যুদ্ধবিধ্বস্ত অবরুদ্ধ গাজায় আলজাজিরার সাংবাদিক ছিলেন আনাস আল-শরীফ। ইসরাইলের নৃশংসতার মাঝেই গাজার ভয়াবহতা তুলে ধরতেন অকুতোভয় আনাস। কিন্তু শেষমেষ ইসরাইলের বর্বরোচিত হামলা থেকে মুক্তি পেলেন না তিনিও। রোববার ইসরাইলি হামলায় নিহত হয়েছেন তিনি। শেষ বিদায়ের আগে ফিলিস্তিনের জনগণ ও বিশ্ববাসীর কাছে রেখে গেছেন হৃদয়বিদারক বার্তা। এক্সে করা আবেগঘন ওই বার্তায় তিনি গাজাকে ভুলে না যেতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
মৃত্যুর পর তার পক্ষ থেকে ওই চিঠি প্রকাশ করা হয়েছে। নিচে আনাসের চিঠির হুবহু অনুবাদ তুলে ধরা হলো :
‘এটাই আমার ইচ্ছা এবং আমার শেষ বার্তা। যদি এই কথাগুলো তোমার কাছে পৌঁছায়, তাহলে জেনে রেখো যে ইসরাইল ইতোমধ্যে আমাকে হত্যা করতে এবং আমার কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করতে সফল হয়েছে। প্রথমত, আপনার ওপর শান্তি এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক। আমার আল্লাহ সাক্ষী, সেই শৈশব থেকে যখন জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের অলি-গলিতে নিজেকে আবিষ্কার করেছি, তখন থেকেই আমি আমার জনগণের সমর্থন এবং কণ্ঠস্বর হওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা এবং আমার সমস্ত শক্তি ব্যয় করেছি। আমার আশা ছিল, আল্লাহ আমাকে দীর্ঘ হায়াত দান করবেন, যেন আমি আমার পরিবার ও প্রিয়জনদের নিয়ে আমাদের মূল শহর দখলকৃত আসকালান (আল-মাজদাল)-এ ফিরে যেতে পারি। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছাই আগে, এবং তার ফয়সালা চূড়ান্ত। আমি জীবনের প্রতিটি ধাপে যন্ত্রণা সহ্য করেছি। বহুবার নিদারুণ কষ্ট ও ক্ষতির স্বাদ পেয়েছি। তবুও আমি কখনো সত্যকে বিকৃতি বা মিথ্যা ছাড়া তুলে ধরতে দ্বিধা করিনি। যারা নীরব থেকেছে, যারা আমাদের হত্যা মেনে নিয়েছে, যারা আমাদের শ্বাসরোধ করেছে, আর যাদের হৃদয়ও কেঁপে ওঠেনি আমাদের শিশু ও নারীদের ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষ দেখে, যারা সেই হত্যাযজ্ঞ থামানোর জন্য কিছুই করেনি আল্লাহ যেন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী থাকেন। আমাদের জনগণ দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে এসব সহ্য করছে। আমি তোমাদের হাতে সঁপে দিচ্ছি আমার পরিবারকে। আমি তোমাদের হাতে অর্পণ করছি আমার চোখের আলো, আমার প্রিয় কন্যা শামকে যার বড় হয়ে ওঠা আমি আমার স্বপ্নের মতো করে দেখতে পারিনি। আমি তোমাদের হাতে অর্পণ করছি আমার প্রিয় পুত্র সালাহকে যাকে আমি জীবনের পথে পাশে থেকে শক্ত করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, যাতে সে একদিন আমার বোঝা কাঁধে তুলে নিয়ে আমার লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পারে। আমি তোমাদের জিম্মায় রেখে গেলাম আমার প্রিয় মাকে, যার দোয়াই আমাকে এই অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে, যার প্রার্থনা ছিল আমার দুর্গ, আর যার আলো আমার পথ দেখিয়েছে। আমি প্রার্থনা করি, আলাহ তাকে শক্তি দিন এবং আমার পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ প্রতিদান দিন। আমি তোমাদের জিম্মায় রেখে যাচ্ছি আমার জীবনসঙ্গী, আমার প্রিয় স্ত্রী উম্মে সালাহ (বায়ান)-কে। যুদ্ধ আমাদের বহু দিন-মাস বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তবুও সে আমাদের বন্ধনে অটল থেকেছে। হে আল্লাহ, আমাকে শহীদদের অন্তর্ভুক্ত করো, আমার অতীত ও ভবিষ্যতের সব গুনাহ মাফ করো, আর আমার রক্তকে এমন আলো বানাও যা আমার জনগণ ও পরিবারকে স্বাধীনতার পথে আলোকিত করবে। যদি কোথাও আমি অপূর্ণ থেকেছি, ক্ষমা করো, আর আমার জন্য রহমতের দোয়া করো। কারণ আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি, কখনো পরিবর্তন বা বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। গাজাকে ভুলে যেও না... আর তোমাদের আন্তরিক প্রার্থনায় আমাকে যেন আল্লাহ ক্ষমা করেন ও কবুল করে নেন, সেই দোয়া করতে ভুলো না। (সংক্ষেপিত)
সাংবাদিক হত্যার ঘটনায় বিক্ষোভ : গাজার আল-শিফা হাসপাতালের পাশে ৫ সাংবাদিককে হত্যার ঘটনায় বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সাংবাদিক হত্যার ঘটনার জবাবদিহিতার কথা জানিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। এরই মধ্যে তিউনেসিয়া, আয়ারল্যান্ড, জার্মানি ও স্টকহোমে ব্যানার হাতে বিক্ষোভ মিছিল দেখা গিয়েছে।