
গত ৮ অক্টোবর ২০২৫, শরতের শান্ত এক সকালে রাওয়ার হেলমেট হলে, ‘রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস ওয়েলফেয়ার অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন’ (রাওয়া) অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির ওপর একটি মুক্ত আলোচনার (সমস্যা সংকুল পার্বত্য চট্টগ্রাম : শান্তির অন্বেষণ) আয়োজন করে।
লেখক হুমায়ুন আজাদ, ১৯৯৭ সালে লেখেন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম : সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝর্ণাধারা’। এ সবুজ পাহাড়ে ‘হিংসার ঝরনাধারাটিকে’ কীভাবে সৌহার্দ ও সম্প্রীতির ধারায় রূপান্তরিত করা যায়-বক্তারা মুক্ত আলোচনায় সেসব কথাই বলেছেন। এ লেখায় মুক্ত আলোচনার মূল বিষয়গুলো তুলে ধরছি।
খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সহিংসতা : খাগড়াছড়ি শহরে উত্তেজনা শুরু হয় ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ থেকে। আগের দিন অর্থাৎ ২৩ সেপ্টেম্বর, রাত ৯টার দিকে বাড়ি ফেরার পথে স্কুলছাত্রী এক মারমা কিশোরী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
ওই দিন রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় ধানখেত থেকে তাকে উদ্ধার করে স্বজনরা। কিশোরীটির বাবা মামলা করার পর, এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয় পুলিশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় একজন বাঙালি তরুণকে (শয়ন শীল) গ্রেফতার করে।
ধর্ষণের অভিযোগে একজনকে আটকের পর অন্য অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে ‘জুম্ম-ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে পাহাড়ি ছাত্র-তরুণরা খাগড়াছড়িতে আন্দোলন শুরু করে। ২৭ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি শহরে একপর্যায়ে পাহাড়ি-বাঙালির মুখোমুখি অবস্থানে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
তবে ২৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলায় পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। সেখানে ১৪৪ ধারা ভেঙে পাহাড়িদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ রূপ নেয় প্রাণঘাতী সংঘাতে। সেনাবাহিনী ও পাহাড়ি তরুণদের মধ্যে ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেদিন গুইমারায় গুলিতে ৩ জন মারমা তরুণ নিহত হয়। এটি ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। অবরোধ চলাকালে পাহাড়ি ছাত্র-তরুণরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অত্যন্ত আপত্তিকর স্লোগান দেয়।
একপর্যায়ে গুইমারার রামসু বাজারে হামলা-অগ্নিসংযোগে পুড়ে ছাই হয়ে যায় প্রায় অর্ধশতাধিক দোকানপাট ও ৩০টির মতো বসতঘর।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর, খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠা স্কুল শিক্ষার্থীর চিকিৎসার পরীক্ষার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে মেডিকেল বোর্ড। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে-‘ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি’।
সমস্যা সংকুল পার্বত্য চট্টগ্রাম: শান্তির অন্বেষণ: পাহাড়ের এমন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মতকর্তাদের সংগঠন ‘রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ (রাওয়া) গত ৮ অক্টোবর ‘সমস্যা সংকুল পার্বত্য চট্টগ্রাম : শান্তির অন্বেষণ’ শীর্ষক একটি মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার উপস্থিতিতে, এ সভায় অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক, গবেষক, অ্যাক্টিভিস্ট ও অন্য ব্যক্তিরা অংশ নেন।
অনুষ্ঠানের সভাপতি, রাওয়ার চেয়ারম্যান ও লেখক-গবেষক কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হকের (অব.) সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আলোচনা। কর্নেল হক বলেন, ‘রাওয়া মূলত একটি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন হলেও জাতির বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ আলোকেই আজকে এমন আয়োজন’।
