৭ বছরের এই তরুণী।
যুক্তরাষ্ট্রে নাসরিনের ভোটাধিকার নেই। তবে দেশটিতে তাঁর মতো বসবাস করা আফগান শরণার্থীদের পক্ষ থেকে তিনি প্রধান দুই দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর কাছে একটি বার্তা পৌঁছে দিতে চান।
আল–জাজিরাকে নাসরিন বলেন, ‘আমি চাই, তারা আমাদের কথা শুনুক; বিশেষ করে তাঁদের কথা, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে (আফগানিস্তানে বসবাসকালে) কাজ করতেন।’  ‘এবারের নির্বাচন শুধু যুক্তরাষ্ট্রবাসীর জন্যই নয়, আফগানদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।’ নাসরিন (ছদ্মনাম), ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাসকারী আফগান তরুণী
গত ৩০ আগস্ট ছিল আফগানিস্তান থেকে সর্বশেষ মার্কিন সেনা চলে যাওয়ার তৃতীয় বার্ষিকী। এর মধ্য দিয়ে দুই দশক ধরে দেশটিতে মার্কিন সেনা উপস্থিতির অবসান ঘটে। ২০০১ সালে তালেবান সরকারকে উৎখাত করতে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। এতে তালেবান সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলেও দেশটিতে থেকে যায় মার্কিন বাহিনী।  
কিন্তু হুট করে আফগানিস্তান থেকে যেভাবে মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ও তালেবান বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো পুনরায় দেশটির ক্ষমতা দখলে নেয়, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে গভীর রেখাপাত করে গেছে।
এ ঘটনায় ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান উভয় পার্টিই সমালোচিত হয়। বিশেষ করে তালেবান যোদ্ধারা ঝড়ের বেগে অভিযান চালিয়ে পশ্চিমা–সমর্থিত আশরাফ গনি সরকারকে হটানোর পর এবং মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের শেষের কয়েক দিন চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে কাবুল বিমানবন্দরে প্রবেশের চেষ্টা চালানো লোকজনের ভিড়ে যে বোমা হামলা হয়, সেটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। হামলায় ১৭০ আফগানের পাশাপাশি ১৩ মার্কিন সেনা নিহত হন। এমন ঘটনা ঘটার জন্য উভয় দল পরস্পরকে দায়ী করে।
২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (আগামী নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী) তালেবানের সঙ্গে একটি বিতর্কিত চুক্তিতে উপনীত হয়েছিলেন। চুক্তিতে ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব সেনা সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়।
দুই দল, এক বিতর্ক
চুক্তির কয়েক মাস পর ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে যান। জয়ী হন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন। তালেবানের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমার শেষ দিকে আফগানিস্তান থেকে হুড়োহুড়ি করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, দেশটির নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর সেনাসদস্য এবং যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের হয়ে কাজ করার জন্য ঝুঁকিতে পড়ে যাওয়া হাজার হাজার আফগানকে সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়।
২০২১ সালের আগস্টে জোরালো আক্রমণ চালিয়ে তালেবান আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে। ১৫ আগস্ট তালেবান যোদ্ধারা প্রায় বিনা বাধায় রাজধানী কাবুলে প্রবেশ করেন। পরে ৩০ আগস্ট সর্বশেষ মার্কিন সেনাকে নিয়ে কাবুল ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজের শেষ ফ্লাইট। এর মাঝে ২৬ আগস্ট কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফটকের কাছে ওই আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত কর্মকর্তারা আফগানিস্তানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য ট্রাম্প ও বাইডেন উভয়ের প্রশাসনকে দায়ী করে থাকেন। ট্রাম্পকে দায়ী করা হয় তালেবানের পক্ষে যায়—এমন এক চুক্তিতে উপনীত হওয়ার জন্য। আর তালেবানকে থামাতে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী আফগানিস্তান নীতিতে অগ্রসর হওয়ার জন্য দায়ী করা হয় বাইডেন প্রশাসনকে।
প্রাণ বাঁচাতে আফগানদের পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার পথও সীমিত করে দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এ কারণেও তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা হয়। এবারও তিনিই রিপাবলিকান–দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। এদিকে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে বাইডেন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছেন।
দীর্ঘস্থায়ী ব্যর্থতা
আফগানিস্তান এখন তালেবান সরকারের শাসনাধীন। তাদের শাসনামলে হাজারো আফগানকে কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া হবে, তা নিয়ে উভয় দলকেই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এখনো আফগানিস্তানে এমন অনেকে রয়েছেন, যাঁরা তালেবানের আক্রোশের শিকার হতে পারেন। বিশেষ করে, যাঁরা আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী বা যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত সরকারের হয়ে কাজ করেছেন।
