বালক-বালিকাদের ক্ষেত্রে বয়োসন্ধি একটি অনিবার্য বাস্তবতা। সবাইকে এই স্টেজ পার হতে হয়। এই সময়টায় সন্তানদের প্রতি আলাদা নজর দিতে হয়। তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হয়। তাদের সঙ্গে মিশতে হয়।
বয়োসন্ধিকালে শিশুদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। হরমোনের নানা পরিবর্তনের কারণে শরীরে নানা পরিবর্তন দেখা দেয়।
সাধারণত ১১-১৪ বছর বয়সের মধ্যে বয়োসন্ধি হয়ে থাকে। কারও কারও ক্ষেত্রে দেরিতেও বয়োসন্ধি হয়ে থাকে।
কোনো বালকের যদি ১৪ বছর বয়সেও অণ্ডকোষের আয়তন ৪ মিলিমিটারের বেশি না হয়, অথবা অণ্ডকোষের অনুপস্থিত থাকে; কোনো বালিকার ১৩ বছর বয়সেও যদি স্তন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত না হয় এবং উভয়ের ক্ষেত্রে বয়োসন্ধিকালীন পরিবর্তন অনুপস্থিত থাকে, তা হলে বালকের ক্ষেত্রে ১৪ বছরের পর এবং বালিকার ক্ষেত্রে ১৩ বছর পর বিলম্বিত বয়োসন্ধি বলা হবে। এ সময়ের মধ্যেই ৯৫ শতাংশ বালক-বালিকার যৌবনপ্রাপ্তি সম্পন্ন হয়।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক এবং হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাদা সেলিম।
প্রাইমারি হায়পারগোনাডোট্রপিক হায়পোগোনাডিজম: অণ্ডকোষ বা ডিম্বাশয়ের সমস্যার মূল কারণ।
এ ক্ষেত্রে গোনাড (অণ্ডকোষ বা ডিম্বাশয়) প্রয়োজনীয় যৌন হরমোন তৈরিতে ব্যর্থ হয়। এর পেছনে ক্রমোজোমাল ত্রুটি (টার্নার সিনড্রোম, ক্লিনেফিল্টার সিনড্রোম ইত্যাদি)-এর সমস্যা থাকতে পারে। টেস্টোস্টেরন হরমোনের ত্রুটিও থাকতে পারে। খুব কম করে হলেও, কিছু বালক-বালিকার গোনাড ঠিকমতো তৈরিই হয় না। শৈশবে কোনো বালক যদি অণ্ডকোষে বড় ধরনের কোনো আঘাত পায় বা অণ্ডকোষটি ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে তা হলেও যৌবনপ্রাপ্তি প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
শৈশবে ছেলেদের অণ্ডকোষের প্রদাহ বা মেয়েদের ডিম্বাশয়ের প্রদাহ যৌবনপ্রাপ্তিতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। ক্যান্সার কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি অনুরূপ সমস্যা তৈরি করতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া বা অন্য কোনো কারণে যাদের ঘন ঘন রক্ত নিতে হয়, তাদের গোনাডে অতিরিক্ত আয়রন জমে এর কার্যকারিতা হ্রাস পেতে পারে। এর পরেও কিছু কিছু কারণ অজানা থেকে যায়।
হায়পোগোনাডোট্রপিক হায়পোগোনাডিজম : হায়পোথ্যালামাস বা পিটুইটারিতে প্রধান সমস্যাটি থাকে।
সাময়িক বা কিছু মাস বা বছরের জন্য এ ঘটনা বিরাজ করতে পারে। এর মধ্যে পারিবারিক বা বংশধারা একটি প্রভাব প্রকটভাবে বিরাজ করতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে অপুষ্টিজনিত দৈহিক বৃদ্ধিহীনতাও এর একটি কারণ হতে পারে।
তা ছাড়া বাড়ন্ত বয়সে অসংক্রামক রোগ ও দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক রোগের কারণেও এ রকম সমস্যা হতে পারে। শৈশবকালে মাত্রাতিরিক্ত শারীরিক শ্রম বা ব্যায়াম করলে বিলম্বিত বয়োসন্ধি হতে পারে।
এ সমস্যাটি স্থায়ীও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রজনন হরমোনের ঘাটতি প্রধান কারণ। কলমেন সিনড্রোম, প্র্যাডার উইলি সিনড্রোম, প্যানহায়পো পিটুইটারিজম ইত্যাদি। আবার কুসিং সিনড্রোমও কারও কারও থাকতে পারে।
বিলম্বিত বয়োসন্ধিকালে বালক-বালিকারা প্রধানত তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে হরমোন বিশেষজ্ঞ বা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে হাজির হন। অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের যৌবনপ্রাপ্তি না হওয়ায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হন এবং চিকিৎসককে তা জানান।
