চীনের ‘লগইংক’ ব্যবহারে ওয়াশিংটনের আপত্তি

বাংলাদেশের শুল্ক আলোচনায় শর্তের চাপ

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৭ জুলাই ২০২৫, ১১:৪৮


নিজ দেশের বাণিজ্যকে প্রাধান্য দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গেও দরকষাকষি চলছে। এই আলোচনায় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাড়তে থাকা বাণিজ্য ও সার্বিক সম্পর্ক নিয়ে ঢাকাকে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে ওয়াশিংটন। 
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের তথ্য ব্যবস্থাপনা এবং জাহাজ ট্র্যাকিংয়ে ব্যবহৃত চীনের সফটওয়্যার ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস পাবলিক ইনফরমেশন প্ল্যাটফর্ম (লগইংক) ব্যবহার। চীনের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রেও লাগাম টানার কথা বলেছে দেশটি। দু’দেশের আলোচনার সঙ্গে যুক্ত ঢাকা ও ওয়াশিংটনের একাধিক সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের তথ্য ব্যবস্থাপনা এবং জাহাজ ট্র্যাকিংকে সহজ করতে ২০০৭ সালে চীন লগইংক ব্যবস্থা তৈরি করে। ২০১০ সালে লগইংক উত্তর-পূর্ব এশিয়া লজিস্টিকস ইনফরমেশন সার্ভিস নেটওয়ার্কের (নীল-নেট) সঙ্গে তাদের তথ্য ব্যবস্থা সংযুক্ত করে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা ইউরোপের দেশগুলোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বন্দর এখন লগইংকে যুক্ত।
গত সপ্তাহে তিন দিনব‍্যাপী বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আলোচনা ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে দুই দেশের মধ‍্যে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাণিজ‍্যের গতি-প্রকৃতি কেমন হবে, সেসব বিষয় উপস্থাপন ও যুক্তিতর্ক হয়েছে। বেশ কিছু বিষয়ে দুই দেশ মোটামুটিভাবে একমত হয়েছে। শুল্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ন্যায‍্যতা প্রত‍্যাশা করে। 
তবে কিছু বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে। আবারও দুই দেশ আলোচনায় বসবে।
সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা শুল্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি যুক্তরাষ্ট্র। এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে নিজ দেশের জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুও। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে, ওয়াশিংটন সেসব প্রতিষ্ঠান বা দেশের ওপর যে ধরনের ব্যবস্থা নেবে, ঢাকাকেও একই ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র চীনের লগইংকের বিরুদ্ধে। তারা চায় বাংলাদেশের কোনো বন্দর, বন্দর টার্মিনাল, পরিবহন ব্যবস্থা এবং বাণিজ্যিক জাহাজে যেন এ সফটওয়্যার ব্যবহার না হয়।
আবার যেসব অননুমোদিত পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তার রপ্তানি বা পুনঃরপ্তানি যাতে প্রতিহত করা যায়, বাংলাদেশকে সে রকম ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথাও বলেছে দেশটি। তবে শুধু মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরের শিল্প ও নিরাপত্তা ব্যুরোর (বিআইএস) ছাড়পত্র থাকলে অননুমোদিত পণ্য রপ্তানির সুযোগ থাকবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ উদ্বেগজনক লেনদেন শনাক্ত করার জন্য বিআইএস বা মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত পণ্য সম্পর্কিত শুল্ক এবং লেনদেনের তথ্য যাচাই করবে। সেই সঙ্গে মার্কিন রপ্তানি আইনের লঙ্ঘন প্রতিরোধ এবং মোকাবিলার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করবে। 
বাংলাদেশকে অভ্যন্তরীণ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বলছে যুক্তরাষ্ট্র। যার মাধ্যমে দেওয়ানি ও ফৌজদারি দণ্ড দেওয়া ছাড়াও নিরীক্ষা ও তদন্তের ক্ষমতা জোরদার করতে বলা হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চাইলে দেশটিকে তথ্য বিনিময় ও তদন্তের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক দেশগুলোর দেওয়া সরবরাহ–সফটওয়্যারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা কমাতে হবে। সংবেদনশীল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সম্ভব হলে সরবরাহ ব্যবস্থার স্বচ্ছতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা করতে হবে।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ওয়াশিংটন এক প্রকার আগ্রাসন চালাচ্ছে। সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কোন দেশের সঙ্গে কতটুকু বাণিজ্য করবে, সেটা একান্তই নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যেসব শর্ত টেবিলে রাখছে, তা দেখে মনে হচ্ছে আলোচনা বাংলাদেশের সঙ্গে হলেও তাদের মাথায় ঘুরছে চীন। এই কর্মকর্তা বলেন, অবশ্য এটা এমন ইঙ্গিতও দেয় যে, চীন যেভাবে এগোচ্ছে তাতে মার্কিন আধিপত্য টিকিয়ে রাখা নিয়ে ওয়াশিংটন বেপরোয়া। 
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশকে চীনের থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রয় বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে ওয়াশিংটন। এমনকি বেসামরিক উড়োজাহাজের ক্ষেত্রেও একই শর্ত জুড়ে দিয়েছে তারা। এ ছাড়া সয়াবিন তেল, গম ও তরল গ্যাস বা এলএনজিও যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিনতে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তার সয়াবিন গুদামজাত করতে চায়। তাই একটি যৌথ সাইলো নির্মাণের কথাও জানিয়েছে তারা।
বিশ্লেষকদের মতে, চীন বাংলাদেশের অন্যতম ভালো বন্ধু ও বাণিজ্যিক অংশীদার। বাংলাদেশের আমদানির সিংহভাগই হয়ে থাকে চীন থেকে। দেশটিও বাংলাদেশকে শতভাগ শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানির সুবিধা দিয়েছে। ফলে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক কমিয়ে আনা বাংলাদেশের জন্য সম্ভব নয়, যতক্ষণ না এর বিকল্প তৈরি হয়।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় শুল্কের পাশাপাশি এক প্রকার ভূরাজনৌতিক কৌশল সাজাচ্ছে। এতে ভূকৌশলগত যে বিষয়গুলো রয়েছে, সে বিষয়গুলোর মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের নিরিখে যেগুলো আমাদের প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, সে বিষয়গুলোতেই আমাদের যাওয়া ভালো। এর জন্য প্রয়োজনে জাতীয় প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

মার্কিন শুল্ক নিয়ে সবকিছু জানি না: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে বাংলাদেশের আলোচনার বিষয়ে সবকিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। ফলে এ বিষয়ে মন্তব্য করে কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চান না তিনি। 
গতকাল বুধবার বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জুলাই পুনর্জাগরণ অনুষ্ঠানের মাসব্যাপী ফটোগ্রাফি এবং গ্রাফিতি প্রদর্শনী উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তৌহিদ হোসেন। 
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আসলে আমি কিছু বলতে চাই না। দরকষাকষি এখনও চলমান। এ অবস্থায় এ নিয়ে মন্তব্য করে…। আমি যেহেতু সরকারের মানুষ সরকারের জন্য আমি কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাই না।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টের (গোপনীয়তার চুক্তি) নিয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘নন-ডিসক্লোজার চুক্তি হতেই পারে, এই তথ্যটা আমরা গোপন রাখব। এ ক্ষেত্রে কী হবে না হবে, এটা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় জানে। আমি এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। যেহেতু দরকষাকষি চলছে, দেখি ফলাফল কী দাঁড়ায়।’
সূত্র: সমকাল