আজ মা দিবস

যার ভালোবাসায় ছেদ পড়ে না কোনোকালে

মোরশেদা ইয়াসমিন পিউ
  ১২ মে ২০২৪, ১০:৫৭

পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীতে সবকিছুর পরিবর্তন হলেও বদলায়নি কেবল মায়ের ভালোবাসা। প্রতিটি মা কেবল চায় সন্তানদের বুকে জড়িয়ে রাখতে। সন্তানরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়লেও মায়েরা চায় সন্তানদের মুখগুলো চোখের সামনে রাখতে। তাই তো অসুস্থ মায়েরাও শরীরে শক্তি পায় ছেলে যখন বাড়েতে মাকে দেখতে আসেন। কোন মা হয়তো রোজ ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ দিয়ে দিন গুনতে থাকেন, দূর দেশ থেকে সন্তান ফেরার প্রত্যাশায়। মায়েদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের একটাই প্রত্যাশা ‘সন্তানরা যেন থাকে মায়েদের সানিধ্যে’।
যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে মায়ের ত্যাগ আর ভালোবাসা চির অমলিন। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার গল্পগুলোও যেন একেকটি উপন্যাস। মৃত্যু ছাড়া সে ভালোবাসায় কোনো ছেদ পড়ে না। সময়ের ব্যবধানে অতীতের মায়ের সঙ্গে এ যুগের মায়ের কর্মময় জীবনের কিছুটা পার্থক্য থাকলেও মায়ের ত্যাগ-ভালোবাসা একই রকম। অনেক কষ্টে থেকেও মা কখনো বলতে বা বোঝাতে চান না যে, তার সন্তানেরা তাকে ভালোবাসেন না। কথা হয় কয়েকজন মায়ের সঙ্গে, যারা জীবন সায়াহ্নে এসে উপলব্ধি করছেন, তারা তাদের জীবনের কৈশোর-তারুণ্য-সবটাই উজাড় করে দিয়েছেন সন্তানদের জন্য। এখন স্নেহ ভালোবাসা ছাড়া দেওয়ার কিছু অবশিষ্ট নেই। যান্ত্রিক এই দুনিয়ায় তাই তো মায়ের ভালোবাসা আর স্নেহকে উপেক্ষা করে রেখে গেছেন বৃদ্ধাশ্রমে।  
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ হিতৈষী নিবাসে কথা হয় এক মায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৪ বছর বয়সে। বিয়ের পর স্বামীর সহযোগিতায় পড়াশোনা করি। লেখাপড়া শেষে কলেজে শিক্ষকতা করেছি। নিজের কর্মজীবন—তিন সন্তানকে বড় করা, তাদের লেখাপড়া করিয়ে বড় করতে গিয়ে কখন যে যৌবন ফুরিয়ে বৃদ্ধ হয়েছি, টেরও পাইনি। এখন ছেলেমেয়েরা যে যার কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত। শেষ বয়সে আমিই কেবল পড়ে আছি প্রবীণ নিবাসে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই প্রবীণ বলেন—স্বামীর মৃত্যুর পর একে একে বড় মেয়ে ও দুই ছেলেকে বড় করলাম, বিয়ে দিলাম। মেয়েটা বিয়ের পর আমেরিকায় চলে গেল। সেখান থেকে আগে বছরে দুই-একবার খবর নিলেও কিছুদিন ধরে আর খবর নেয় না। নিজে না খেয়ে যে দুই ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করলাম। দেশের সবচেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করালাম, সেই দুই ছেলে এসে আমাকে এই নিবাসে রেখে গেছে—কথা বলতে বলতে অঝোরে কাঁদেন এই মা। চাপা কষ্ট বুকে চেপে তিনি বলেন, রাতে ঘুম আসে না। তখন নিজেকে খুব একা মনে হয়। ছেলেমেয়েদের মুখ দেখতে ইচ্ছে হয়, ছোটবেলার মতো বুকে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়। নাতি-নাতনিদের জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সেসব শুধুই কল্পনা।
বর্তমান সমাজে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবার গড়ে উঠেছে। যেখানে বাবা-মা ও সন্তানরা থাকেন। তবে বর্তমান সময়ে মায়েদের চ্যালেঞ্জগুলো আরো বেশি বলে জানান একজন মা। তিনি বলেন, আমি যখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন জানলাম স্বামী বিদেশে বিয়ে করেছে। সন্তান পেটে নিয়েই সন্তানকে সুস্থভাবে পৃথিবীতে আনতে পাড়ায় পাড়ায় টিউশনি করিয়েছি। সন্তানের  জন্মের পর একটা চাকরি নিয়েছি, কিন্তু ছেলেকে কোথায় রেখে অফিসে যাব, তেমন কোনো জায়গা নেই। ফলে এক মাসের ব্যবধানে আবার চাকরি ছাড়লাম। পরে গ্রামে ছেলেকে মায়ের কাছে রেখে এসে চাকরি করেছি। ছেলে যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে তখন তাকে নিজের কাছে আনতে পেরেছি।
প্রতিটি মায়ের জীবনের গল্প প্রায় একই রকম। নানান ত্যাগ আর ভালোবাসায় ঘেরা মায়েদের জীবন—আজ মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার বিশ্ব মা দিবস। এই দিবসের উদ্দেশ্য হলো—আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, মা ছাড়া এই পৃথিবীতে আপন নিবাসের ঠিকানা খুবই কম। মায়েদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই এই দিবস। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম শুরু হয় মা দিবসের প্রচলন। যদিও প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের মধ্যেও মাকে সম্মান জানাতে বিশেষ দিবসের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। মা দিবস উদযাপনের পেছনের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, দিবসটির সূচনা হয় ১৯০৮ সালে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার এক স্কুলশিক্ষক অ্যানা জারভিস সেখানকার পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা দেখে মর্মাহত হয়ে মায়ের জন্য বিশেষ দিন পালনের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টির কথা ভেবেছিলেন। অ্যানা জারভিসের সেই ভাবনা বাস্তবায়নের আগেই ১৯০৫ সালের ৯ মে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর মেয়ে অ্যানা এম জারভিস মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণের উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করেন। বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে ১৯০৮ সালে তার মা ফিলাডেলফিয়ার যে গির্জায় উপাসনা করতেন, সেখানে সব মাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মা দিবসের সূচনা করেন। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মায়েদের জন্য উৎসর্গ করে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়।