
অবশেষে স্বাক্ষরিত হলো জুলাই জাতীয় সনদ। বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ ২৪টি রাজনৈতিক দল ও জোট এই সনদে স্বাক্ষর করেছে। গণফোরাম স্বাক্ষর করেনি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যবৃন্দ এবং এই কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসও সনদে স্বাক্ষর করেছেন।
যারা এই সনদের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল, সেই জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি। বামধারার কয়েকটি রাজনৈতিক দলও অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি। এগুলো হচ্ছে গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টি (বিএসপি)।
‘জুলাইযোদ্ধাদের’ বিক্ষোভের মুখে শেষ মুহূর্তে সনদের একটি অঙ্গীকারে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। এই পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। পরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, যে সনদটি তৈরি হয়েছে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামতের ভিত্তিতে (কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তিসহ), সেই সনদের কোনও ধারা বা অঙ্গীকারে ন্যূনতম কোনও পরিবর্তন কি ঐকমত্য কমিশন একক সিদ্ধান্তে করতে পারে? এই পরিবর্তন নিয়ে কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়েছে বা তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে, এমন কোনও সংবাদ গণমাধ্যমে আসেনি বা ঐকমত্য কমিশনও এরকমটি জানায়নি। সুতরাং, জুলাইযোদ্ধাদের বা কিছু লোকের বিক্ষোভের মুখে এরকম একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দলিলে ঐকমত্য কমিশন কী করে একক সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিবর্তন আনলো, ভবিষ্যতে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে—যদি না রাজনৈতিক দলগুলো কমিশনের এই সিদ্ধান্তে একমত হয়। আবার একমত হলেও পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে।
ঐকমত্য কমিশন সনদের কোথায় কী পরিবর্তন আনলো এবং কেন আনলো সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে এর প্রেক্ষাপটটা বলা দরকার।
১৭ অক্টোবর শুক্রবার বিকাল ৪ টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা জুলাই সনদ স্বাক্ষর করবেন—এটা পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি। কিন্তু এর আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতেই ‘জুলাইযোদ্ধা’ লেখা একইরকমের টি শার্ট গায়ে সংসদ ভবন এলাকায় জড়ো হন বেশ কিছু লোক। শুক্রবার সকালে সংসদ ভবনের দেয়াল টপকে তারা ঢুকে পড়েন জুলাই সনদ স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানস্থলে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের বের করে দিলে অবস্থান নেন সংসদ ভবনের দক্ষিণ গেটে। নিজেদের দাবির পক্ষে তারা স্লোগান দিতে থাকেন। দিন গড়ানোর সাথে সাথে উত্তপ্ত হতে থাকে সংসদ ভবন এলাকা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বারবার বিক্ষোভকারীদের সরে যাওয়ার অনুরোধ করলেও তারা তাতে সাড়া দেননি। বলেন, তিন দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা সরবেন না। তাদের তিন দফা হলো: জুলাই সনদ সংশোধন, জুলাই শহীদ পরিবার ও আহতদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান। শহীদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের সুরক্ষা ও দায়মুক্তি আইন করে তার বাস্তবায়ন।
এসব দাবিতে আন্দোলনকারীরা বেলা ১২টার দিকে আবারও সংসদের গেট ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে তাদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।
বিক্ষোভকারীরাও ইট-পাটকেল ও জুতা নিক্ষেপ করেন। এ সময় বেশ কয়েকজন আহত হন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে পুলিশ। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ। প্রায় আধা ঘণ্টা চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। একপর্যায়ে অনুষ্ঠানস্থলের একটি তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দেন আন্দোলনকারীরা। ভাঙচুর চালান যানবাহনেও।
সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে মিরপুর রোডেও। এরমধ্যেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ঘোষণা দেন, জুলাইযোদ্ধাদের দাবি মেনে নিয়ে জুলাই সনদের পাঁচ নম্বর অঙ্গীকারে সংশোধন আনা হয়েছে। যেখানে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের আইনগত দায়মুক্তি এবং সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেন, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দল এবং ঐকমত্য কমিশনের কোনো মতপার্থক্য নেই।
স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত জুলাই সনদের ৫ নম্বর অঙ্গীকারটি ছিল এরকম: ‘গণঅভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।’
কিন্তু ‘জুলাইযোদ্ধারা’ এই অঙ্গীকারে সন্তুষ্ট নন। বরং তারা জুলাই অভ্যুত্থানে তাদের কর্মকাণ্ডের আইনগত দায়মুক্তি চান। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঐকমত্য কমিশন ৫ নম্বর অঙ্গীকার সংশোধন করে প্রেসবিজ্ঞপ্তি পাঠায়। সংশোধিত বাক্যটি এরকম: ‘গণঅভ্যুত্থানপূর্ব বাংলাদেশে ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান কালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারকে এবং জুলাই আহতদের রাষ্ট্রীয় বীর, আহত জুলাই বীর যোদ্ধাদের যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান যেমন মাসিক ভাতা, সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ব্যবস্থা এবং শহীদ পরিবার ও আহত বীর যোদ্ধাদের আইনগত দায়মুক্তি, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করব।’
প্রশ্ন হলো, শহীদ পরিবার ও আহত বীর যোদ্ধাদের আইনগত দায়মুক্তি, তাদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ বিক্ষোভের পরে কেন সনদে যুক্ত করতে হলো? মাসের পর মাস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে দায়মুক্তির এই বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি, নাকি উত্থাপিত হলেও এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি?
