বিমানে ওঠার আগে অজান্তেই মনের এক কোণে ভয় ঢুকে পড়ে যদি কিছু হয়ে যায়? যদিও বিমান ভ্রমণ পরিসংখ্যানগতভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ পরিবহন মাধ্যম, তবুও যখনই কোনো দুর্ঘটনার খবর আসে, তা কাঁপিয়ে দেয় গোটা পৃথিবীকে। আর ঠিক সেই ভয়, সেই অনিশ্চয়তাই বহুবার সিনেমার পর্দায় রূপ পেয়েছে টানটান উত্তেজনা, মানবিক ট্র্যাজেডি কিংবা বীরত্বগাথার আকারে।
হলিউড হোক কিংবা বলিউড- বিমান দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য আলোচিত সিনেমা। সেখানে আকাশপথের বিপর্যয় কেবল এক নাটকীয় ঘটনা নয় বরং মানুষের সাহস, ত্যাগ, সম্পর্ক আর দায়িত্ববোধের পরীক্ষাক্ষেত্র। বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে যেমন তৈরি হয়েছে হৃদয়বিদারক চলচ্চিত্র, তেমনি কল্পনার ডানায় ভর করে এসেছে থ্রিলার, অ্যাকশন বা সাইকোলজিক্যাল ড্রামা।
এই ফিচারে থাকছে সেইসব সিনেমার মধ্যে আলোচিত কিছু সিনেমার গল্প-
বাংলাদেশি
জেকে ১৯৭১
২০২৩ সালে মুক্তি পায় ছবিটি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষকে সহায়তার জন্য ফরাসি যুবক জ্যঁ কুয়ে ছিনতাই করেছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ) একটি বিমান। তার দাবি ছিল, বাংলাদেশের স্বধীনতাকামী মানুষের জন্য ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী ওই বিমানে তুলে দিতে হবে এবং তাহলেই কেবল মুক্তি পাবে বিমানের সব যাত্রী। এ ঘটনা নিয়েই নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন পশ্চিমবঙ্গের সৌরভ শুভ্র দাশ। এ ছাড়া আরও রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের অভিনেতা ফ্রান্সিসকো রেমন্ড, রুশ অভিনেত্রী ডেরিয়া গভ্রুসেনকো, অভিনেতা নিকোলাই নভোমিনাস্কি, পশ্চিমবঙ্গের সব্যসাচী চক্রবর্তী, ইন্দ্রনীল প্রমুখ।
বলিউড
এয়ারলিফট
ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে সরাসরি কোনো বিমান দুর্ঘটনা না থাকলেও, কেন্দ্রীয় ভূমিকায় আছে বিমান। ইতিহাসের বৃহত্তম বেসামরিক উদ্ধার অভিযানের গল্প এটি—যেখানে ১ লক্ষ ৭০ হাজার ভারতীয় নাগরিককে বিমানে করে কুয়েত থেকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনা হয়। অক্ষয় কুমার অভিনীত এই ছবি সাহস, ধৈর্য ও মানবতার মূর্ত প্রতিচ্ছবি।
নীরজা
১৯৮৬ সালে প্যান অ্যাম ফ্লাইট ৭৩-এর হাইজ্যাক আর সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে কেবিন ক্রু নীরজা ভানোটের আত্মত্যাগ। বিমানে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলেও, জীবনের ভয় আর সাহসিকতার গল্পে ঠাসা এই সিনেমায় সোনম কাপুর অনবদ্য অভিনয়ে তুলে ধরেছেন এক নারীর মহিমান্বিত বীরত্ব।
রং দে বসন্তী
আমির খানের ক্যারিয়ারের অন্যতম সিনেমা এটি। এই চলচ্চিত্র মূলত রাজনৈতিক-সামাজিক বার্তা কেন্দ্রিক, তবে একটি বিমান দুর্ঘটনা পুরো গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের এক দুর্ঘটনায় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট অজয় সিং রাঠোরের মৃত্যু তার বন্ধুদের মনে জাগিয়ে তোলে প্রতিবাদ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইচ্ছা। দুর্ঘটনাটি হয়ে ওঠে যুববিদ্রোহের প্রতীক।
রানওয়ে ৩৪
অজয় দেবগন পরিচালিত ও অভিনীত এই থ্রিলার ছবির গল্প একটি সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণায়। কুয়েত থেকে কোচি অভিমুখে এক বিমানের পাইলট ঘন কুয়াশার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নামার সিদ্ধান্ত নেন। বিমানের ভেতরের উত্তেজনা, পাইলটের মনস্তত্ত্ব এবং তার পরিণতি—সব মিলিয়ে এটি এক মনকাড়া অভিজ্ঞতা।
ইউন হোতা তো ক্যা হোতা
নাসিরুদ্দিন শাহ পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটি এক বিমান দুর্ঘটনার পরিণতি নিয়ে গড়া, যেখানে একাধিক চরিত্রের জীবনে ঘটে যায় ভয়াবহ বদল। ভাগ্য, দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হঠাৎ আগমন কীভাবে জীবনের গতিপথ বদলে দেয়, তা নিপুণভাবে দেখানো হয়েছে এই মানবিক নাটকে।
হলিউড
ফ্লাইট (২০১২)
