মানবিক করিডোর ও ত্রাণ চ্যানেল কি এক?

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২২ মে ২০২৫, ১২:১২


মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি অশান্ত। আরাকান আর্মি ও জান্তা সরকারের মধ্যে চলমান সংঘাতে সেখানকার জনজীবন বিপর্যস্ত।
খাদ্য, ওষুধ ও নিরাপদ আশ্রয়ের তীব্র সংকটে রয়েছে সেখানকার মানুষ।  
বাংলাদেশ রাখাইনের জন্য ‘মানবিক করিডোর’ দিচ্ছে, এমনটি জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। এপ্রিলের শেষের দিকে তিনি বলেন, রাখাইনের জন্য শর্তসাপেক্ষে মানবিক করিডোর দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মতি দিয়েছে।  
এরপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়। এখন অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে আলোচনা হয়নি বরং জাতিসংঘের অনুরোধে সীমান্তে সীমিত সহায়তা পৌঁছাতে ‘ত্রাণ চ্যানেল’ গঠনে সম্মত হয়েছে তারা।
অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বুধবার বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর নিয়ে কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা বা কোনো কথা হয়নি।  
নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, জাতিসংঘ রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে চায়। মানবিক চ্যানেলে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া নিয়েই আলোচনা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
ইউএনডিপির বরাত দিয়ে খলিলুর রহমান বলেন, রাখাইনে ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় খাবার ও ওষুধ না পেয়ে লোকজন আসতে পারে। বাংলাদেশ আশঙ্কা করছে, এমন পরিস্থিতি রাখাইন থেকে আরও মানুষকে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করা হতে পারে।
তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক সংকট বাড়ছে এবং এই পরিপ্রেক্ষিতেই জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ মানবিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে শুরু করে। যেহেতু সংঘাতের কারণে সাহায্য সরবরাহের অন্যান্য সকল পথ বর্তমানে অকার্যকর, তাই বাংলাদেশই এখন একমাত্র সম্ভাব্য বিকল্প।  
‘প্রাথমিকভাবে চিন্তা করা হয়েছিল জাতিসংঘ তার চ্যানেলের মাধ্যমে রাখাইনে সহায়তা বিতরণের ব্যবস্থা করবে এবং মিয়ানমার সীমান্তজুড়ে সহায়তা পৌঁছাতে বাংলাদেশ লজিস্টিক সহায়তা দেবে। বাংলাদেশ মনে করে, রাখাইনে সাহায্য দিলে তা রাজ্যটিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে এবং সেটি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পথ প্রশস্ত করবে। ’
মানবিক করিডোর আর ত্রাণ চ্যানেল কি এক? 
খলিলুর রহমান বলেন, করিডোর হলো জরুরি সময়ে দুর্যোগপূর্ণ জায়গা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা। আমরা এখানে কাউকে সরাচ্ছি না।
তিনি বলেন, আরাকানের যে অবস্থা তাতে সেখানে করিডোরের কোনো প্রয়োজন নেই। করিডোর তৈরি করে সেখানে লোকজন আসা-যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
জাতিসংঘ নিরাপদ মানবিক করিডরের অর্থের সংজ্ঞায় বলেছে–– জরুরি সরবরাহের জন্য একটি প্যাসেজ বা পথ। এমন একটি মানবিক করিডরের মধ্য দিয়ে ত্রাণসামগ্রী মুক্তভাবে সংঘাতময় এলাকায় যেতে পারে।
আর রেডক্রস মানবিক করিডরের সংজ্ঞায় বলেছে, একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত পক্ষগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনুমোদন করা নিরাপদ প্যাসেজ।
নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি) মানবিক করিডোরের বিষয়ে বলছে, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সম্মতিতেই একটি করিডোরে প্রবেশাধিকার ও এর সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।
অন্যদিকে সহজ কথায় ত্রাণ চ্যানেল হলো, এমন একটি বিশেষ ব্যবস্থা বা পথ, যা দিয়ে নিয়ম মেনে ও অনুমতি নিয়ে ত্রাণ (যেমন খাদ্য বা ওষুধ) পাঠানো যায় এমন কোনো দেশে, যেখানে সরাসরি এসব পাঠানো নিষেধ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ইরানের কথা। দেশটি বহুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ইরানের সাধারণ মানুষ যেন ওষুধ ও খাদ্য পায়, সেই উদ্দেশ্যে সুইজারল্যান্ড ২০২০ সালে একটি চ্যানেল চালু করে।  
এই চ্যানেলের নাম ছিল সুইস হিউম্যানিটারিয়ান ট্রেড অ্যারেঞ্জমেন্ট। এর মাধ্যমে সুইস ব্যাংক ও সংস্থাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে ইরানে ওষুধ, খাদ্যদ্রব্য ও চিকিৎসা সামগ্রী পাঠায়।