এমনকি যাঁরা আফগানিস্তান ছেড়েছেন, তাঁরাও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করছেন। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করার বা নাগরিকত্ব পাওয়ার স্পষ্ট কোনো পথ দেখতে পাচ্ছেন না। আবার অনেকের সামনে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আইনি পথ খুব সংকীর্ণ হয়ে গেছে। কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য বিপজ্জনক সব পথ বেছে নিচ্ছেন।
নাসরিন কাবুলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে দোভাষীর কাজ করতেন। পালিয়ে যাওয়ার পর তিনি স্পেশাল ইমিগ্র্যান্ট ভিসায় (এসআইভি) যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। যেসব আফগান যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে একসময় কাজ করতেন, তাঁদের জন্য এ ভিসার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
আফগানিস্তানে তালেবান আবারও ক্ষমতায় আসার সময় ১৬ বছরের বোনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি উদ্ধার ফ্লাইটে কাবুল থেকে পালিয়ে যান নাজনিন। তিনি তাঁর পুরো নাম প্রকাশ করতে চাননি। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর আশ্রয়ের আবেদন অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু নাজনিন বলেন, আশ্রয় আবেদন অনুমোদন পাওয়ার পর থেকে তিনি উভয় দল থেকেই প্রতিশ্রুতি শুধু ভঙ্গ হতে দেখছেন।
আল–জাজিরাকে নাজনিন বলেন, ‘আমার মনে হয় না, এখানকার রাজনীতিবিদেরা আফগানদের আওয়াজ শুনতে পান।’
নাজনিন বলেন, ‘দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জন্য আমার বার্তা, আপনারা শরণার্থীদের বা আমেরিকানদের বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করছেন না। যেমনটা আমি জানি বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাচ্ছি। আপনাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি নোট করে রাখা হয়েছে।’  
অভিবাসনের অপর্যাপ্ত সুযোগ
‘আফগানস ফর আ বেটার টুমোরো’–এর পরিচালক আরশ আজিজজাদা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর মতো যেসব আফগান আছেন, তাঁরা এবারের নির্বাচনী মৌসুমে একধরনের ‘ক্ষোভ ও হতাশা’ বোধ করছেন। তিনি বলেন, ‘যখন আমরা উভয় প্রার্থীর দিকে তাকাই, আমাদের অস্তিত্বহীন মনে হয়।’
আজিজজাদার সংগঠন থেকে গত তিন বছর ধরে তালেবানের ভয়ে যাঁরা আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসতে চাইছেন, তাঁদের জন্য অভিবাসনের আরও সুযোগ তৈরিতে কাজ করা হচ্ছে। যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে সরাসরি কাজ করেছেন, তাঁদের জন্য স্পেশাল ইমিগ্র্যান্ট ভিসা বাড়ানোসহ যাঁরা ইতিমধ্যে পালিয়ে এসেছেন, তাঁদের জন্য স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমোদন পাওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা।
যদিও এ প্রচেষ্টায় সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে বলে জানান আজিজজাদা। তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আমলে আফগানিস্তান–সম্পর্কিত বিষয়গুলো এমনভাবে দেখা হয়েছে, যেন সেগুলোর সংস্পর্শে যাওয়াও বিপজ্জনক। আর ডেমোক্র্যাটদের এবারের নির্বাচনী প্রচারে আফগানিস্তান বা আফগান শরণার্থীদের নিয়ে এখন পর্যন্ত সামান্যই বলা হয়েছে।’
গত তিন বছরে ১ লাখ ৬০ হাজার আফগানকে যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ডেমোক্র্যাটরা তাঁদের নির্বাচনী প্রচারে আফগান শরণার্থীদের বিষয়টির উল্লেখই করছেন না। আজিজজাদার মতে, অথচ এটিকে ডেমোক্র্যাটদের বিজয় হিসেবেই দেখানো উচিত।
বাইডেন প্রশাসন থেকে স্পেশাল ইমিগ্র্যান্ট ভিসার আবেদনপ্রক্রিয়া আরও উন্নত করা হয়েছে, যা ট্রাম্পের আমলে প্রায় বন্ধ রাখা হয়েছিল।
এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ৬০ হাজার ২৩০ আফগান অভিবাসনপ্রত্যাশী তাঁদের প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দিয়েছেন ও বাকি প্রক্রিয়া শুরু করতে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছেন বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আরও প্রায় ৭৫ হাজার জন আবেদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এরপরও সমালোচকেরা বলছেন, ঝুঁকিতে থাকা আফগানদের জন্য আইনিভাবে যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসনের উপায় এখনো অপর্যাপ্ত।
নাসরিন বলেন, এবারের নির্বাচনী প্রচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হারিয়ে গেছে। সেটা হলো ‘তাঁরা’। তিনি বলেন, ‘এবারের নির্বাচন শুধু আমেরিকানদের জন্য নয়, আফগানদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।’
ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো বে এলাকায় বসবাস করা নাসরিন আরও বলেন, ‘এখানে পালিয়ে আসা আফগান এবং আফগানিস্তানে বসবাস করা আফগান...বিশেষ করে নারীদের জন্য এই নির্বাচন বড় প্রভাব ফেলতে চলেছে।’