তিনি আরও বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪০০ জনের মতো সেনাসদস্য শহীদ হয়েছেন। এটি কোনো নতুন সমস্যা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা দীর্ঘদিনের। শান্তি প্রতিষ্ঠা ছাড়া সে অংশটুকু বাংলাদেশের ভবিষ্যতে রাখা যাবে কিনা, সন্দেহ আছে। আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, দেশের শত্র“দের চক্রান্ত, তারা করতেই থাকবে, ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু তা থেকে রক্ষার জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হলো আমাদের জাতীয় ঐক্য। দল, মত, বর্ণ, নির্বিশেষে সবাইকে একত্রিত হতে হবে’।
পাহাড়ের জন্য ভ্যাটেরানদের ভাবনা : অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (অব.)। তিনি বলেন, এখানে যে সমস্যা, সেটির কারণ এর সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারত জড়িয়ে গেছে। তবে আমরা যদি দেশপ্রেমকে ধরে রাখি, তাহলে কোনো সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সমরনীতির ক্ষেত্রে স্থায়ী কোনো বন্ধু ও শত্র“ বলে কিছু নেই।
একমাত্র স্থায়ী হলো নিজ দেশের স্বার্থ। মেজর জেনারেল মোহাম্মদ কামরুজ্জামান আরও বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন যতই থাকুক, পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিঃশত্র“র মোকাবিলা ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাতিগত ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই...। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটি রাজনৈতিক সমস্যা, সামরিক সমস্যা নয়। সেভাবেই এর সমাধান করতে হবে’।
এ মুক্ত আলোচনায় মোট ২২ বক্তার মধ্যে ১৬ জন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা কথা বলেন। এদের অনেকেই বিভিন্ন সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘কাউন্টার ইনসারজেন্সি’ অভিযানে অংশ নিয়েছেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা পার্বত্য চট্টগ্রামে যৌবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় উৎসর্গ করেছেন দেশের অখণ্ডতা রক্ষায়।
এ সব ভ্যাটেরানদের বক্তৃতায় উঠে আসে: পাহাড়ের যুদ্ধকালীন দিনগুলোর কথা, ভারতের ষড়যন্ত্র, পাহাড়ে সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দৃঢ় উচ্চারণ, দেশের অখণ্ডতা রক্ষার্থে প্রাণ বিসর্জনের অঙ্গীকার, শান্তিচুক্তি পুনর্মূল্যায়ন, পাহাড়ের মানুষের জন্য মমত্ববোধ, দরদ এবং পাহাড়ি-বাঙালির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও মৈত্রী...। এ অনুষ্ঠানে পাহাড়ের যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনপূর্বক খেতাব অর্জনকারী অসম সাহসি ৩ জন অবসরপ্রাপ্ত বীর সেনা কর্মকর্তা বক্তব্য রাখেন। এরা হলেন-লে. কর্নেল সিরাজুল ইসলাম, বীর প্রতীক (বার), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান, বীর বিক্রম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুব আহমেদ জাকারিয়া, বীর প্রতীক।
পাহাড়ের সহিংসতা ও আঞ্চলিক দলগুলোর কার্যক্রম: অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন বক্তা উল্লেখ করেন, কিছু উগ্রপন্থি আঞ্চলিক দল বিভিন্ন স্থানীয় ইস্যু কাজে লাগিয়ে পাহাড়ে সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়াচ্ছে। বিশেষত, এবারের ঘটনার নেপথ্যে আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফের ইন্ধনের সমালোচনা করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন চাকরি করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লে. জেনারেল আবু তৈয়ব মোহাম্মদ জহিরুল আলম (অব.) বলেন, ‘একটি পক্ষ পাহাড়ে সেনাবাহিনীকে ভিলেন বানানোর চেষ্টা করছে। পাহাড়ি তরুণদের ভেতর উগ্রবাদের বিকাশ (ইয়ূথ রেডিকালাইজেশন) ও ঘৃণা ছড়ানোর (হেট মনগারিং) ঘটনা ঘটছে, যা সতর্কতার সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। পাহাড়ে তরুণদের জন্য ব্যাপক কর্মস্থান করতে হবে। পাহাড়ে ভূমি সমস্যার সমাধান করতে হবে’।