সনদের অনেক বিষয়েই রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়নি এবং যেসব বিষয়ে দলগুলো একমত হয়নি, সেগুলো সনদে নোট অব ডিসেন্ট আকারে উল্লিখিত রয়েছে। সুতরাং ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ দায়মুক্তির বিষয়টিও যদি আলোচনায় থাকতো এবং এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতো, তাহলে সেটি প্রয়োজনে নোট অব ডিসেন্ট আকারেই উল্লিখ থাকতে পারতো। কিন্তু তার কোনোটিই কেন হয়নি, সেটি বিরাট প্রশ্ন। তার চেয়ে বড় কথা, বিক্ষোভের মুখে তড়িঘড়ি করে ঐকমত্য কমিশন এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে সনদে যুক্ত করলো, তাতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত বলে দাবি করা হলেও পুরো প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকলো।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, জুলাই অভ্যুত্থানে যারা সামনের সারিতে ছিলেন, যারা আহত হয়েছেন এবং যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারগুলো কেন দায়মুক্তি চাচ্ছে? তাদের মনে কোনও ভয় আছে যে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক বা নির্বাচিত সরকার এসে তাদের সুরক্ষা দেবে না বা তাদেরকে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে? এটি কি রাজনৈতিক দলের প্রতি তাদের অনাস্থা নাকি ভয়? যদি তাই হয় তাহলে এই প্রশ্নও উঠবে, জুলাই অভ্যুত্থানে যে রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয় ছিল, তাদের মধ্যে কোনও দল বা জোট যদি নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে, তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিক থাকবে? নাকি এটিও নব্বইয়ের এরশাদের পতনের সময় তিন জোটের রূপরেখার মতোই একটি গুরুত্বহীন রাজনৈতিক দলিলে পরিণত হবে?
সংবিধান, আইসভা, বিচার বিভাগ, পুলিশ, প্রশাসনসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য জুলাই সনদে ৮৪টি বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে ৩৭টি বিষয় সরাসরি সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে পরবর্তী সংসদে। বাকি ৪৭টি প্রস্তাব আইন, বিধি ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে।
কিন্তু দিন শেষে এটিও মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্র হচ্ছে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। অতএব রাজনীতিবিদরা যা বলবেন, যেভাবে বলবেন, দেশটা সেভাবেই চলবে।
অনির্বাচিত সরকার যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তারা ক্ষণস্থায়ী। সুতরাং, একটি অনির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট যে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলো, এর পরিণতি কী হবে, তা এখনই বলা কঠিন।
তবে এই সনদে এমন অনেক প্রস্তাব রয়েছে যা বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্র বিকশিত হবে। যেমন, ডেপুটি স্পিকার এবং সংসদের গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটিগুলো বিরোধী দল থেকে নিয়োগ; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল ও আস্থাবিল ছাড়া যেকোনও বিষয়ে সংসদে এমপিদের কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ফিরিয়ে আনা ইত্যাদি। পক্ষান্তরে এমনও অনেক প্রস্তাব এই সনদে রয়েছে যেগুলো এখনই বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় বাস্তবসম্মত কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
সব মিলয়ে যে জুলাই সনদটি স্বাক্ষরিত হলো, সেটি নিয়ে আলোচনা এখানেই শেষ—এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই। বরং আগামী দিনের রাজনীতিতে এই সনদ আরও বহুদিন আলোচিত হবে এবং অনেক রাজনৈতিক সংকটের সমাধান যেমন এই সনদের মধ্য দিয়ে হতে পারে, তেমনি নতুন কিছু সংকটেরও জন্ম হতে পারে। কিন্তু তার সব সমাধানই হতে হবে রাজনৈতিকভাবে। মনে রাখতে হবে, যে অসুখের সমাধান অস্ত্রোপচার, সেটি প্যারাসিটামলে সারবে না।
লেখক: সাংবাদিক
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন