জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদে মোট ৭৪০টি মনোয়নপত্র জমা পড়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন পদে ছাত্র ৫৫৫; ছাত্রী ১৮৫। মোট প্রার্থীর ২৫ শতাংশ নারী। ভিপিসহ চার পদে কোনো ছাত্রী প্রার্থী হননি। অথচ এ নির্বাচনে ভোটারদের প্রায় অর্ধেকই ছাত্রী।
মনোনয়নপত্রের তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। গত বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র বিতরণ ও জমা শেষ হয়। কেন্দ্রীয় সংসদে ২৫ পদের বিপরীতে ২৭৩ এবং ছাত্রদের ১১ ও ছাত্রীদের ১০ হল সংসদে ১৫টি করে মোট ৩১৫ পদের বিপরীতে ৪৬৭ জন মনোনয়নপত্র জমা দেন। দুই সংসদ মিলে ৮১৩টি মনোনয়নপত্র বিতরণ হয়েছিল।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য, নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ হাজার ৯১৯ জন। এর মধ্যে ছাত্র ছয় হাজার ১০২; ছাত্রী পাঁচ হাজার ৮১৭। মোট ভোটারের ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ ছাত্রী।
নির্বাচনে ছয়টি সংরক্ষিত পদ থাকলেও তাতে ছাত্রীদের অংশগ্রহণে উৎসাহ দেখা যায়নি। সহসম্পাদক (এজিএস), সহক্রীড়া সম্পাদক, সহসমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক এবং তিনটি কার্যকরী সদস্যসহ সংরক্ষিত ছয় পদে মনোনয়ন জমা পড়েছে মাত্র ৪৩টি।
নারীশূন্য ভিপিসহ চার পদ
সহসভাপতি (ভিপি) পদে ২১ প্রার্থীর মধ্যে কোনো ছাত্রী নেই। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ১৫ প্রার্থীর মাত্র দুজন ছাত্রী। শুধু সংরক্ষিত নারী সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে প্রার্থী হয়েছেন ১০ জন। এ ছাড়া সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে ৯, ক্রীড়া সম্পাদক পদে পাঁচ, সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক পদে ১৫ এবং পরিবহন ও যোগাযোগ সম্পাদক পদে ৯ প্রার্থীর মধ্যে একজনও নারী প্রার্থী নেই।
নাট্য সম্পাদক পদে সাত, তথ্যপ্রযুক্তি ও গ্রন্থাগার সম্পাদক পদে ১৫ এবং স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা সম্পাদক পদে ১৪ প্রার্থীর মধ্যে ছাত্রী রয়েছেন একজন করে। শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক পদে ১৩ প্রার্থীর মধ্যে ছাত্রী তিন, পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সম্পাদক পদে ১৪, সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ৯ ও সহসাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ১১ প্রার্থীর মধ্যে দুজন করে ছাত্রী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
ছাত্রী হলে পদের তুলনায় প্রার্থী কম
জাকসুর হল সংসদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ১৫টি পদে নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু ছাত্রী হলে তুলনামূলক প্রার্থী কম দেখা গেছে। ছাত্রীদের ১০ ও ছাত্রদের ১১ মিলে ২১ হলে ৩১৫টি পদের বিপরীতে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন ৪৬৭ জন। এর মধ্যে ছাত্র ৩৪০; ছাত্রী ১২৮। হল সংসদে মোট প্রার্থীর ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ ছাত্রী। নওয়াব ফয়জুন্নেসা হল, সুফিয়া কামাল হল, বেগম খালেদা জিয়া হলসহ অন্তত পাঁচ হলের ১৫টি পদে প্রার্থী পাওয়া যায়নি। ছাত্রীদের বাকি হলেও প্রার্থী পদের তুলনায় অনেক কম। একটিতে সমানে সমান। তবে প্রার্থীদের মধ্যে একই পদে একাধিকজন আছেন কিনা, জানতে অপেক্ষা করতে হবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ পর্যন্ত।