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে ভারতের ইন্ধন : ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার নেপথ্যে রয়েছে ভারত’- এ বিষয়টি বেশ কয়েকজন বক্তা উল্লেখ করেছেন। তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভারতীয় আগ্রাসন রুখতে হবে। এজন্য সবার মধ্যে ঐক্য প্রয়োজন। একইসঙ্গে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে বাংলাদেশের বিশেষ ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার সমালোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে, ‘দৈনিক আমার দেশ’-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আগ্রাসনটা কার কাছ থেকে আসছে? আগ্রাসনটা আসছে ভারতের কাছ থেকে। শান্তিবাহিনী তো তৈরি হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের সময়; কিন্তু ১৯৭৬ সালের আগ পর্যন্ত তারা তো বাংলাদেশে আক্রমণ করেনি। তার মানে হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশে তার এগ্রেশন জিইয়ে রাখার জন্য একটা অস্ত্র হাতে রেখেছে। সেই অস্ত্র সময় সুযোগমতো তারা ব্যবহার করছে’।
দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক, নজরুল গবেষক, কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা তৈরি করা এবং এ সমস্যাকে জিইয়ে রাখা, সবকিছুর জন্য একটা মাত্র রাষ্ট্র দায়ী, সেটি হচ্ছে ভারত। বাকিরা হয়তো ছোটখাটো ভূমিকা রেখেছে।’
অপরিকল্পিত পদক্ষেপের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্তি দূর করা যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘কেন ভারতকে বলে দেওয়া যায় না যে, প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। এ কথা বলতে লজ্জা কিসের...। পাহাড়ে অনেক বাঙালি হত্যার শিকার হয়েছে। বাঙালির জন্য কেউই চোখের পানি ফেলেনি। কোনো এনজিও বাঙালিদের পাশে কখনো দাঁড়ায়নি’।
সেনাবাহিনীর অবদান ও বর্তমান আভিযানিক কর্মকাণ্ড: অনুষ্ঠানে বক্তারা পাহাড়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসাধারণ অর্জন ও অবদানের কথা উল্লেখ করেন। তারা বলেন, বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে পাহাড়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি থাকতে হবে। উগ্রপন্থি ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে যথাযথ অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
বিএনপির চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ‘ফাউন্ডেশন ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস’-এর প্রধান মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর (অব.) বলেন, ‘সেনাবাহিনীর গাড়িতে ইট নিক্ষেপ, বিজিবির সৈনিককে আঘাত করা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘অপারেশনাল এলাকা’ ঘোষণা করা যেতে পারে।’ তিনি খুব কাছ থেকে দেখা, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন।
বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহেদুল আনাম খান (অব.) বলেন, “পাহাড়ে সেনাবাহিনীর ‘পুলিশিং’ ভূমিকা নয়, প্রয়োজন আভিযানিক কার্যক্রম। সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনীয় আভিযানিক কার্যক্রমে বাধা দেওয়া যাবে না।” সাংবাদিক ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক গবেষক মেহেদী হাসান পলাশ বলেন, ‘পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।’
পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে ‘বাংলাদেশ আর্মি’র উল্লেখ করে অবসরপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘আমি ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে সাত বছর ফ্লাইং করেছি। দেখেছি, বাংলাদেশ আর্মি পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বজায় রাখতে কত প্রাণ দিয়েছে, সে কারণে এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি অংশ হিসাবে রয়েছে। অনেকেই অনেক কথা বলবেন-পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চাই, আর্মির উপস্থিতি চাই না। কিন্তু সেনাবাহিনীর কারণেই সেখানে সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা এখনো বজায় রয়েছে।’
