স্বৈরাচার উত্থানরোধে সংবিধান সংস্কারই শেষ কথা নয়

আবু আলা মাহমুদুল হাসান
  ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১৮:৪৪

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও দেশত্যাগের পর এখন সবচেয়ে আলোচিত বক্তব্য– এমন দেশ গড়ে তুলতে হবে, এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে আর কখনও ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচারের উত্থান ঘটতে না পারে। এ জন্য নানা সমাধানের কথা বলা হচ্ছে। যেমন, সংবিধান সংশোধন বা পুর্নলিখন; দু’বারের বেশি কারও ক্ষমতায় না থাকা বা একই ব্যক্তির একাধিক পদে না থাকা; দু’কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, নতুন রাজনৈতিক দল ইত্যাদি। 
কেউ কেউ বলছেন, সংবিধান সংশোধন করলেই হবে। অন্যরা বলছেন, আওয়ামী লীগ বিগত সময়ে নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে এর যে করুণ দশা করেছে, তাতে নতুন করেই লিখতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, একটি নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের গুরুত্ব আসলে কতটুকু? বিশ্বে এখনও আধা-ডজনের ওপর রাষ্ট্র আছে, যাদের কোনো সংকলিত সংবিধান নেই। তাদের মধ্যে আছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন ও নিউজিল্যান্ড। তাদের নিয়মতান্ত্রিক সরকার পরিবর্তন ও শাসন নিয়ে কেউই খুব বেশি প্রশ্ন তোলে না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে ফ্র্যাংকলিন ডি রুজভেল্টের আগে দেড়শ বছর রাষ্ট্রপতি পদে দুই মেয়াদের বেশি কেউ থাকেননি কোনো লিখিত নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও। 
অন্যদিকে বাংলাদেশসহ সাবেক উপনিবেশিত বিশ্বের অনেক দেশেই লিখিত সংবিধান থাকার পরও বারবার শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর বাধাগ্রস্ত হয়েছে; সামরিক শাসন বা স্বৈরাচারের উত্থান হয়েছে। চীনেও শি জিনপিং নিজের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে সংবিধান সংশোধন করেছেন। শেখ হাসিনাও নিজে ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত ধারা বাতিল করেছিলেন আদালতকে ব্যবহার করে। 
তাঁর শাসনামলে যেভাবে গুম-খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বৈষম্য, দুর্নীতি হয়েছে; কোনোটাই সমসাময়িক সংবিধানে অনুমোদিত ছিল না। এমনকি এসবের প্রতিরোধ-প্রতিকারে সুনির্দিষ্ট আইনও ছিল; আর তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন সংস্থা বা কমিশনও ছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। নির্বাচন কমিশন ‘রাতের ভোট’ করেছে; প্রধান বিচারপতিকে দেশ ছাড়তে হয়েছে; মানবাধিকার কমিশন কুম্ভকর্ণের চেয়েও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থেকেছে। এ দেশে গত দেড় দশকে সবই সংবিধান, আইন, প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থার অভাবে হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং সব আইনকানুন, ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও হয়েছে। 
যুক্তরাষ্ট্র, যারা নিজেদের গণতন্ত্রের ধারক-বাহক হিসেবে গর্ব করে; যাদের লিখিত সংবিধান ও অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান রয়েছে; সেখানেও সাম্প্রতিক সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। তাঁকে অনেকে সাহায্যও করেছিল; তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় সমর্থন করেছিল। কিন্তু তিনি সফল হতে পারেননি, কারণ অনেক সহকারী-সমর্থক তাঁকে সাহায্য করেননি। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। আবার দেখি আইন, সাংবিধানিক সুরক্ষা থাকা সত্ত্বেও আফ্রিকান বা লাতিন আমেরিকান বংশোদ্ভূত অথবা অন্যান্য অশ্বেতাঙ্গ মার্কিন নাগরিক ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হয়। তারা অস্বাভাবিক হারে নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের শিকার হয়। আদালতেও তারা শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে বেশি হারে সাজা পায়। তার মানে, আইনকানুন, প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থা নিজের লঙ্ঘন না হওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে না।  
আমাদের দেশেও সুষ্ঠু নির্বাচন ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রতিষ্ঠিত ও কয়েক মেয়াদে চর্চিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিল প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মানসিকতার কারণে। এর অর্থ হলো, কোনো ব্যবস্থাই নিজে নিজে এটা নিশ্চিত করতে পারে না– তার খেলাফ বা অপব্যবহার হবে না। কারণ কোনো আইন, ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠানের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা নেই কিছু করার। তার প্রয়োগ হয় মানুষের মাধ্যমে। তাকে কার্যকরী করতে মানুষের প্রয়োজন হয়। এখানেই এর দুর্বলতা। মানুষ যদি এর যথাযথ প্রয়োগ না করে তবে এসবই অর্থহীন। উপরন্তু মানুষ সহজেই লোভ-লালসা, ভয়ভীতি ও আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বা গাফিলতিবশত কর্তব্যবিমুখ হতে পারে। 
তাহলে উপায় কী? সহজ কোনো উপায় নেই। উপায় একটাই– আমাদের রাজনৈতিক অভ্যাস, আচরণ, মনমানসিকতা বদলাতে হবে। যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা হস্তগত করে তা আঁকড়ে থাকা, বিরোধীদের দমন-পীড়ন, নির্বাচনে হেরেও ক্ষমতা দখলের চেষ্টা, জাতীয় ও জনস্বার্থ উপেক্ষা করে দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা– এসব হীন অভ্যাস রাজনৈতিক নেতা ও দলগুলোকে ত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় কোনো ব্যবস্থাই কাজে আসবে না। 
জনগণকেও অভ্যাস বদলাতে হবে। কোনো দল, পরিবার বা ব্যক্তির অন্ধ সমর্থক না হয়ে ভালো কাজে সমর্থন, মন্দ কাজে নিন্দা ও প্রতিরোধ করতে হবে। কারও চিরস্থায়ী সমর্থক বা ভোটার না হয়ে হতে হবে বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন সমর্থক। ভালো-মন্দ বিবেচনা করে, উপলক্ষ বুঝে সমর্থন বা বিরোধিতা করতে হবে। তবেই শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরসহ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে। 
চাহিদার তালিকাটি লম্বা; বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়াও কঠিন। কিন্তু আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই; ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। তবে এখন আমাদের একটি সুযোগ এসেছে। রাজনীতিবিদরা যদি উপলব্ধি করতে পারেন– পাঁচ বা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর জেল বা নির্বাসনে যাওয়ার চেয়ে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিরোধী দলে থাকা বেশি সম্মান ও শান্তিদায়ক, তাহলে তারা হয়তো শোধরাবেন। কারণ কেউই তার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে পারে না, কখনও পারবেও না।
আবু আলা মাহমুদুল হাসান: গবেষক,
পরামর্শক ও নৃবিজ্ঞানী