রাখাইনের জন্য 'মানবিক করিডর' নিয়ে অনেক প্রশ্ন, নানা আলোচনা-সমালোচনার মুখে অবশেষে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাখ্যা দিয়েছে। কিন্তু সরকারের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের সন্দেহ-অবিশ্বাস এবং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে সংশয় কাটেনি।
অন্যদিকে, 'মানবিক করিডর' নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম অংশীজন সেনাবাহিনীরও ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, বুধবার (২১ মে) ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, ‘রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে এবং তা বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই হতে হবে।’
যদিও মানবিক করিডর নিয়ে যে আলোচনা চলছে, সেটিকে গুজব বলে উল্লেখ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান।
বুধবার ঢাকায় এক সংবাদসম্মেলন করে মি. রহমান বলেছেন, ‘করিডর নিয়ে সরকার কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেনি এবং বলবেও না। তবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ত্রাণ সরবরাহের একটি 'চ্যানেল বা পাথওয়ে' তৈরির জাতিসংঘের প্রস্তাব বাংলাদেশ বিবেচনা করছে।’
নিরাপত্তা উপদেষ্টার এই বক্তব্যকে অস্পষ্ট বলেই মনে করছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের নেতারা বলছেন, উপদেষ্টার বক্তব্যে শুধু 'কথার বা শব্দের মারপ্যাঁচ' করা হয়েছে।
কারণ তারা মনে করেন, ত্রাণ সরবরাহের চ্যানেল বা পাথওয়ে এবং করিডরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
বিষয়টাকে একইভাবে দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকদের অনেকে। তারা মনে করেন, 'মানবিক করিডর' নিয়ে দেশে এখন সক্রিয় সব দল আপত্তি জানিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য অংশীজনদেরও ভিন্ন বক্তব্য আছে। ফলে এক ধরনের চাপের মুখে সরকারের পক্ষ থেকে কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হলো।
অন্যদিকে, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, অনির্বাচিত ও অরাজনৈতিক সরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে; সেটা তারা করতে পারে না।
সরকারের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলার পেছনে রাজনীতিকদের বক্তব্য হচ্ছে, ত্রাণ সহায়তার জন্য চ্যানেল বা পাথওয়ে, যে শব্দই ব্যবহার করা হোক না কেন, এতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন রয়েছে।
এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনের ঐকমত্য ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কারণ তাদের জবাবদিহিতা নেই, বলছেন রাজনীতিকেরা।
রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। সেখানে এখন দুটি পক্ষ, মিয়ানমার জান্তা সরকার এবং রাখাইনের সশস্ত্র আরাকান আর্মি। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশকে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধের মুখোমুখি করা হচ্ছে বলেও বিএনপির নেতারা মনে করেন।
কেন সন্দেহ, সংশয় কাটেনি বিএনপির
দেশে সক্রিয় সব রাজনৈতিক দলই বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে 'মানবিক করিডর' দেওয়ার বিরোধিতা করে আসছে। এই বিরোধিতার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান দল বিএনপি বেশি সোচ্চার ছিল।
দলটির নেতারা বিভিন্ন সময় প্রকাশ্যেই এ ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছেন। এমনকি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২৩শে এপ্রিল দলের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে গাজা বানানোর চক্রান্ত চলছে।’
এখন এসে সরকার যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট হয়নি বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্য আরও ধোঁয়াশার সৃষ্টি করল। করিডরের বদলে ত্রাণ সহায়তার পাথওয়ে বা চ্যানেল বলা হচ্ছে। এখানে শুধু শব্দের মারপ্যাঁচ করা হয়েছে বলেই তারা মনে করছেন।
তারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের তৎপরতায় বিএনপিতে যে অনেক প্রশ্ন, সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, সরকারের ব্যাখ্যার পরও তা কাটেনি।
উপদেষ্টার এখনকার বক্তব্য অনুযায়ী, চ্যানেল, পাথওয়ে এবং করিডরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই বলেই বিএনপি মনে করে।
দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, তারা এখনো মনে করেন যে বাংলাদেশকে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধের মুখোমুখি করা হচ্ছে।
এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মি. আহমদ বলেন, ‘রাখাইনে ত্রাণ সহায়তার জন্য যখন বাংলাদেশের সীমান্ত ব্যবহার করা হবে, তখন জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন আসবে। কীভাবে সীমান্ত ব্যবহার হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকবেই।’
বিএনপির অন্য একাধিক সূত্র বলছে, সরকারের কারও কারও ব্যক্তিস্বার্থ থেকে এবং দেশের বাইরের কোনো পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সীমান্তে একটা পরিস্থিতির তৈরির চেষ্টা আছে কি না, এ নিয়েও দলটির ভেতরে আলোচনা রয়েছে।
নির্বাচনকে অগ্রাধিকার না দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কেন এ ধরনের বিষয় নিয়ে তৎপর, সেই প্রশ্নও তুলছেন বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ। সরকারের এখতিয়ার নিয়েই প্রশ্ন আছে বিএনপির।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদও বলেন, ‘যেখানে জাতীয় নিরাপত্তার মতো স্পর্শকাতর বিষয় রয়েছে, সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের বাংলাদেশের ভূখণ্ড কোনোভাবেই ব্যবহার করতে দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। এটা তাদের দায়িত্ব হতে পারে না।’
