গাজায় যেন কেয়ামত নেমেছে। গাজা এখন এক ভয়াল মৃত্যুপুরী। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলি বাহিনী (আইডিএফ) গাজায় অবিশ্বাস্যমাত্রার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। হামাস নিয়ন্ত্রণাধীন গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা প্রায় ৫৭ হাজার। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল এগনাস ক্যালামার্ড এ গণহত্যাকে ‘লাইভ স্ট্রিমড জেনোসাইড’ বা ‘সরাসরি সম্প্রচারিত গণহত্যা’ হিসাবে অভিহিত করেছেন। গাজা এখন সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপ। ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির সবাই এখন বাস্তুচ্যুত। পৃথিবীতে একটা জনপদে এমন বিপর্যয় সম্ভবত খুব কম এসেছে।
দুর্ভিক্ষকবলিত গাজায় ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে গত সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৭০-৮০ জন ফিলিস্তিনি হত্যার শিকার হয়েছেন। এসবই ‘এইড ম্যাসাকার’ বা ত্রাণ অজুহাতে হত্যাকাণ্ড। ইসরাইল খাদ্য বা অনাহারকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে। জার্মানির এডলফ হিটলার লাখ লাখ ইহুদিকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হত্যা করেছিলেন। তবে তা বেশ গোপনে; কিন্তু গাজায় গণহত্যা চলছে প্রকাশ্যে, মিডিয়ার সামনে, ঘোষণা দিয়ে। পশ্চিমা বিশ্বের শক্তিশালী কিছু দেশ ইসরাইলকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গণহত্যায় সমর্থনও দিচ্ছে। আমি কুয়েত সশস্ত্র বাহিনীতে কয়েক বছর প্রেষণে নিয়োজিত ছিলাম (২০০৮-২০১১)। এ সময় কুয়েত ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণকালে ফিলিস্তিন কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগসহ ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সম্পর্কে জানার কিছু ব্যতিক্রমী সুযোগ হয়। এ লেখায় রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে আমার দেখা কিছু অভিজ্ঞতার নির্যাস।
গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে গাজার স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস আকস্মিকভাবে (অপারেশন আল আকসা ফ্লাড) ইসরাইলের অভ্যন্তরে আক্রমণ করে। এ আক্রমণে প্রায় ১২০০ জন ইসরাইলি নাগরিক নিহত হয়। এ আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ৮ অক্টোবর ইসরাইল যুদ্ধ (অপারেশন সোর্ডস অব আয়রন) ঘোষণা করে। এ আকস্মিক আক্রমণের প্রেক্ষাপটে ইসরাইল যে প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে এবং অদ্যাবধি চলছে, তা অতীতের নিষ্ঠুরতার সব রেকর্ড ও দৃষ্টান্তকে বহুদূর ছাড়িয়ে গেছে। বৃষ্টির মতো বোমা পড়েছে হাসপাতাল, শরণার্থী শিবির, ঘরবাড়ি, স্কুল, মসজিদে। গাজায় এখন আর কোনো কার্যকর অবকাঠামো নেই-শুধু ধ্বংস, মৃত্যু ও আতঙ্ক।
ফিলিস্তিনিদের ‘কালেক্টিভ পানিশমেন্ট’ দেওয়ার জন্য খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বন্ধ করে দিয়ে গাজাকে ‘নয়া কারবালা’ বানিয়েছে ইসরাইল। গাজা সম্পূর্ণ ধ্বংসকরণ কেবল একটি যুদ্ধের ফল নয়, এটি ইসরাইলের একটি দীর্ঘ পরিকল্পিত দমননীতি ও মানবতাবিরোধী অপরাধ।
আমার গাজায় যাওয়া হয়নি। তবে গাজার পার্শ্ববর্তী (মিসরের) সিনাই অঞ্চলে ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে। ২০১০-এর জুনের সকাল। কায়রো থেকে ইসমাইলিয়া হয়ে চলেছি সিনাইয়ের দিকে। ফেরিতে সুয়েজ খাল অতিক্রমের সময় রাফাহ অঞ্চলে কর্মরত মিসরীয় সেনা ও কাস্টমস বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হলো। সুয়েজ খাল পেরিয়ে ১৯৭৩-এর আরব-ইসরাইল যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সিনাই রণাঙ্গনে এসে পৌঁছালাম। সিনাই মরুভূমির মধ্য দিয়ে তৈরি সড়কপথে প্রায় ৫০ কিলোমিটার যাওয়ার পর স্থানীয় ট্যাক্সিচালক আহমদ জানালেন, ‘আরও প্রায় ১৫০ কিলোমিটার গেলেই সিনাইয়ের রাফাহ ক্রসিং’। সেটাই মিসর-গাজা (ফিলিস্তিন)-এর সীমান্ত। গাজা সীমান্ত ইঙ্গিত করে দীর্ঘদেহী আহমেদ আরও বলেন, ‘ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে শরণার্থী হিসাবে মিসরে এসেছিলাম। গাজা আমার জন্মভূমি’।
কায়রো ভ্রমণের একপর্যায়ে ‘বেন এজরা সিনাগগে’ যাই। এটি পুরোনো কায়রোতে অবস্থিত। বর্তমানে এটি আর ফাংশনাল সিনাগগ নয়। এটি এখন মূলত ট্যুরিস্ট সাইট ও ইহুদি জাদুঘর। চারদিকে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ভীতসন্ত্রস্ত একজন ‘রাব্বী’ সিনাগগের ঠিক সামনের স্থানটি দেখিয়ে আমাদের বলেন-‘এখানেই শিশু মোজেসকে (মূসা) পাওয়া গিয়েছিল। নীল নদ তখন এর পাশ দিয়েই প্রবাহিত হতো।’ কায়রোর জাদুঘরে মিসরের প্রায় ৫ হাজার বছরের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে ও দেখতে পেলাম।
কায়রো থেকে কুয়েত এয়ারওয়েজের বিমানটি সিনাইয়ের শার্ম এল শেইখের দিকে উড়ে চলেছে। নিচে লোহিত সাগর। প্রায় ৩ হাজার বছর আগে হজরত মূসা (আ.) মিসর থেকে সাগর (লোহিত সাগর/গ্রেট বিটার লেক/গালফ অব সুয়েজ) পেরিয়ে বনি ইসরাইল গোষ্ঠীকে (ইহুদি সম্প্রদায়) নিয়ে সিনাই গিয়েছিলেন। এটিই বিখ্যাত ‘গণপ্রত্যাবর্তন’ বা ‘এক্সোডাস’। বিখ্যাত মাউন্ট সিনাই বা তুর পাহাড় বাঁয়ে রেখে সিলভার রঙের বিমানটি উড়তে থাকে। মনে পড়ে বিখ্যাত ‘টেন কমান্ডমেন্টস’ (দশ আজ্ঞা) ছবির কথা। আমাদের নিচে এখন সিনাই মরুভূমি। অনুসারীদের নিয়ে হজরত মূসা (আ.) এ সিনাই মরুভূমিতে দীর্ঘদিন ছিলেন। এরপর মূসা নবী তার অনুসারী বনি ইসরাইলিদের (ইহুদি) নিয়ে চলে যান ‘প্রতিশ্রুতি ভূমি’ কেনানের (প্যালেস্টাইন) দিকে।
গাজায় ইসরাইলের গণহত্যার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানির পরিচালিত ‘ইহুদি হলোকস্ট’ বা ‘ইহুদি গণহত্যার’ কথা আলোচিত হচ্ছে। ২০১৮ সালে জার্মানির মিউনিখে এসে কাছের ‘ডাকাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ দেখতে গিয়েছিলাম। ডাকাউ ছিল হিটলারের নির্মিত প্রথম বন্দিশিবির, যেখানে ইহুদিসহ হাজার হাজার বিরোধী রাজনীতিক, ভিন্নমতাবলম্বী ও কমিউনিস্টদের হত্যা করা হয়। মানুষকে হত্যা, নির্যাতনের এমন নিপুণ প্রতিষ্ঠান দেখে মন বিষণ্নতায় ভরে ওঠে।
একপর্যায়ে আমরা দুজন গ্যাস চেম্বারের পাশে এসে দাঁড়াই। ইতিহাস বলে, এ গ্যাস চেম্বারটি বন্দি হত্যায় ব্যবহৃত হয়নি। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের ‘আউসভিৎজ’ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মতো অনেক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে লাখ লাখ ইহুদিকে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। এটি ছিল অকল্পনীয় বর্বরতা।
এর অনেক বছর পর গাজায় মিডিয়ার সামনে সংঘটিত জেনোসাইড বা গণহত্যা মনে করিয়ে দিল জার্মান পরিচালিত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোয় ‘ইহুদি হলোকস্ট’-এর কথা। তবে এখন একেবারে বিপরীত দৃশ্যপট। এবার ‘বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার’ হিসাবে পরিচিত গাজায় ইহুদিদের মতোই নিষ্ঠুর গণহত্যার শিকার হয়েছে ফিলিস্তিনিরা। ‘গণহত্যা বিশেষজ্ঞ’ মিয়ানমারের নাগরিক ‘মুয়াং জার্নি’ গাজার গণহত্যার সঙ্গে আউসভিৎজ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের তুলনা করেছেন। তিনি লিখেছেন ‘এটি আউজভিৎজের পুনরাবৃক্তি’ ও ‘গ্যাস চেম্বার ছাড়া মানুষ হত্যা’।