দীর্ঘদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে আভিযানিক দায়িত্ব পালনকারী কর্নেল জয়নুল আবেদিন (অব.) বলেন, ‘পাহাড়ে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ ও কার্যকর হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত মোকাবিলায় সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে সেখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বাড়াতে হবে। গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়াতে হবে।’
সভায় দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় শহীদ সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যদের তালিকা প্রকাশের দাবি জানান ‘আমার দেশ’-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কতজন সেনাসদস্য চট্টগ্রামে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন, তাদের নাম জাতির জানা দরকার। এটি করতে পারলে জনগণ সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়াবে।’ যুগান্তর সম্পাদক কবি আবদুল হাই বলেন, ‘মাছের জন্য যেমন পানি দরকার, সেনাবাহিনীর জন্য জনসমর্থন দরকার।’
পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতি: সভায় পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বিশেষভাবে আলোচিত হয়। কোনো কোনো বক্তা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সহিংসতার জন্য গুজব ও অপপ্রচারকে দায়ী করেন।
পাহাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ানোর বিষয়ে ‘আমার দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, এখানে যারা বসবাস করছেন, নিজেদের মধ্যে মেলামেশা দরকার। এখানে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করতে হবে, যেখানে সমতল ও পাহাড়ের মানুষ থাকবে। রাওয়ার চেয়ারম্যান কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুল হক বলেন, ‘পাহাড়ে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও ঐক্য অপরিহার্য। একইসঙ্গে সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে শুধু প্রশাসনিকভাবে নয়; বরং মানবিক ও জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে।’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আল ইউসুফ (অব.) বলেন, ‘পাহাড়ে সাধারণ পাহাড়ি এবং বাঙালির মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক বিরোধ নেই।’ তিনি সবিস্তারে উল্লেখ করেন, কীভাবে ২০০৭ সালে মাটিরাঙ্গা এলাকায় পাহাড়ে প্রথম ‘মোবাইল ব্লাড ব্যাংকে’র কনসেপ্ট চালু করে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে পারস্পরিক রক্তদান কর্মসূচির মাধ্যমে পরস্পরকে বেঁধে ছিলেন রক্তের বাঁধনে। দৈনিক যুগান্তর সম্পাদক ও কবি আবদুল হাই বলেন, ‘পাহাড়ের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের বৃহত্তর মানুষের মিতালী করতে হবে।’
শান্তিচুক্তি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ: সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও ‘ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেটস অ্যাসোসিয়েশন’ (অরকা) সভাপতি মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার (অব.) বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে তেমন নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারেনি। তা গড়ে তুলতে হবে। শান্তি চুক্তির সব ধারা যদি কার্যকর হতো, তাহলে পাহাড়ের সমস্যা অনেক কমে যেত। শান্তিচুক্তির এ ধারায় সমস্যা রয়েছে, সাংবিধানিক সাংঘর্ষিকতাও রয়েছে। আমি মনে করি, শান্তি চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন বা পুনর্বিবেচনা একান্তই প্রয়োজন। এটা সময়োপযোগী পুনর্মূল্যায়ন না করা গেলে পাহাড়ের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়।’