এখন রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে চ্যানেলের কথা বলা হচ্ছে, এ ধরনের একটি প্রস্তাব যে জাতিসংঘ দিয়েছে, তা নিয়েও বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো কথা বলেনি সরকার। ফলে এ ব্যাপারেও ক্ষোভ আছে বিএনপিতে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, বাংলাদেশের সীমান্ত বা ভূখণ্ড অন্য কোনো দেশের জন্য যেভাবেই ব্যবহার করা হোক না কেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য এবং নির্বাচিত সরকার ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার আর কারও নেই।
বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও একটি বক্তব্য কিছুদিন আগে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সরকার এবং রাখাইনের নিয়ন্ত্রণে থাকা আরাকান আর্মি, এই দুটি পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন হবে ত্রাণ সহায়তা পাঠানোর ক্ষেত্রে।
এ প্রসঙ্গ টেনে বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলছেন, মিয়ানমারের জান্তা সরকার কোনো সম্মতি দিচ্ছে না বলে তারা জানেন। সেজন্য জাতিসংঘও এগোচ্ছে না, এরপরও অন্তর্বর্তী সরকার কেন বিবেচনা করার কথা বলছে। এসব ঘটনাপ্রবাহ সন্দেহ, অবিশ্বাস আরও বাড়াচ্ছে বলে তারা মনে করেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
জামায়াতসহ অন্য দলগুলোও বিরােধী অবস্থানে
'মানবিক করিডরের' প্রশ্নে অন্য দলগুলোও আপত্তি জানিয়ে আসছিল। এখন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে তাদের বিএনপির সুরেই কথা বলতে দেখা যাচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ ইসলামি দলগুলো এবং অন্যদিকে বামপন্থি ও উদারপন্থি কোনো দলই সরকারের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্য বা সরকারের ব্যাখ্যা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়।’
তিনি এ-ও বলেন, ‘বাংলাদেশের সীমান্ত বা ভূখণ্ড অন্য কারও ব্যবহারের প্রশ্নে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, এটাই তাদের অবস্থান।’
এমনকি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপিও এ বিষয়টির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সীমান্ত ব্যবহার করে ত্রাণ চ্যানেল বা পাথওয়ে হিসেবে যে ধরনের উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে, তার প্রত্যেকটা বিষয়ে স্বচ্ছতা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোকে আঁধারে রেখে এটা করা যাবে না।’
তিনি মনে করেন, সীমান্ত ব্যবহারের বিষয়টা কীভাবে পরিচালিত হবে, নিরাপত্তার বিষয় কী হবে-এ ধরনের বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য তৈরি করা প্রয়োজন।
বামপন্থি দলগুলোর নেতাদের অনেকে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তারা মনে করেন, সরকার ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা বললেও এখনো কোনো রোডম্যাপ দেয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টার কথা আলোচনায় আছে।
আর এ ধরনের কোনো চিন্তার থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরের কোনো অংশের যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করার বিষয় আছে কি না, এ প্রশ্নও করছেন বামপন্থি নেতারা।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হকে গণমাধ্যমকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবিক করিডর বা ত্রাণ সহায়তার জন্য যে সব চ্যানেল ব্যবহার হয়েছে, তার বেশিরভাগ জায়গাতেই যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ছিল বলে তারা মনে করেন। তিনি গাজা ও ইউক্রেনের উদাহরণ তুলে ধরেন।
যদিও সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা কোনো দিক থেকে কোনো চাপ নেই অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর।
কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, আসলে কোনো প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি সরকারের ব্যাখ্যায়।
ফলে দলগুলো বিষয়টাতে তাদের অবস্থান থেকে সরে আসবে না, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
'নির্বাচিত সরকার থেকেই সিদ্ধান্ত আসতে হবে'
বুধবার ঢাকা সেনানিবাসে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান মানবিক করিডর, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করাসহ সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন।
ওই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে, ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন সেনাপ্রধান। এতে বাহিনীটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা সরাসরি ও ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
সূত্রগুলো জানায়, ওই অনুষ্ঠানে মানবিক করিডর নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে এবং তা বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই হতে হবে।’
একইসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখানে জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। যা করার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই করতে হবে। যা-ই করা হোক না কেন, রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে সেটা হতে হবে।’
মানবিক করিডর নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর মতপার্থক্য হচ্ছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে ও সামাজিক মাধ্যমে এমন আলোচনা চলছে কয়েকদিন ধরে।
এমন পটভূমিতে সেনাবাহিনী প্রধান কথা বললেন সেনাকর্মকর্তাদরে সঙ্গে।
অন্যদিকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, মানবিক সহায়তা নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের কোনো মতপার্থক্য আছে কি না?