এ ছেলেমেয়েদের অধিকাংশেরই দৈহিক উচ্চতা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে অনেক কম থাকে। রোগী নিজে বা অভিভাবকরা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সমস্যা উপস্থাপন নাও করতে পারেন; বিশেষ করে ছেলেদের ক্ষেত্রে।
তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে শারীরিক অন্যান্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঋতুস্রাব শুরু না হওয়াটা নজরে পড়তে পারে। বালক-বালিকা উভয়ের ক্ষেত্রে বয়োসন্ধিকালে প্রবেশে সব পরিবর্তন অনুপস্থিত থাকে। ছেলেদের দাড়ি-গোঁফ গজায় না, দৈহিক গঠনের পুরুষালি ভাব হয় না, লিঙ্গের আকার ছোট থাকে, লোম ও ঘামের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনও অনুপস্থিত থাকে। অণ্ডকোষ মাপলে ৪ মিলিমিটারের কম পাওয়া যায়।
বালিকাদের ক্ষেত্রেও স্তনের বৃদ্ধি হয় না, দেহের নারীসুলভ অন্যান্য পরিবর্তন অনুপস্থিত থাকে, যেমন— নিতম্বের আকার পরিবর্তন, কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন ইত্যাদি। উভয় ক্ষেত্রেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের ঘাটতি থাকবে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
প্রথমেই বর্তমানে বালক বা বালিকাটির দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছে কিনা, সেটি নিশ্চিত হতে হবে। এ ধরনের রোগ অনেক থেকেই বালক বা বালিকাটির দেহে বসবাসে সম্ভাবনা আছে। এর পর পরিবারের অন্য সদস্যদের বিশেষ করে বাবা বা ভাইয়ের দৈহিক বৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিকল্পনা শুরু করতে হবে। বয়োসন্ধিকালের লক্ষণগুলোর অনুপস্থিতি পরিমাপের জন্য পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত পদ্ধতি হলো— ট্যানার স্ট্যাজিং (Tanner Staging)। বালক বা বালিকার দৈহিক উচ্চতার পরিমাপ অবশ্যই নিতে হবে। রক্তের গ্রোথ হরমোন মাপলে অনেক সময় কম পাওয়া যেতে পারে; গ্লুকোকর্টিকয়েড মাপলে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। দেহের ওপর ও নিচের অংশের অনুপাতও জেনে নিতে হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলোর মধ্যে রক্তের টেস্টোস্টেরন (ছেলেদের জন্য), এলএইচ, এফএসএইচ, ইস্ট্রোজেন ইত্যাদির মাত্রা দেখে নিতে হবে (সকালবেলার নমুনায়)।
অধিকাংশ বিলম্বিত বয়োসন্ধির বালক-বালিকাদের ধীরগতিতে দৈহিক বৃদ্ধি হয় এবং তা একটু দেরিতে হলেও অনেকটা স্বাভাবিকের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ছেলেদের ক্ষেত্রে এ ঘটনা বেশি ঘটে।
টার্নার সিনড্রোমের বাচ্চারা অন্য অনেক লক্ষণের সঙ্গে বেঁটে আকার নিয়ে উপস্থিত হবে। ক্লিনেফিল্টারে বাচ্চারা লম্বা আকৃতির হবে। ক্যারিও টাইপিং করে খুব সহজেই ক্রমজোমালের ত্রুটিগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
চিকিৎসা
রোগ শনাক্ত করে, সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। পারিবারিক ধীরগতির বৃদ্ধি সংবলিত ছেলেমেয়েদের একটু পরে হলেও বয়োসন্ধিকাল অতিক্রম করার বা যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। দীর্ঘস্থায়ী রোগ যাদের আছে, তাদের ক্ষেত্রেও যথপোযুক্ত চিকিৎসায় যৌবনপ্রাপ্তির সহায়ক হবে। কিন্তু ক্রমোজোমাল ত্রুটি থাকলে, সে ক্ষেত্রে ফল খুব আশাব্যঞ্জক হবে না। তাদের জন্য সাপোর্টিভ বিভিন্ন রকম ব্যবস্থা নিতে হবে।