১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টায়, রাঙামাটি ডিসি অফিসে শতশত মানুষের উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিলেন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের ছাত্র-তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মণীষ দেওয়ান।
এ অনুষ্ঠানে কর্নেল মণীষ দেওয়ান বলেন, ‘এটি একটি রাজনৈতিক সমস্যা, তাই সেভাবেই তা সমাধান করতে হবে। পাহাড়িদের কাছে শান্তিচুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শান্তি চুক্তিতে কিছু আপত্তিজনক ও বিতর্কিত বিষয় রয়েছে, সেগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। এ সমস্যা সমাধানের জন্য আগামীতে একজন সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে জাতীয় কমিটি গঠন করা যেতে পারে। যারা পাহাড়ের সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে পাহাড়ের সমস্যা সমাধানের সুপারিশ করবেন।’
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তুষার কান্তি চাকমা বলেন, ‘পাহাড়ের কোথাও দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তা যেন না ছড়ায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। রাজনৈতিক ও কমিউনিটি নেতারা সচেতন থাকায় রাঙামাটিতে এবার এ সংঘাত ছড়াতে পারেননি।’ অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল উকান থিন বলেন, ‘পাহাড়ের ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখাতে হবে। পাহাড়ের সংঘাত ও অশান্তির মূল কারণগুলো নির্মোহভাবে আলোচনা করা উচিত। আমরা পাহাড়ে শান্তি চাই...।’ এ কর্মকর্তা পাহাড়ের শান্তিবিষয়ক একটি আবেগঘন কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে তার বক্তব্য শেষ করেন। এ সময়, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আল ইউসুফ (অব.) বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বৈষম্যমূলক শান্তিচুক্তির পর্যালোচনা করতে হবে।
পাহাড়ে অন্য কণ্ঠস্বর: বক্তারা উল্লেখ করেন, পাহাড়ে ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বৈষম্যের শিকার। অনেক পাহাড়ি শান্তিচুক্তি ও সরকারের উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঙালিরাও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও সিএইচটি সম্প্রীতি জোটের সমন্বয়ক থোয়াই চিং মং শাক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা ছাড়া অন্যান্য জাতির কথা আপনারা জানেন না। সন্তু লারমার যে বাহিনী ছিল জেএসএস, ওই বাহিনী থেকে সাতটি দল হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।
এ দলগুলো গঠনের মাধ্যমে রাঙামাটিকে চাকমাদের হাতে লিজ দেওয়া হয়েছে, বান্দরবানকে মারমাদের এবং খাগড়াছড়িকে লিজ দেওয়া হয়েছে ত্রিপুরাদের হাতে।’ এ সময় তিনি ‘পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা মন্ত্রণালয়’ করার দাবি জানান। ‘কারণ ক্ষুদ্র জাতিসত্তা শুধু বান্দরবান, খাগড়াছড়ি কিংবা রাঙামাটিতে নয়; বরং সমতলেও যেমন-ময়মনসিংহে গারোরা আছেন, সাঁওতালরা আছেন, হাজংরা আছেন, মণিপুরীরাও আছেন।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহফুজ পারভেজ বলেন, ‘সাইকেল চুরির ঘটনা নিয়েও পাহাড়ে দাঙ্গা বাধানো হচ্ছে। গোত্রবাদ ও গোষ্ঠীবাদের পরিণতি কখনো ভালো নয়। বিভেদকে উসকে দেওয়া ঠিক নয়। পাহাড়ের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে এগিয়ে যেতে হবে। এবারের মতো ২০১৭ সালেও ঘটনা ঘটেছিল। তখনো কিন্তু এক গুজবেই বহু ভাঙচুর, মারামারি হয়েছে। এ গুজবটা কারা ছড়ায়, আমরা খুব ভালোভাবেই জানি।’
সাংবাদিক ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক গবেষক মেহেদী হাসান পলাশ বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা যেমন শুধু কক্সবাজারের সমস্যা নয়, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নয়। এটিকে জাতীয় সমস্যা হিসাবে দেখতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাহাড়ের সমস্যার সমাধান করতে হলে, সন্ত্রাসীদের প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। পাহাড়ে, জঙ্গলে, সাগরে, সমতলে বা গুহায় যেখানেই অবৈধ অস্ত্রধারী রাষ্ট্রবিরোধীরা থাকবে, তাদের সেখানেই ধ্বংস করতে হবে। আর শান্তিপ্রিয় মানুষকে ওদের থেকে আলাদা করে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’
