কর্নেল গুলজারকে নিজের কবর নিজে খুঁড়তে বাধ্য করা হয়েছিল এবং মৃত্যুর আগে তার চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল

মনিরুল ইসলাম শিপলু
ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৭ আগস্ট ২০২৫, ১৯:২৯


বিডিআর বিদ্রোহের পর কয়েকমাসের মাথায় ২০০৯ সালের ৩ নভেম্বর মেজর রেজাউল করিমকে অপহরণ করা হয়।
মেজর রেজাউল করিমের চোখ টানা ৭/৮ দিন বাঁধা ছিল। ৭ দিন পর্যন্ত সে জানতেই পারেনি যে, সে কোথায় আছে।
৭ দিন পর যখন তার চোখ খোলা হয়, তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা'র হেফাজতে। সে অবাক বিস্ময়ে দেখতে পায়, তার সামনে বসা মানুষটা কর্নেল সালেহ। তার সাথে ছিলেন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস। তিনি ছিলেন সেসময়ের পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েসের আপন ছোটভাই।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়: তিনি ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এর ওপর বোমা হামলার সাথে জড়িত।
এই অভিযোগের জবাবে মেজর রেজাউল করিম বলেন:
- স্যার, এটা খুবই লজ্জাজনক যে, আমার বিরুদ্ধে এরকম একটা অভিযোগ আনা হয়েছে। আমি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ কমান্ডো ট্রেনিং প্রাপ্তদের একজন। আমার আক্রমণে যদি একজন মানুষও মারা না যায়, এটা পুরো বাহিনীর জন্য লজ্জার স্যার। 
তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ আনা হয়েছিলো: তিনি বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানেত কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা নিয়ে সেনা বিদ্রোহের চেষ্টা করেছেন।
ফজলে নূর তাপস এর ওপর আসলে কোন বোমা হামলার ঘটনা ঘটনা ঘটেনি। তার অফিসের একটা এয়ার কন্ডিশন মেশিনে বিস্ফোরন ঘটেছিল। সারা বাংলাদেশে মেজর রেজাউল করিমের সবগুলো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তন্নতন্ন করে খুঁজেও '৬ কোটি টাকা'র খোঁজ পাওয়া যায়নি।
মেজর রেজাউল করিমকে পরবর্তিতে সেনা আইনের নিজস্ব ধারা অনুযায়ী সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে 'অসদাচরণ' করার অপরাধে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
MIST ( Military Institute of Science and Technology), সেনানিয়ন্ত্রিত ইউনিভার্সিটি Bangladesh University of Professionals- এর অধীনে একটা ইন্সটিটিউট। 
যারা আমাকে পার্সোনালি চেনেন, তারা জানেন BUP এর সাথে আমার পার্সোনাল কিছু হিসাবনিকাশ আছে। কিন্ত এই গল্পটা আমার না।
MIST এবং BUP তে বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনীর অফিসার এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা পড়াশোনা করতে আসেন।
পিলখানায় বিদ্রোহ শুরু হবার পর ভেতরে আটকে পড়া আর্মি অফিসাররা বিভিন্ন জায়গায় ফোন দেওয়া শুরু করেন।  এদের মাঝে কেউ কেউ সেসময়ে MIST- তে অধ্যয়নরত ব্যাচমেটদের কল দিতে শুরু করে। এই কল পাওয়া মানুষদের মাঝেই একজন ছিলেন ক্যাপ্টেন সুবায়েল বিন রফিক।
এছাড়া কল পাওয়া আরেকজন ব্যাক্তি ছিলেন র‍্যাব -১ এ কর্মরত মেজর রেজাউল করিম।
MIST- তে অধ্যায়নরত সুবায়েল বিন রফিক আরো কয়েকজন ব্যাচমেটসহ অজ্ঞাত সোর্স থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে পিলখানার দিকে যাবার চেষ্টা করলে সেটা টিভিতে সম্প্রচার করা হয়। এসময় সিনিয়র অফিসাররা তাদের ইমিডিয়েট ফলব্যাক করার নির্দেশ দেন।
র‍্যাবে কর্মরত মেজর রেজাউল করিম এসময় সিনিয়র অফিসারদের জানান, এখনো সুযোগ আছে, যদি অনুমতি দেওয়া হয়, আটকে পড়া অফিসার এবং তাদের পরিবারকে বাঁচানো সম্ভব।
এই আবেদনের জবাবে মেজর রেজাউল করিমকে র‍্যাব থেকে প্রত্যাহার করে মূল বাহিনীতে সংযুক্ত করা হয়।
র‍্যাব কোন প্রকার অভিযান সেদিন চালাতে পারেনি।
ইতিমধ্যে ভারতীয় মিডিয়াতে খবর চলে আসে সেই সময়ের বিডিআর ডিজি শাকিল আহমেদকে মেরে ফেলা হয়েছে। কিন্ত দেশের মিডিয়াতে সেসময় এই খবর চেপে যাওয়া হয়। দেশের সেনা কর্মকর্তাদের বারবার আশ্বস্ত করা হয়... এরকম কিছুই ঘটেনি।
এই সময়ে মোবাইল ফোনের লোকেশন ট্র‍্যাক করে,  ফোন কনভার্সেশন শুনে এবং নানা উপায়ে আর্মি অফিসারদের একজন একজন করে খুঁজে বের করছিল ঘাতকরা। 
অনেক আর্মি অফিসারই ব্যাচমেটদের ফোনে জানাচ্ছিলেন তারা কোথায় লুকিয়ে আছেন। খুব সম্ভবত এটাও সেই আর্মি অফিসারদের খুঁজে বের করতে ব্যবহার করা হচ্ছিল।
শোনা যায়, সেসময় মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স এর কাছে এমন একটা ভিডিও ছিলো, যেটাতে দেখা যায়, কর্ণেল গুলজারকে নিজ কবর খুঁড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। তারপর কর্ণেল গুলজার কে হত্যা করা হয়। কর্ণেল গুলজারকে হত্যার আগে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। জনশ্রুতি আছে মৃত্যুর আগে তার চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল।
সেদিন যে মিলিটারি অফিসারদের হত্যা করা হয়েছিল... তাদেরকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পোস্টিং দিয়ে পিলখানায় নিয়ে আসা হয়েছিল। মূলত এক ধাক্কায় এদের সবাইকে মেরে ফেলাই ছিলো ওদের উদ্দেশ্য।
সেই ভিডিও ক্লিপ পরবর্তীতে র‍্যাব -২ এর জিয়াউল আহসান নিয়ে যায়। হ্যাঁ, এই সেই জেনারেল জিয়া। শেখ হাসিনার কসাই জিয়া।
জেনারেল জিয়া র‍্যাব - ২ এর অফিসে একটা ইন্টারোগেশন সেল খোলে। প্রায় প্রতিদিন দেখা যেত, তারা একজন করে বিডিআর জোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ এর জন্য নিয়ে যাচ্ছে এবং পরে তার লাশ ফেরত দিয়ে যাচ্ছে।
এভাবে জেনারেল জিয়াউল আহসানের হেফাজতে ৪৭ জন বিডিআর জওয়ান মারা যায়। এরা এমন কিছু জানত বা এমন কিছু দেখে ফেলেছিল... যার জন্য তাদের বাঁচিয়ে রাখা শেখ হাসিনা নিরাপদ মনে করেনি।
পরবর্তীতে বিডিআর বিদ্রোহের ৩ জন গুরুত্বপূর্ণ স্বাক্ষী আত্মহত্যা করেন।
এখানে আমি একটা জিনিস এড করতে চাই। আপনাদের যাদের সেই সময়ের পত্রিকাতে এক্সেস আছে... তারা চেক করে দেখতে পারেন।
এই বিদ্রোহের পরের কয়েক সপ্তাহের মাঝে একটা হোটেলে একজন সেনা কর্মকর্তার আত্মহত্যা বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর নিউজ খুব সম্ভবত প্রথম আলোতে এসেছিল এবং একটা হেলিকপ্টার দুর্ঘটনাতেও একাধিক সেনা কর্মকর্তা মারা যান।
আমার ব্যাক্তিগত ধারণা... এই ঘটনাগুলোরও বিডিআর বিদ্রোহের সাথে যোগসূত্র আছে।
বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে তিনটা আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পুলিশের তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন আকন্দ। যে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়। 
বিজিবির তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন আজিজ। যে পরবর্তীতে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পায়।
সেনাবাহিনীর তদন্ত দলের প্রধান ছিলেন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর। 
সেনাবাহিনীর তদন্ত দলের সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ পান ক্যাপ্টেন সুবায়েল বিন রফিক।
তদন্তের এক পর্যায়ে জানা যায়, এই বিদ্রোহের পরিকল্পনা নভেম্বর থেকেই শুরু হয়। আওয়ামী লীগের দুইজন সাংসদের বাসায় এই পুরো পরিকল্পনা করা হয়। আওয়ামী লীগের দুইজন সাংসদ এই পরিকল্পনার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। সেই সাংসদদের একজন এক মিটিং এ পরামর্শ দেন-
