৩০ শিশুকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে গ্রেফতার

শিক্ষকের ‘ওপরের চেহারা’ আড়ালে ভয়ংকর অপরাধী 

রাজশাহী সংবাদদাতা
  ২৩ মে ২০২৪, ১২:৪১
সিআইডির হাতে গ্রেফতার আবদুল ওয়াকেল (মাঝে)

কে বিশ্বাস করবে, একজন ‘ভালো আচরণের’ শিক্ষককে ৩০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে যৌনাচার ও তার ভিডিও ধারণের অভিযোগে গ্রেফতার করা হতে পারে। যে ক্লাসরুম ও সহকর্মীদের সঙ্গে প্রতিদিনের চলাফেরা, তারা বিষয়টিকে অবিশ্বাস্য-অপ্রত্যাশিত বলছেন বটে; কিন্তু ‘বাইরে থেকে দেখে’ কতজনকে চেনা যায়—সে দ্বিধাও আছে। 
বিষয়টি নিয়ে অধিকারকর্মীরা বলছেন, যারা অনেক বড় ও সিরিয়াল অপরাধে যুক্ত থাকে তাদের ‘দেখলেই চেনা যাবে’ এমন ভাবার কিছু নেই।
গ্রেফতারের পর সবার মুখে এই আলাপ; কীভাবে সম্ভব। ৩০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে রাজশাহী নগরীর একটি ব্যক্তিগত স্কুলের আবদুল ওয়াকেল ওরফে রাসেল নামের এক শিক্ষকের বিকৃত যৌনাচার দ্বিধায় ফেলেছে অভিভাবকদের। সহকর্মী শিক্ষকরা এতই বিভ্রান্তিতে ছিলেন যে, মামলা করা নিয়েও দ্বিধা কাজ করছিল। তবে নিজ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকায় সিআইডির পরামর্শে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
মঙ্গলবার (২১ মে) দুপুরে নগরীর কাটাখালী বাজার সংলগ্ন আশরাফ মেমোরিয়াল মডেল স্কুলে গিয়ে খোঁজ নিলে সহকর্মীরা বলছেন, স্কুলে অভিযুক্ত শিক্ষক আবদুল ওয়াকেল ওরফে রাসেল ‘অমায়িক’ ছিল। সে কারণে প্রথম যখন কৃতকর্ম জানলেন তখন বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্কুলটির এক শিক্ষক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তাকে আমি দুই বছর ধরে দেখছি। যদিও প্রত্যেক মানুষের একটা ব্যক্তি জীবন থাকে। নিজ জীবনে তিনি কেমন, সেটা বলতে পারবো না। তবে স্কুলের সহকর্মী হিসেবে তার কাছ থেকে কখনও বাজে কথাও শুনিনি। আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখে বিষয়টি সম্পর্কে জেনেছি। এটি আমাদের শিক্ষকদের জন্য বিব্রতকর।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্কুলটির এক শিক্ষিকা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্কুলে তার কাজের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। কখনও অতিরিক্ত কথা বলতো না। গণমাধ্যমে বিষয়টি দেখে অবাক হয়েছি।’
ভালোর মধ্যে যে খারাপ, এটা আমরা বুঝতে পারিনি উল্লেখ করে স্কুলটির প্রধান শিক্ষক (মামলার বাদী) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সিআইডির সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করে আমার কাছে নিয়ে এসে তার অপরাধ সম্পর্কে জানায়। তখন আমি বলেছি, যদি এমনটা করে থাকে, তাহলে অবশ্যই অপরাধ করেছে। তাকে আইনের আওতায় এনে যা করার আপনারা করতে পারেন। আমরা তাকে এই প্রতিষ্ঠানে ভালো দেখেই নিয়েছিলাম। যাদের নিয়ে অভিযোগ তারা এই স্কুলের শিক্ষার্থী না। ঘটনাস্থলও এখানে না। আমি জেনেছি, করোনাকালে তালাইমারীতে আমেনা ক্লিনিকের পাশে আইসিটির একটি কোচিংয়ে শিক্ষক থাকাকালে এসব ঘটিয়েছে।’
মামলার প্রসঙ্গে এই প্রধান শিক্ষক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টি সিআইডির সদস্যরা আমাকে বলেছিলেন। সে যেহেতু আমার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ছিল, শিক্ষক হয়ে তার এমন কাজ আমার খারাপ লেগেছে। এজন্য সিআইডির সদস্যরা বলেছিলেন একজনকে তো শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে এগিয়ে আসতে হবে। তাই আমি মামলা করেছিলাম।’
যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্যে রাজশাহীতে ১০ বছরের কম বয়সী ৩০ জন স্কুলছাত্রকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে আবদুল ওয়াকেল (৩৩) নামের ওই শিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গত শনিবার রাজশাহী নগরীর ডাঁশমারী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ওয়াকেল রাজশাহীর কাটাখালী এলাকার আশরাফ মেমোরিয়াল মডেল স্কুলের শিক্ষক।
সিআইডি বলছে, যৌন নির্যাতনের দৃশ্যগুলো ওই শিক্ষক ভিডিও ধারণ করে নিজের মোবাইল, পেনড্রাইভ, কম্পিউটার এবং এক্সটার্নাল হার্ডডিস্কে সংরক্ষণ করতো। এসব ডিজিটাল ডিভাইস থেকে সার্চ ইঞ্জিন গুগল, মাইক্রোসফট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এসব তথ্য পৌঁছে দেয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড অ্যাক্সপ্লয়েট চিলড্রেন (এনসিএমইসি) নামের এক প্রতিষ্ঠানের কাছে। এনসিএমইসি বাংলাদেশে সিআইডিকে এসব তথ্য সরবরাহ করে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
এই যে সহকর্মীদের কাছে ‘ভালো ব্যবহার’, ‘দেখলে এরকম লাগে না’ এসব কথা শোনা যাচ্ছে তার কারণ অসচেতনতা উল্লেখ করে ‘নিজেরা করি’র খুশি কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যখন কোনও ব্যক্তি বড় ধরনের অপরাধে জড়িত, তখন সে নিজেকে আড়াল করতে শেখে আরও চাতুর্যের সঙ্গে। ফলে আশপাশের মানুষের কাছে এসব অপরাধের কথা শোনার পর অবাক লাগে, তারা বিশ্বাস করতে চায় না, বিচারটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রুত এর তদন্ত শেষ করে বিচার হতে হবে।’
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওয়াকেল স্নাতক পড়ার সময় থেকেই ছেলে শিশুদের সঙ্গে বিকৃত যৌনাচারের কথা স্বীকার করেছে। মূলত সে উদ্দেশ্যে কোচিং সেন্টার চালু করেছিল। এ পর্যন্ত ৩০ জন স্কুলছাত্রকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, পেনড্রাইভ এবং কম্পিউটারের একাধিক হার্ডডিস্কে স্কুলছাত্রদের বিপুল পরিমাণ নগ্ন ছবি, ভিডিও এবং চাইল্ড পর্নোগ্রাফির কন্টেন্ট পাওয়া গেছে।