ফ্লাইট হ'ল ২০১২ সালের একটি আমেরিকান চলচ্চিত্র যা পরিচালনা করেছেন রবার্ট জেমেকিস। এখানে ডেনজেল ওয়াশিংটন উইলিয়াম হুইটেকার সিনিয়র চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যিনি একজন পাইলট। বিমানে একটি যান্ত্রিক ব্যর্থতার পরে তার বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছিল। মারা যাচ্ছিলেন প্রায় প্রত্যেককেই। এই সময় পাইলট অলৌকিকভাবে বিমানটি ক্রাশ ল্যান্ডিং করাতে সর্মথ হন। যাতে সবাই বেঁচে যান। ঘটনার পরপরই তাকে একজন নায়ক হিসেবে প্রশংসিত করা হয়েছে। তবে ঘটনার তদন্ত তার দিকে এমন প্রশ্নগুলো ধেয়ে আসে যা অনেক সন্দেহ তৈরি করায়। পরে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এতে পাইলট চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডেনজেল ওয়াশিংটন। এই চলচ্চিত্রটি আলাস্কা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ২৬১ এর বিমান দুর্ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এটি বাণিজ্যিকভাবেও সফল ছিল, এর ৩১ মিলিয়ন ডলার উৎপাদন বাজেটের তুলনায় ১৬১.৪ মিলিয়ন ডলার আয় করেছিল।
ফ্লাইট প্লেন (২০০৫)
এই ছবিটি তৈরি হয়েছিলো বিখ্যাত পরিচালক অ্যালফ্রেড হিচককের ‘দ্যা লেডি ভ্যানিসেস’ এর অনুকরণে। এই ছবিতে শুধু ট্রেনের জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে প্লেন। জার্মান পরিচালক রবার্ট শোয়েন্তকি এই ছবিটির মাধ্যমে তার পরিচালনা জীবন শুরু করেন। ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন জোডি ফস্টার। ছবিতে জোডি একজন বিমান প্রকৌশলী কর্মচারী। তার স্বামী মারা যাওয়ার পর চিন্তা তাকে আমেরিকায় সমাহিত করবে। এজন্য তার স্বামীর লাশ সহ ছয় বছরের মেয়ে জুলিয়াকে নিয়ে তার ডিজাইন করা প্লেনে উঠে পড়ে। প্লেনে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখে কোথাও তার মেয়ে জুলিয়া নেই। কিন্তু জুলিয়াকে তার সঙ্গে কেউ দেখেনি এমনকি জুলিয়া যে প্লেনে ছিলো এমন কোনো প্রমানও পাওয়া যায়না। পরবর্তীতে অনেকেই ভাবেন সে হয়তো পাগল হয়ে গেছে।
এয়ার ফোর্স ওয়ান (১৯৯৭)
বিমান নিয়ে হলিউডে যত ছবি নির্মিত হয়েছে ‘এয়ার ফোর্স ওয়ান’ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ছবি। ছবিটি নির্মিত হয়েছিলো বিমান হাইজ্যাক নিয়ে। ছবিতে হ্যারিসন ফোর্ড যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্টের চরিত্রে নিখুতভাবে অভিনয় করেছেন, ঠিক তেমনি দক্ষতা দেখিয়েছিলেন গ্যারি ওল্ডম্যান। ছবিতে আততায়ীদের প্রধান ছিলেন তিনি। ১৯৯৭ সালের সবচেয়ে বড় সুপারহিট ছবি ছিলো এটি। নিঃসন্দেহে এটা ছিলো ‘ডাস বুট’ ছবির পরিচালক উল্ফগ্যাং পিটারসেনের সর্বশ্রেষ্ঠ ছবি।
ফিয়ারলেস (১৯৯৩)
জেফ ব্রিজ অভিনীত ছবি ‘ফেয়ারলেস’ এ বিমান দুর্ঘটনার মতো নির্মম পরিস্থিতিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্লেন ক্রাশের দৃশ্যে দেখা যায় জেফের পাশে বসা একটি ছোট ছেলে আসন্ন মৃত্যু দেখে ঘাবড়ে যায়। জেফ সেই ছোট ছেলেকে শান্ত করার চেস্টা করেন। এর এক পর্যায়েই বিমানটি ধ্বংস হয়ে যায়।
এলাইভ (১৯৯৩)
মেঘে ঢেকে যায় প্লেনটি কোনো কিছুই পাইলটের দৃষ্টিগোচর হয়না । থেকে থেকে প্লেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে। আর যাত্রীদের মনে প্রান সঙ্কটের শঙ্কা বাঁধতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ঘটে বিমান বিধ্বংসের ঘটনা। দৃশ্যটি ‘এলাইভ’ ছবির। ছোট্ট প্লেনে আনন্দ ফূর্তিতে থাকা যাত্রীদের নির্মম ফলাফল।
প্যাসেঞ্জারস ফিফটি সেভেন (১৯৯২)
এই ছবিটি অভিনেতা উইজলি স্নিপসকে হলিউডে নব্বই দশকের অ্যাকশন হিরো হিসেবে একটি একটি শক্ত স্থান দিতে সক্ষম হয়েছিল। ছবিটি নিয়ে অনেক ভ্রান্ত মুহুর্ত থাকলেও এর মারপিটের দৃশ্য এবং হাসির দৃশ্যগুলো বেশ প্রশংসিত ছিল। ব্রুছ পেনি ছবিতে একজন ঠান্ডা মাথার আততায়ীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। ছবিতে দেখা গিয়েছিলো ব্রুছ একজন ভয়ঙ্কর আততায়ী যাকে এফবিআই অনেক কষ্টে গ্রেফতার করে প্লেনে লস অ্যানেঞ্জলস নিয়ে যায়। আর সেই প্লেনের মাঝেই ব্রুছ যাত্রীদের জিম্মি করে নিজের মুক্তি দাবি করে।