- বেশি অফিসার মাইরো না। অফিসার মানুষ। দুই একজন মাইরো। আমরা সামাল দিবো নে।
সেই দুই সাংসদের নাম ছিলো ফজলে নূর তাপস এবং জাহাঙ্গীর কবির নানক।
২০০৯ সালের অক্টোবরের ১৪ তারিখ সেনাবাহিনীর তদন্ত দলের সমন্বয়কারী কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন সুবায়েল বিন রফিককে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে শেখ হাসিনা তদন্ত রিপোর্টটা সুবায়েল বিন রফিক এর মুখের উপর ছুড়ে মারে এবং বলে:
- এগুলা কী আসতেছে রিপোর্ট- এ। কোনো পলিটিক্যাল ফিগারের নাম রিপোর্টে আসা যাবে না। 
১৯ অক্টোবর ক্যাপ্টেন সুবায়েল বিন রফিককে আবারো ডেকে পাঠানো হয়। এসময় শেখ হাসিনা জানতে চান রিপোর্ট কেন এখনো চেঞ্জ করা হয়নি।
ক্যাপ্টেন সুবায়েল বিন রফিক জবাব দেন:
- আমি আমার ভাইয়ের রক্তের সাথে বেঈমানি করতে পারবো না।
এরপর সুবায়েল বিন রফিককে তুলে নিয়ে যাওয়া। তাকে ৩৬১ দিন অজ্ঞাত স্থানে আটক রাখা হয়।
সেই অজ্ঞাত স্থানই বর্তমানের - আয়নাঘর।
মেজর রেজাউল করিম পরবর্তীতে আর কখনোই চাকুরিতে ফিরতে পারেননি। পাঁচ বছর পর যখন তিনি জেল থেকে বের হয়ে আসেন... তার জীবন জাহান্নামে পরিণত করা হয়। তিনি কোথাও চাকরির দরখাস্ত করলে... সেখানে ফোন করে হুমকি দেওয়া হতো। তিনি ব্যবসা করতে গেলে তার পার্টনারকে ফোন করে হুমকি দেওয়া হতো। 
মেজর রেজাউল করিম পরবর্তীতে উবার ড্রাইভার হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করেন। সেখানেও বাঁধার সৃষ্টি হলে তিনি রাজমিস্ত্রীর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা শুরু করেন।
একজন নেভি অফিসারের সন্তান... যে নিজেও একজন আর্মি অফিসার... যে নিজে কমান্ডো ট্রেনিং- এর সর্বোচ্চ ধাপগুলো অতিক্রম করা.... তাকে রাজমিস্ত্রীর কাজ করে টাকা রোজগার করতে হতো।
এরচেয়ে দু:খজনক আর কী হতে পারে?
এরপর সেনাবাহিনীর বাছাই করা অনুগত অফিসাররা র‍্যাবে আসতে থাকেন। জেনারেল জিয়াউল আহসান ছোট্ট আইসবার্গের মাথা মাত্র। এরকম অসংখ্য খুনি অফিসার এখনো সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে আসীন আছেন।
এবং এই র‍্যাব থেকেই পরিকল্পিতভাবে পুলিশের মাঝে কিলিং স্কোয়াড চালু করা হয়। গুম-ক্রসফায়ারের কালচার পুলিশে ভয়াবহ ভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
র‍্যাব-পুলিশ-সেনাবাহিনীকে কীভাবে দানবে পরিণত করা হলো... তা জানতে হলে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সেইসব অফিসারের কাছে আপনাকে যেতে হবে... যাদের বছরের পর বছর প্রমোশন দেওয়া হয়নি। যাদের বিনা দোষে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। যাদের ডাম্পিং পোস্টিং- এ ফেলে রাখা হয়েছে।
আপনার জানা দরকার: ২০০৯ এর পর থেকে অসংখ্য আর্মি অফিসারকে ইসলামিস্ট আখ্যায়িত দিয়ে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে।

আমাদের সামগ্রিক ভাবে দাবি তুলতে হবে:
১. পিলখানা হত্যার সবগুলো তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে।
২. মানবাধিকার লংঘনে জড়িত সব সেনা অফিসারের বিচার করতে হবে।
৩. র‍্যাব ভেংগে দিতে হবে।
৪. দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।
এবং
৫. সেনা কিংবা পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়া প্রত্যেক বিডিআর জওয়ানের মৃত্যুর ঘটনাতেও তদন্ত করতে হবে। 

[তথ্যসূত্র:  ক্যাপ্টেন সুবায়েল এবং মেজর রফিক- এর তৃতীয়মাত্রায় দেওয়া নিজ মুখের বক্তব্য, এবং ব্যাক্তিগত চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা এবং পার্সোনাল সোর্স।]

[তথ্যসূত্র: মনিরুল ইসলাম শিপলুর ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত]