পাকিস্তানে খিলাফত প্রতিষ্ঠার জিহাদে সক্রিয় বাংলাদেশি কয়েকজন

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৫ জুলাই ২০২৫, ১৮:১১

পাকিস্তানে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার জিহাদে জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের একাধিক যুবক। এমনকি সেখানে গিয়ে ঢাকার সাভারের এক যুবকসহ আরও তিন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও জিহাদ থেকে ফেরত আসা ফয়সাল (৩৩) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট। তিনি পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছে।
এ ঘটনায় ফয়সালকে প্রধান আসামি করে ছয় যুবকের নাম উল্লেখ করে গত ৫ জুলাই সাভার মডেল থানায় মামলা করেছে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের ইন্টেলিজেন্স শাখার পরিদর্শক আব্দুল মান্নান।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন আল ইমরান ওরফে ইঞ্জিনিয়ার ইমরান হায়দার, রেজাউল করিম আবরার, আসিফ আদনান, জাকারিয়া মাসুদ ও সানাফ হাসান।
অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) এ ঘটনায় কাজ করছেন।
তাদের তথ্যমতে, নিহত চার বাংলাদেশির মধ্যে একজন জুবায়ের, তার বাসা সাভারের আড়াপাড়া এলাকায়। দ্বিতীয় জন চট্টগ্রামের পটিয়ার এক যুবক, তার নাম জানতে পারিনি। তৃতীয় জন সাইফুল্লাহ্ গোরাবার মেয়ে এবং চতুর্থ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার, যার বিস্তারিত পরিচয় এখনও জানা যায়নি।
এসবির এক কর্মকর্তা বলেন, গত ২৭ এপ্রিল পাকিস্তানের উত্তর ওয়াজিরিস্তানে পাক-আফগান সীমান্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযানে তেহরিক ই তালেবান পাকিস্তানের ৫৪ সদস্য নিহত হন। নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী এক তরুণ ছিলেন। তার নাম আহমেদ জুবায়ের। বাড়ি ঢাকার সাভারের আড়াপাড়ায়। এলাকার লোকজন ও বন্ধুবান্ধব তাকে যুবরাজ বলে জানেন। মূলত জুবায়ের ও গ্রেফতার ফয়সাল টিটিপির হয়ে বাংলাদেশে কাজ করতেন। ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর জিহাদের উদ্দেশে জুবায়ের ও ফয়সাল একসঙ্গে ওমরা করার নামে সৌদি আরব যান। সেখানে ৯ দিন অবস্থান করে ভিসা নিয়ে পাকিস্তানে গমন করেন। 
ওই কর্মকর্তা বলেন, পাকিস্তান থেকে ৬ নভেম্বর ভিসা নিয়ে আফগানিস্তান পৌঁছান। সেখানে তারা দুই জন অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ইমরান হায়দারের সঙ্গে দেখা করেন এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। সেখানে বাংলাদেশি সাইফুল্লাহ গোরাবা নামে এক যুবক সপরিবারে বসবাস করতেন। একটি অভিযানের সময় এয়ার স্ট্রাইকে সাইফুল্লাহর দুই পা ও মেরুদণ্ড অকেজো হয়েছে। সাইফুল্লাহর স্ত্রী আহত হয়েছে এবং দুই বছর বয়সী মেয়ে মারা গেছে। ঘটনাটি শুনে ফয়সাল ভয় পান এবং বাংলাদেশে ফিরে আসেন। কিন্তু জুবায়ের খুব জেদি প্রকৃতির হওয়ায় সেখানে থেকে যান এবং একটি অভিযানে মারা যান। 
তিনি বলেন, আমাদের কাছে পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে পৃথক সময় চার জন নিহতের খবর রয়েছে। তাদের প্রত্যেকে জিহাদের উদ্দেশে দেশ ছেড়ে ছিলেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ থেকে ২৫ যুবক একই উদ্দেশে দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এমন তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। এর মধ্যে ছয় জন রয়েছে সাভার এলাকার। আমরা কাজ করছি, যাতে তারা আর না যায় এবং এই রাস্তা থেকে ফিরে আসেন।
এদিকে ফয়সালকে গ্রেফতারের পর সাভার থানায় করা মামলার কপিতে তার বিস্তারিত পরিচয় উল্লেখ করা হলেও অন্য আসামিদের পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।
মামলাটিতে বাদী উল্লেখ করেছেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারি, সন্ত্রাসী সংগঠন টিটিপির মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কতিপয় বাংলাদেশি যুবক পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তানে গিয়ে পাকিস্তানে ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত রয়েছেন। উক্ত সংগঠনের আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে পাকিস্তানসহ বিশ্বব্যাপী ইসলামি খিলাফত কায়েম করা। প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করাসহ পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে গোয়েন্দা তথ্য যাচাইসহ পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট কন্ট্রোল রুমে সাধারণ ডায়েরি করা হয়। ২ জুলাই সঙ্গীয় ফোর্সসহ দরিয়ারপুর এলাকাধীন সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মোড়ে কাজী অফিস সংলগ্ন মমতাজ ম্যানশনের একটি দোকানের কাছ থেকে ফয়সালকে গ্রেফতার করা হয়। 
