যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বনাম বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচন

সারাদেশ জুড়ে চলছে টান টান উত্তেজনা
ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৪০
আপডেট  : ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৩:১৫

নিউইয়র্কে বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচনের ডামাঢোলে ম্লান হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আমেজ। কমিউনিটিতে বইছে ভিন্ন হাওয়া। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর মাত্র ১২দিন বাকি। পাঁচ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচন ঘিরে সারাদেশ জুড়ে চলছে টান টান উত্তেজনা। এ নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী কমালা হ্যারিস ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাদের মাঝে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। এমন সংবাদ চাউর আছে নির্বাচনের ময়দানে। উভয় প্রার্থী এখন চষে বেড়াচ্ছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত।
ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান শিবিরের ভোটার ও সমর্থকরা প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছে যার যার অবস্থান থেকে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অভিবাসী আমেরিকানরাও মাঠে নেমেছে তাদের স্বার্থ ও অস্থিত্বের প্রশ্নে। নির্বাচনের দিনক্ষণ যত ঘনিয়ে আসছে ভোটারদের নির্বাচনমুখী কর্মকান্ড ততই বাড়ছে। যুক্তরাষ্টের আভ্যন্তরীন ও চলমান অস্থির বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মুসলিম অভিবাসীদের জন্য। এসব নিয়ে শুধু আমেরিকানরাই নয় গোটা বিশ্ববাসী রয়েছে ভীষন উদ্বেগ-উৎকন্ঠায়। কে হচ্ছেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট।
এমন একটি সময় নিউইয়র্কের বাংলাদেশী আমেরিকানদের একটি অংশ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচনী প্রচারণায়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এক সপ্তাহ পূর্বে ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে চলছে ভিন্নতর একটি উন্মাদনা।
দু’বছর মেয়াদের ১৯ সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি নির্বাচিত করার জন্য গঠিত হয়েছে দু’টি প্যানেল। অতীতের ধারাবাহিকতায় সম্ভাব্য প্রার্থী ও তাদের সমর্থকগণ বানিয়েছেন নিজ নিজ ভোট ব্যাংক। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে মাসাধিককাল ধরে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদ্বন্দ্বি প্যানেলের প্রার্থী, সমর্থক ও কথিত মুরুব্বিরা। নিবন্ধিত ১৮ সহস্রাধিক ভোটারের দ্বারে দ্বারে এখন ঘুরছেন তারা। গভীর রাতে রবোফোনে ভোটারদের জাগিয়ে তুলে ভোট চাচ্ছেন।
এসব নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করছেন ভোটাররা। নিউইয়র্ক সিটির বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকাগুলো সয়লাব পোষ্টার লিফলেটে। নরসুন্দরখানা, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, গ্রোসারী, রাস্তায় পাশের দেয়াল, ল্যাম্পপোস্ট, গাছপালা সর্বত্রই শোভা পাচ্ছে প্রার্থীদের ছবি সম্বলিত বিভিন্ন আকারের পোষ্টার-ব্যানার। পথচারীদের কৌতুহলের শেষ নেই এসব দৃশ্য দেখে। সভা সমাবেশ চলছে রাজকীয় ধাঁচে। রাস্তায় মিছিল চলছে বিভিন্ন এলাকায়। এমন ভাবে প্রচারণা চলছে যেন সিটির তিন লাখ বাসিন্দার সবাই সোসাইটির ভোটার। যারা ভোটার নয় এমন অনেকে এক প্যানেলের সমাবেশে অ্যাপিটাইজার খেয়ে অন্য প্যানেলের সভায় গিয়ে ডিনার সারছেন।
উভয় প্যানেলই মোটা অংকের অর্থ ব্যয় করছেন নির্বাচনী প্রচারণায়। প্যানেলের কথিত মুরব্বিরা ছক আঁকছেন নানারকম কৌশলের। সমর্থিত প্যানেল বিজয়ী হলে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য অনেকে মোটা অংকের অর্থ বিনিয়োগ করেছেন এমন খবরও আছে বাজারে। নির্বাচনী প্রচারণায় প্যানেলের পক্ষ থেকে এজেন্ডার কথা জানানো হচ্ছে। যার মধ্যে ইহকালের চেয়ে যেমন পরকাল প্রাধান্য পাচ্ছে, তেমনি আমেরিকান হিসেবে এদেশের সুযোগ-সুবিধার চেয়ে বাংলাদেশে কি সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে দেয়া হচ্ছে সেসব বয়ান।
বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচনী প্রচারণার কারণে চাপা পড়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের গুরুত্ব। বাংলাদেশী অভিবাসীরা কোন দল বা প্রার্থীকে ভোট দিবে এবং ভোট দেয়ার প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত কোন আলোচনা নেই কমিউনিটিতে। যারা বিভিন্ন সময় মূলধারার রাজনীতিতে নিজেদের নেতৃত্বের কথা জাহির করেন তাদেরকেও দেখা যাচ্ছে না মূলধারার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়। শুধু প্রেসিডেন্ট নয় হাউজ অব রিপ্রেসেন্টেটিভসের সবগুলো আসন সহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৫ নভেম্বর। নানা কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করছে।
এই নির্বাচনে বাংলাদেশী আমেরিকানরা যদি তাদের নাগরিক শক্তি প্রদর্শন না করতে পারে, অসম্পৃক্ত থেকে যায় নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে তাহলে তারা বরাবরই থেকে যাবে অবহেলিত। বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচনের দিন-তারিখ যুক্তরাষ্টের জাতীয় নির্বাচনের মৌসুমে জুড়ে দেয়া কতোটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। আমেরিকান সমাজে মূলধারার রাজনীতি থেকে নিজেদেরকে শামুকের মতো গুটিয়ে রেখে আর যাই হোক নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যত কল্যাণের দোহাই দেয়া যাবে না। বাংলাদেশী আমেরিকান নতুন প্রজন্ম তাদের অভিভাবকদের দেশীয় স্টাইলের রাজনীতি নির্বাচন নিয়ে নাখোশ। নিউইয়র্ক সিটিতে তিন শতাধিক সংগঠন থাকলেও এসবের সাথে সম্পৃক্তি নেই তাদের।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকুরী এবং অভিবাসন প্রক্রিয়া সহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশী কমিউনিটির কল্যাণ করতে হলে এদেশের মূল স্রোতধারায় থেকেই তা আদায় করতে হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের রয়েছে বড় ধরণের তহবিল। নিউইয়র্ক সিটির ১১৩ বিলিয়ন ডলারের বাজেটের বড় একটি অংশ ব্যয় করা হয় বিভিন্ন কমিউনিটির সেবায়। শুধুমাত্র সঠিক নেতৃত্ব ও পরিকল্পনার অভাবে এসব সুযোগ থেকে বঞ্চিত বাংলাদেশী কমিউনিটি।
এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে কমিউনিটিতে কোন ধরণের সভা সমাবেশ প্রচারণার উদ্যোগ আয়োজন নেই কোথাও। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নিউইয়র্ক সিটির বাংলাদেশীরা ভিন্ন কোন গ্রহের বাসিন্দা। সাধারণ প্রবাসীদের মাঝের এসব নিয়ে রয়েছে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও আঞ্চলিক সংগঠনগুলোতে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সম্প্রীতি বিনষ্টের কারণ বলে মনে করেন তারা। বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচনী প্রতিযোগিতা ঘিরে অতীতে প্রায়ই আইন-আদালত করতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দকে। কমিউনিটির সিংহভাগ সংগঠনের নির্বাচন ও নেতৃত্বের লড়াইয়ে বিরাট অংকের অর্থের অপচয় পরিণত হয়েছে একটি প্রচলিতরীতিতে ।
নেতৃত্ব ও আর্থিক হিসেব-নিকেষের কারণে সংগঠন ভেঙ্গে হচ্ছে খান খান। বাংলাদেশ সোসাইটি বিগত অর্ধ শতাব্দীতে ভালো কোন কাজ করেনি তা বলা যাবে না। তবে আরো অনেক ভালো কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এবারের নির্বাচনে উভয় প্যানেলেই কয়েকজন প্রার্থী আছেন যারা কমিউনিটির কল্যাণে অবদান রাখার যোগ্যতার অধিকারী। এমনকি জানামতে সদিচ্ছাও আছে তাদের। তবে নেতৃত্বের গন্ডীকে করতে হবে আরো প্রসারিত। বাংলাদেশী কমিউনিটি এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভেবেই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় রাজনীতিতে বাড়াতে হবে অংশীদারিত্ব।