এর জবাবে খলিরুল রহমান বলেছিলেন, ‘সেনাপ্রধানের সঙ্গে এ বিষয়ে আমার বিস্তর আলোচনা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই।’
তবে তার এই বক্তব্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন রাজনীতিকদের অনেকে।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, তাদের জানামতে, বাংলাদেশের সীমান্ত ব্যবহার করে রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর বিষয়টিকে সেনাবাহিনী সমর্থন করে না।
মানবিক করিডর এবং চ্যানেলের পার্থক্য কী?
এই দুটোর ক্ষেত্রে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলের নেতারা কোনো পার্থক্য দেখেন না।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকদেরও একই মত। তারাও বলছেন, দেশের ভেতরে বিরোধিতা ও চাপের মুখ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্যে শুধু শব্দের পরিবর্তন করা হয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকারের বক্তব্য অস্বচ্ছ। কারণ বাংলাদেশের সীমান্ত ব্যবহার করে সংঘাতময় রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা যাবে, সেখানে অবশ্যই নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকবে।’
বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান করিডর ও চ্যানেলের মধ্যে পার্থক্য দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘মানবিক করিডর হচ্ছে একটা জরুরি সময়ে দুর্যোগপূর্ণ জায়গা থেকে মানুষকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা। এখানে কাউকে সরানো হচ্ছে না। যেটা করা হচ্ছে তাতে এখানে ত্রাণসামগ্রী ও উপকরণ অন্য রুটে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জাতিসংঘ আমাদের এতটুকু বলেছে, পণ্যটি বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে রাখাইনে নেওয়ার জন্য।’
কিন্তু নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সাবেক কূটনীতিক এবং রাজনীতিবিদরা উপদেষ্টার ওই বক্তব্য মানতে রাজি নন। তারা এ ধরনের বক্তব্যকে অস্বচ্ছ ও অস্পষ্ট বলে বর্ণনা করছেন।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিষয়টা স্পষ্ট না হলে বিতর্ক বাড়বে।
চীন, ভারত কীভাবে নেবে
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেরও স্বার্থ রয়েছে।
বাংলাদেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। সেখানে ভূ-রাজনীতিতে চীনের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
তারা বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে ত্রাণ সহায়তায় বাংলাদেশের সীমান্ত ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হলে চীন ও ভারত সেটাকে কীভাবে নেবে, সেই প্রশ্ন রয়েছে। এক্ষেত্রে একটা ঝুঁকি থাকে।
যদিও উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, কোন পথে, কীভাবে ত্রাণ সহায়তা যেতে পারে, এসব বিষয়ে এখনো আলোচনা হয়নি।
একইসঙ্গে তার বক্তব্য হচ্ছে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত ছাড়া এ ধরনের পদক্ষেপ নেয় না। আর নিরাপত্তা কাউন্সিলে চীন রয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলেন, এমন বক্তব্যের মাধ্যমে উপদেষ্টা বোঝাতে চেয়েছেন যে, ভূ-রাজনীতির কোনো প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়বে না।
কিন্তু তারা এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তারা ঝুঁকি দেখছেন।
মানবিক করিডর নিয়ে বিতর্কের শুরু যেভাবে
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের বাহিনীর সঙ্গে ২০২১ সাল থেকে বিদ্রোহীদের গৃহযুদ্ধ চলছে। এরইমধ্যে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইন রাজ্য নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সশস্ত্র আরাকান আর্মি।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি গত বছরের নভেম্বরে রাখাইন রাজ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে- তাতে মিয়ানমারে দুর্ভিক্ষ আসন্ন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে গত মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে আসেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস।
এরপর প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান মানবিক সহায়তা চ্যানেলের ব্যাপারে প্রথম ধারণা দেন।
তার ওই বক্তব্যের পর গত ২৭শে এপ্রিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'মানবিক প্যাসেজ' দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার 'নীতিগত সিদ্ধান্ত' নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এটুকু আপনাদেরকে বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এটাতে সম্মত। কারণ, মানবিক প্যাসেজ হবে। কিন্তু এটাতে আমাদের কিছু শর্ত আছে, সেটার বিস্তারিততে যাচ্ছি না, সেই শর্তাবলী যদি পালিত হয়, আমরা এটাতে অবশ্যই সহযোগিতা করব, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অবশ্যই।’
তার ওই বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক তৈরি হয় এবং এখনো চলছে সেই বিতর্ক।
সূত্র: বিবিসি