ঘূর্ণিঝড় রিমাল আতঙ্কে উপকূলবাসী

পায়রা-মোংলায় ১০ নম্বর, চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে ৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত

নিজস্ব সংবাদদাতা
  ২৬ মে ২০২৪, ১২:১৮
ফাইল ছবি

ঘূর্ণিঝড় রিমাল প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। তাই পায়রা-মোংলায় ১০ নম্বর, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বন্দরে ৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত তোলা হয়েছে।
রোববার (২৬ মে) এ তথ্য জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
আবহাওয়াবিদ খো. হাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’ উত্তর দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে একই এলাকায় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। এটি আজ সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৬০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে ২৬ মে ২০২৪ সন্ধ্যা/মধ্যরাত নাগাদ মোংলার কাছ দিয়ে সাগর আইল্যান্ড (পশ্চিমবঙ্গ)-খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম করতে পারে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাবে দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটার এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমাল আতঙ্কে উৎকণ্ঠায় রাত কেটেছে উপকূলবাসীর
এদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ ঘূর্ণিঝড় ‘রিমালে’ কারণে শনিবার (২৫ মে) আতঙ্কে-উৎকণ্ঠায় রাত পার করেছেন খুলনাঞ্চলের উপকূলের লাখ লাখ বাসিন্দা।
খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলা, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা ও মোংলা, সাতক্ষীরার শ্যামনগরসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার মানুষ। ঝড়ের খবরে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এসব এলাকার মানুষ।
শনিবার রাতে মোংলা বন্দরে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত ঘোষণার পরে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা এলাকায় আতঙ্ক বাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে এসব উপকূল এলাকায় ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে মাইকিংয়ের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হয়। মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এসব এলাকায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
এদিকে দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ বেড়িবাঁধই দুর্বল। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা, কয়রার ৬৩০ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। আর সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর আওতায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৩৮০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। বারবার বাঁধ ভাঙায় উপকূলবাসী সংকেত পেলেই আতঙ্কে থাকেন।
খুলনা ও সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। আইলার সেই ক্ষত কাটিয়ে ওঠার আগেই ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৪ মে ফণী, একই বছরের ১০ নভেম্বর বুলবুল আঘাত হানে। ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান, ২০২১ সালের ২৬ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। ২০২২ সালের ১২ মে আসনি, এরপর একই বছরের ২৫ অক্টোবর সিত্রাং এবং সর্বশেষ ‘মোখা’ আঘাত হানে। এসব ঘূর্ণিঝড়ের সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় কয়রা, দাকোপ, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন। যার ক্ষত এখনও শুকায়নি। সর্বশেষ উপকূলে ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাত হানার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের অনেক জায়গা দিয়ে চুঁইয়ে পানি ঢুকছে বলে জানা যায়। সুভদ্রাকাটি এলাকার একটি জরাজীর্ণ বাঁধ গভীর রাতে স্বেচ্ছাশ্রমে এলাকাবাসী মেরামত করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সেখানে জিও ব্যাগের ব্যবস্থা করা হয়। আর এলাকাবাসী জিও ব্যাগে মাটি ভরে রাস্তা সংস্কার করেন। যেকোনো সময় দুর্বল বেড়িবাঁধ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে প্লাবিত হতে পারে বিস্তীর্ণ এলাকা। এমন আশঙ্কা নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনির ও বাগেরহাট উপকূলের মানুষ।
কয়রা উপজেলার মদিনাবাদ এলাকার এমদাদুল হক বলেন, ঝড় আসতেছে আঙ্গা কয়রা উপজেলার ৫ নম্বর ইউনিয়নের ২ নম্বর কয়রার খালের গোড়ার আবদ্দার বেড়িবাঁধের অবস্থা খুবই খারাপ। গাঙের জোয়ার বড় হলে বা ঝড় এলে আমরা এলাকাবাসী খুবই চিন্তায় থাকি। জানি না কখন নদী ভেঙে পানি চলে আসে।
কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আছের আলী মোড়ল জানান, তার ইউনিয়নের ঘড়িলাল থেকে চরামুখা খেয়াঘাট, খেয়াঘাট থেকে হলদিবুনিয়া পর্যন্ত বেশি ঝুঁর্কিপূর্ণ।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন বলেন, আমাদের আওতায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৩৮০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। তবে গাবুরায় মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। কিছু জায়গায় সমস্যা রয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সমস্যা হলে সেজন্য কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিভাগ-২) এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, আমার এরিয়ার মধ্যে ৬৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ১০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। এছাড়া তাৎক্ষণিক কোনো সমস্যা হলে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য ৬০৪টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যাতে পরিস্থিতি অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ লোকজন সেখানে আশ্রয় নিতে পারেন। এসব সাইক্লোন শেল্টারে মোট ৩ লাখ ১৫ হাজার ১৮০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এছাড়া ৩টি মুজিব কিল্লায় ৪৩০ জন মানুষ আশ্রয় ও ৫৬০টি গবাদি পশু রাখা যাবে। কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলায় ৫ হাজার ২৮০ জন স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, রিমাল প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। তাই পায়রা-মোংলায় ১০ নম্বর, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বন্দরে ৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত তোলা হয়েছে।