ফয়সাল জিজ্ঞাসাবাদে উপস্থিত লোকজনের সামনে জানান, তিনি টিটিপির মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে উক্ত সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তার সহযোগী আহমেদ জুবায়েরের (২৩) সঙ্গে সৌদি আরবে ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকা ত্যাগ করেন। পরে তারা সৌদি আরব থেকে ২৯ অক্টোবর পাকিস্তান পৌঁছান। সেখান থেকে তারা ৬ নভেম্বর তুরখাম স্থল সীমান্ত দিয়ে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেন। ফয়সাল ১০ নভেম্বর আফগানিস্তান থেকে তুরখাম স্থল সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করেন। পরে পাকিস্তানের করাচি থেকে দুবাই হয়ে গত ১৬ নভেম্বর বাংলাদেশে ফেরত আসেন। তার সঙ্গী জুবায়ের পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তান সীমান্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযানে মারা যান।
জিজ্ঞাসাবাদে ফয়সাল জানান, আল ইমরান কতিপয় বাংলাদেশি যুবককে টিটিপির হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ ও সংঘবদ্ধ করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি বর্তমানে টিটিপির হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ইমরান নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফয়সালের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। ফয়সাল বাংলাদেশে টিটিপির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির কার্যক্রম, সদস্যদের ইসলামি খিলাফতের দাওয়াত পৌঁছানোর কার্যক্রম পরিচালনা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ করছেন।
তাছাড়া ফয়সালের সঙ্গে ইমরানের কয়েকজন বন্ধু রেজাউল করিম আবরার, আসিফ আদনান, জাকারিয়া মাসুদ, সানাফ হাসানসহ কয়েকজন সহযোগী ধর্মীয় উগ্রবাদে দীক্ষিত হয়ে জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।
এ বিষয়ে মামলার বাদী কে- পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের ইন্টেলিজেন্স শাখার পরিদর্শক আব্দুল মান্নান মন্তব্য করতে রাজি হননি। 
তবে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস উইং) এসপি ব্যারিস্টার মাহফুজুল আলম রাসেল বলেন, টিটিপির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ফয়সাল নামে এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ফয়সালসহ ছয় জনের নামে সাভার মডেল থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছি। তাকে খুব দ্রুত রিমান্ডে চাওয়া হবে।
এদিকে নিহত জুবায়েরের বাবা আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার ছেলে শহীদ হয়েছে। তার জন্য দোয়া করবেন। এ ছাড়া কোনও কিছুই বলতে চাননি তিনি। 
জুবায়েরের জন্ম ২০০৩ সালের ৮ এপ্রিল। তিনি সাভার কলেজে ইসলামিক স্ট্যাডিজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। সাভারের অধর চন্দ্র হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং আশুলিয়ায় অবস্থিত মির্জা গোলাম হাফিজ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন।
অন‍্যদিকে গ্রেফতারকৃত ফয়সাল বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার আমতলী এলাকার মৃত ইব্রাহিমের ছেলে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করা ফয়সাল বাবা মায়ের সঙ্গে সাভারে বসবাস করেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনি সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংলগ্ন ভাই ব্রাদার্স টেলিকমের মালিক। এলাকার লোকজন ফয়সালকে একজন ধার্মিক লোক হিসেবে চেনেন। 
সাভার মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ জুয়েল মিয়া বলেন, সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফয়সালকে আটক করা হয়েছিল। তবে প্রাথমিকভাবে তথ্য প্রমাণ না পাওয়ায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে তার বিরুদ্ধে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট মামলা করেছে।