অস্ট্রিয়ার রাজধানী ঐতিহাসিক নগরী ভিয়েনার ‘সেন্ট্রাল ক্যাফে’ বা ‘ক্যাফে সেন্ট্রাল’। এ ক্যাফেতে এক সময় অনেক বিখ্যাত মানুষ আসতেন, যারা পরে দুনিয়া কাঁপিয়েছেন- হিটলার, ট্রটস্কি, লেনিন, স্ট্যালিন...।
১৮৯৬ সালে বিখ্যাত অট্রো-হাঙ্গেরীয় ইহুদি সাংবাদিক এবং আইনজীবী হার্ৎজেল ‘ডের জুডিনস্ট্যাট’ (ইহুদিদের রাষ্ট্র) নামে ছোট একটি বই লেখেন। বইটির বড় অংশ তিনি ভিয়েনায় থেকে লিখেছিলেন। এ বইটিতে থিওডর হার্ৎজেল তার স্বপ্নের ‘ইহুদি রাষ্ট্রের’ কথা বলেন। ১৮৯৭ সালে তার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম ‘বিশ্ব ইহুদি কংগ্রেস’। থিওডর হার্ৎজেলকে ‘ইহুদি রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্ট্রা’ ও ‘আধ্যাত্মিক পিতা’ বলা হয়। সে সময় ভিয়েনার অনেক লেখক, বুদ্ধিজীবী, সংগীতশিল্পী ও চিত্রশিল্পীদের মতো থিওডর হার্ৎজেলও এ ক্যাফেতে আড্ডা দিতেন।
২০১৮ সালে ভিয়েনার সেন্ট্রাল ক্যাফেতে এসে, অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে থিওডর হার্ৎজেলের কথাও ভাবছিলাম। একটি ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য হার্ৎজেল সারাজীবন স্বপ্ন দেখেছেন ও সংগ্রাম করেছেন। তিনি কি জানতেন তার স্বপ্নের ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ একদিন মধ্যপ্রাচ্যের লাখ লাখ মানুষের জীবন ধ্বংস করবে? হাজার বছর ধরে চরমভাবে নির্যাতিত ইহুদিরা নিজেরাই একদিন হয়ে উঠবে ভয়ংকর গণহত্যাকারী ও অত্যাচারী?
২০১০ সালে কুয়েতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের নিকটবর্তী একটি বিল্ডিংয়ে ‘প্যালেস্টাইন কালচার সেন্টারের’ উদ্যোগে প্যালেস্টাইনিদের ‘হস্তশিল্পের প্রদর্শনীর’ আয়োজন করা হয়েছিল। সেই প্রদর্শনীতে সপরিবারে গিয়ে ফিলিস্তিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। হস্তশিল্পগুলো এসেছিল ফিলিস্তিনের হেবরন, গাজা সিটি, রামাল্লা, নাবলুস, জেনিন ও জর্ডানের ফিলিস্তিনি রিফিউজি ক্যাম্প থেকে।
ফুটফুটে সুন্দর একদল ফিলিস্তিনি শিশুর দল সহজেই আমার শিশুকন্যাকে আপন করে নিয়েছিল। এবারের গাজার গণহত্যায় কমপক্ষে ১৫ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। আমার কন্যার খেলার সঙ্গীদের কথা ভাবছিলাম। এত ধ্বংস, অত্যাচারের মুখেও গাজাবাসী গাজা ছেড়ে যায়নি। অতীতের মতোই হয়তো গাজা আবার ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠবে। গাজায় গণহত্যা ইসরাইলকে সমগ্র বিশ্বের কাছে অপরাধী করে তুলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আরব বিশ্বের ইতিবাচক ভূমিকা ফিলিস্তিন বিষয়ে নতুন আশাবাদ তৈরি করছে। আগামীতে মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত দিক নিয়ে লেখার ইচ্ছা রইল।
গত ১ জুলাই থেকে যুদ্ধবিরতির কথা আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেও গাজায় গণহত্যা চলছে। গত ৮ জুলাই ২৭ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে আইডিএফ। গাজার গণহত্যা এখনই বন্ধ হোক। মানুষের প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা অসহনীয়। ইসরাইলকে গাজায় গণহত্যা এখনই বন্ধ করতে হবে। স্টপ জেনোসাইড ইন গাজা। স্টপ, স্টপ...।
মো. বায়েজিদ সরোয়ার : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, বিশ্লেষক ও গবেষক