আবার কাতারে হিউম্যানিটেরিয়ান চ্যানেল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা ইরানের জনগণের জন্য খাদ্য, কৃষি পণ্য, ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য আর্থিক লেনদেনের অনুমতি দেয়।
চুক্তি হয়নি, আছে পূর্বশর্ত
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, রাখাইনে সাহায্য দেওয়ার বিষয়ে এখনো কোনো চুক্তি হয়নি, কারণ এর জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সম্মতি এবং সহায়তা দেওয়ার জন্য বিশ্বের অন্য সব জায়গার মতো এখানেও বেশকিছু পূর্বশর্ত পূরণের প্রয়োজন আছে।  
এর মধ্যে রয়েছে, সহায়তা দাতা এবং গ্রহীতাদের নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকার, সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য না করা, সহায়তাকে সামরিক উদ্দেশে ব্যবহার না করা এবং সশস্ত্র কার্যকলাপ স্থগিত রাখা।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, (সম্ভাব্য চ্যানেলের) পুরো কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ থাকবে জাতিসংঘের, ওপারে নিয়ে যাওয়ার পরে সেখানকার নিরাপত্তা, সবকিছু তাদের দায়িত্ব।
তিনি বলেন, আমাদের দায়িত্ব সীমান্ত পর্যন্ত, সেখানে মাদক পাচার হচ্ছে কি না, অন্য কিছু হচ্ছে কি না, সেটা আমরা দেখব। দুই পক্ষ সম্মত হলে এবং সংঘাত কমলেই শুধু আমরা যাব।
খলিলুর রহমান বলেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যা বলেছেন স্লিপ অফ টাং। সঙ্গে সঙ্গেই সংশোধন করে তিনি পাথওয়ে বলেছেন। সেটা ঠিক বলেছেন এবং করিডরের কথা আর কখনোই তিনি বলেননি
করিডোর রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্বেগ 
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং অন্য কয়েকটি দল মানবিক করিডোর নিয়ে বেশ আগে থেকেই তাদের উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। তারা বলছে, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট এমন বড় সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক আলোচনার বাইরে রেখে গোপনে নেয়া হয়েছে।  
বিএনপির আশঙ্কা, করিডোরের আড়ালে আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে বাংলাদেশ একটি জটিল সংঘাতে জড়িয়ে যেতে পারে।  
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথা হলো, এটি অনেক বড় সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা জড়িত।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও মানবিক করিডোর নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল। দলটি এক বিবৃতিতে জানায়, মানবিক করিডোরের নামে যদি সেনাবাহিনী প্রবেশ করে বা রোহিঙ্গা ঢুকে পড়ে, তবে বাংলাদেশ এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।
করিডোর নিয়ে ঝুঁকি কোথায়
২০২২ সালের মার্চে ইউক্রেন ও রাশিয়া মানবিক করিডোর চালুর বিষয়ে একমত হলেও বাস্তবে তা সীমিত ছিল। করিডোর ব্যবহারের সময়সূচি শেষ মুহূর্তে জানানো হতো, ফলে অনেক বেসামরিক নাগরিক তা ব্যবহার করতে পারেনি।  
বিশেষ করে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলে চেকপোস্টে বাধার সম্মুখীন হয় তারা। করিডোরের অনুমোদন নিয়ে অস্পষ্টতা ও দীর্ঘ অপেক্ষার পাশাপাশি, কোনো কোনো বহর ক্ষেপণাস্ত্র হামলারও শিকার হয়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, মানবিক করিডরের আড়ালে অস্ত্র বা মাদক পাচার হতে পারে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। তারা আরও বলেন, রাখাইনে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে করিডোর স্থাপন করলে বাংলাদেশ অনিচ্ছাকৃতভাবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।  
গবেষক, শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ এক সাক্ষাৎকারে বাংলানিউজকে বলেন, আসলে এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। বাংলাদেশ নীতিগত দিক থেকে বিষয়টি চিন্তা করলে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে হবে।
করিডোর দিলে কারা লাভবান হবে বলে মনে করেন, আরাকান আর্মি, রোহিঙ্গা সম্প্রদায় নাকি মিয়ানমার সরকার- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীরা এবং আরাকান আর্মি।  
এনআরসি বলছে, মানবিক করিডোরের সুরক্ষা ও প্রবেশাধিকার অনেকটা সীমিত থাকে। যে এলাকায় সংঘাত হয়, সেখানে নির্দিষ্ট মানবিক করিডরে নিরাপদে পৌঁছানোও ত্রাণকর্মী ও বেসামরিক নাগরিকদের জন্য অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়।
সূত্র: বাংলানিউজ ২৪.কম