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলে ছয় জন, ১৩ নম্বর ছাত্রী হলে ছয়, সুফিয়া কামাল হলে ১০, বেগম খালেদা জিয়া হলে ১১ ও প্রীতিলতা হলে ১৩ প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। ফজিলাতুন্নেছা হলে ১৫, জাহানারা ইমাম হলে ১৬ এবং ১৫ নম্বর ছাত্রী হল, বীরপ্রতীক তারামন বিবি হল ও রোকেয়া হলে ১৭ জন করে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এসব হলে বেশির ভাগ পদে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকে বিজয়ী হতে চলেছেন।
কোনো প্যানেলে শীর্ষ পদে ছাত্রী নেই
নির্বাচনে এখন পর্যন্ত কোনো প্যানেলে শীর্ষ দুই পদে নারী প্রার্থী দেখা যায়নি। প্রতিটি প্যানেলে সংরক্ষিত সহসম্পাদক (নারী) ছাড়া সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন ছাত্ররা। ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল ও ছাত্রদলের সম্ভাব্য প্যানেলের ছয় ছাত্রীই সংরক্ষিত পদের। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) সমর্থিত প্যানেল ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’-এ আট ছাত্রীর ছয়জনই সংরক্ষিত পদে প্রার্থী হয়েছেন।
সংরক্ষিত পদে আবদুর রশিদ জিতু-শাকিল আলী সম্ভাব্য প্যানেলে রয়েছেন ছয় ছাত্রী। সাংস্কৃতিক জোটভুক্ত ৯টি সংগঠন ও ছাত্র ইউনিয়ন (অদ্রি-অর্ক) সমর্থিত ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলে ছাত্রী ১১। থিয়েটার (টিএসসি) ও ছাত্র ইউনিয়ন (ইমন-তানজিম) প্যানেল এখনও চূড়ান্ত তালিকা করতে পারেনি। তবে তাদের প্যানেলে তিন ছাত্রী আছেন বলে জানা গেছে।
শিবির-ছাত্রদল প্যানেলে ঠাঁই পায়নি আদিবাসী
ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত এবং ছাত্রদলের ২৫টি পদে কোনো আদিবাসী শিক্ষার্থীর স্থান হয়নি। বাগছাস সমর্থিত এবং আবদুর রশিদ জিতু-শাকিল আলী সম্ভাব্য প্যানেলে একজন করে আদিবাসী আছেন। থিয়েটার (টিএসসি) ও ছাত্র ইউনিয়ন (ইমন-তানজিম) প্যানেলে আদিবাসী শিক্ষার্থীর নাম চূড়ান্ত হয়নি। সাংস্কৃতিক জোটভুক্ত ৯টি সংগঠন ও ছাত্র ইউনিয়ন (অদ্রি-অর্ক) সমর্থিত প্যানেলে সর্বোচ্চ ৯ জন চাকমা, ত্রিপুরা ও রাজবংশী সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী রয়েছেন।
রাজনীতি সম্পর্কে ধারণাগত সংকট, নিরপত্তাহীনতা, অনলাইনে হয়রানি-বুলিংসহ নানা কারণে জাকসু নির্বাচনে প্রার্থিতার ক্ষেত্রে ছাত্রীরা পিছিয়ে বলে মনে করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েক ছাত্রী প্রার্থী হননি। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শ্রাবণী জামান জ্যোতি বলেন, ‘আন্দোলনে ছাত্রীদের অবদান কখনও যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। সাইবার বুলিং ও হয়রানির কারণে আমার মতো অনেকেই প্রার্থী হতে উৎসাহ পাননি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা সমকালকে বলেন, ‘জাকসুতে নারী প্রার্থীর ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় পরিসর জড়িত। আমাদের জাতীয় পরিসরেও নারীদের উপস্থিতি কম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীরা ভীষণ প্রতিবাদী। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে। ছাত্রীরা মনে করে, রাজনীতি মানে নির্দিষ্ট দলের রাজনীতি। এ থেকে তারা বের হতে পারেনি। আবার অবহেলা, নিরাপত্তাহীনতা, অনলাইনে হয়রানি-বুলিংয়ের কারণেও নির্বাচন প্রশ্নে ছাত্রীরা দ্বিধান্বিত থাকে।’