পাহাড়ে শান্তির আকুতি : সভায় বক্তারা একদিকে যেমন পাহাড়ে সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তেমনই তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়-পাহাড়ি-বাঙালি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও মৈত্রীর বন্ধন এবং পাহাড়ে উন্নয়নের কথা। অবশেষে মুক্ত আলোচনা শেষ হয়, ‘পাহাড়ে শান্তি আসুক’ এমন সমবেত উচ্চারণে। বাংলাদেশের এ অতি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটি নিরাপদ থাকুক, প্রতিবেশী দেশগুলোর ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত থাকুক, এটাই কামনা। অনুষ্ঠান শেষে, অভ্যাগত অতিথিরা ঘরে ফিরলেন ইতিবাচক বাংলাদেশের ভাবমূর্তির অনুরণন নিয়ে। যেখানে পাহাড়ের শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ ও মৈত্রীর ঐকতান অন্তঃসলিলায় বহমান।
সম্প্রীতির সুবর্ণ সেতু: আমাদের জনগণ এখন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। এর অন্যতম স্পিরিট হলো-রিকনসিলিয়েশন ও ইনক্লুসিভনেস। ঢাকা ও চট্টগ্রামের দেওয়ালের গ্রাফিতিতেও আমাদের তরুণরা তখন ‘পাহাড়ের’ কথা তুলে ধরেছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে পাহাড়ে ঘটছে উলটো ঘটনা। হঠাৎ কেন এতটা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল খাগড়াছড়ি পাহাড়ি জনপদ? এটা আমাদের নির্মোহভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুল আলোচিত ডাকসু নির্বাচনে পাহাড়ের প্রতিনিধিত্ব (৪ জন) একটি উজ্জ্বল দিক।
ডাকসু ‘ভিপি’ ‘আবু সাদিক কায়েম’ ও সাধারণ সম্পাদক ‘এস এম ফরহাদ’ পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্তান। ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বাধীন ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ থেকে ‘সর্বমিত্র চাকমা’ ‘কার্যনির্বাহী সদস্য’ নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে ‘হেমা চাকমা’ ‘কার্যনির্বাহী সদস্য’ নির্বাচিত হয়েছেন ‘বামপন্থি’ ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ থেকে। পাহাড়ের পাহাড়ি-বাঙালি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, সবাইকে সমমর্যাদায় অভিষিক্ত করে আমরা একত্রে হাঁটব। কেউ যেন পিছিয়ে না পড়ে। সবাইকে নিয়ে পাহাড়ের সহিংসতা ও ষড়যন্ত্র প্রতিহত করব। বহুত্ববাদ, সম্প্রীতি ও সহনশীলতা হোক আমাদের বাংলাদেশের আর্মি। উদার বাংলাদেশের বৈচিত্র্যের মধ্যে আমাদের সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও জনজাতির সুরভিত ফুল ফুটুক।
পূর্বাপর রাওয়া: দেশের প্রয়োজনে, রাওয়ার এ উদ্যোগটি অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছে। আশা করি, ভবিষ্যতেও রাওয়া নিজেদের ক্ল্যাসিক কল্যাণমূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমও চালিয়ে যাবে। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের ‘সেকেন্ড হোম’ বলে পরিচিত এ সংগঠন (রাওয়া) ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী ও রাওয়ার জন্য নিবেদিত প্রাণ সেনাকর্মকর্তা ক্যাপ্টেন এম এ হাকিম তার সুলিখিত ‘পূর্বাপর রাওয়া’ (২০২৩) বইতে রাওয়া গঠনের ইতিহাস সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।
উল্লেখ্য, রাওয়া বর্তমানে একটি ‘থিংক ট্যাংক’ পরিচালনা করছে। রাওয়ার সাময়িকী ‘দি রাওয়া মিরর’ এর ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিশেষ সংখ্যা ২০২৫’ (জুলাই ২০২৫) পাঠক মহলে প্রশংসিত হয়েছে। আগামী ৩০, ৩১ অক্টোবর ও ১ নভেম্বর ‘রাওয়া বইমেলা ২০২৫’ অনুষ্ঠিত হবে।
মোহাম্মদ বায়েজিদ সরোয়ার: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক ও বিশ্লেষক