দুর্নীতি একটি জটিল এবং বহুস্তরীয় সামাজিক সমস্যা, যা চিন্তা, মনন, দৈনন্দিন কাজ, পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নৈতিকতা এবং সততার ঘাটতির ফলে দেখা দেয়। ব্যক্তি বা গ্রুপ বিভিন্ন কারণে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারে, যেমন অর্থনৈতিক লাভ, ক্ষমতার অপব্যবহার, সামাজিক অবস্থান বা প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা।
দুর্নীতির আভিধানিক অর্থ হলো, নীতিভ্রষ্ট আচরণ, নৈতিক অধঃপতন বা অসততা এবং অসৎ কাজ। এটি এমন একধরনের কাজ যা নৈতিকতা বা শুদ্ধতার পরিপন্থী এবং সাধারণত কোনো অবৈধ বা অন্যায় উপায়ে ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে করা হয়। দুর্নীতি বা Corruption বলতে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থে অপ্রাপ্য সুবিধা আদায় করা বা নীতিহীনভাবে লাভবান হওয়াকে বোঝায়। এটি সাধারণত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, ও সামাজিক ক্ষেত্রে ঘটে এবং এর ফলে সমাজে নৈতিকতার অবনতি ঘটে, স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের অভাব দেখা দেয়। দুর্নীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economic Development) ও সমাজের স্থিতিশীলতা এবং ভারসাম্য রক্ষায় (Social Stability and Balance)বাধার সৃষ্টি করে।
দুর্নীতির উৎসস্থল
• চিন্তায় ও মননে : চিন্তা বা মননে দুর্নীতির সূত্রপাত তখনই হয় যখন একজন ব্যক্তি বা গ্রুপ কোনো পরিস্থিতিতে স্বার্থান্বেষী চিন্তা করে এবং নৈতিকতা বা সামাজিক দায়িত্ববোধকে উপেক্ষা করে। এটি হতে পারে ব্যক্তিগত লাভের আশায় বা সংস্থার স্বার্থে নৈতিকতাকে ছাপিয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া।
• দৈনন্দিন কাজে: যখন ব্যক্তি তার দৈনন্দিন কাজে সৎ পথে না চলার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সহজভাবে লাভবান হওয়ার উপায় খোঁজে, তখন দুর্নীতির স্থান ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারি কর্মকর্তারা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ গ্রহণ করতে পারে, অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অর্থনৈতিক দুর্নীতি বা জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে পারে।
• পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে: পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দুর্নীতি তখনই হয় যখন ব্যক্তি বা গ্রুপ সচেতনভাবে অন্যায় সুবিধা নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা তৈরি করে। যেমন, কোনো সরকারি প্রকল্পের সিদ্ধান্ত এমনভাবে নেওয়া হয় যাতে সুবিধাভোগী একটি বিশেষ গোষ্ঠী লাভবান হয়, অথচ জনসাধারণ বা প্রকৃত প্রাপ্যরা সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে।
দুর্নীতির স্তর
দুর্নীতি বিভিন্ন স্তরে সংঘটিত হতে পারে, যেমন:
• প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি: যখন কোনো প্রতিষ্ঠান বা তার অংশ বিশেষ পরিকল্পিতভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যেমন, রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতা লাভের জন্য দুর্নীতি।
• রাজনৈতিক দুর্নীতি: রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত বা দলের স্বার্থে অর্থ বা সুবিধা নেওয়া, যেমন ভোট কেনা বা রাজনৈতিক প্রভাব প্রয়োগ।
• অর্থনৈতিক দুর্নীতি: অর্থনৈতিক লেনদেন বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি, যেমন দুর্নীতিপ্রবণ বাণিজ্যিক কার্যক্রম।
• সামাজিক দুর্নীতি: সমাজের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের প্রভাব খাটিয়ে অন্যদের প্রতি অন্যায় আচরণ করা।
• ব্যক্তির একক দুর্নীতিঃ ব্যক্তির একক দুর্নীতি সাধারণত ক্ষুদ্র বা ব্যক্তিগত স্তরের দুর্নীতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ধরনের দুর্নীতিতে একজন ব্যক্তি তার নিজস্ব স্বার্থে, ক্ষমতার অপব্যবহার বা অনৈতিক উপায় অবলম্বন করে ব্যক্তিগত লাভের জন্য কাজ করে।
একক দুর্নীতির বৈশিষ্ট্য
• ক্ষুদ্র দুর্নীতি (Petty Corruption): এটি হলো ব্যক্তির দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে ছোটখাটো দুর্নীতি, যেমন: সরকারি বা বেসরকারি কাজে সেবার বিনিময়ে ঘুষ গ্রহণ বা প্রদান। কোনো কাজ দ্রুত বা বিশেষ সুবিধা নিয়ে সম্পাদনের জন্য অর্থ বা সুবিধার বিনিময়। অফিসের বা কোনো সংস্থার সম্পদ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার।
• অবৈধ সুবিধা গ্রহণ (Illicit Benefit): ব্যক্তি তার অবস্থান বা ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্যায়ভাবে আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ করে। যেমনঃ কোনো চুক্তি থেকে ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়া। অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রমোশন বা অন্য সুযোগ লাভ করা।
• নৈতিকতার লঙ্ঘন (Ethical Breach): এ ধরনের দুর্নীতি তখন ঘটে যখন ব্যক্তি নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে বিচ্যুত হয় এবং নৈতিকতার বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করে। যেমন- দায়িত্বে অবহেলা করে কোনো ক্ষুদ্র আর্থিক লাভ করা। সততা বা স্বচ্ছতার অভাব দেখিয়ে সঠিক তথ্য গোপন করা।
• সংসারের বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করা (Misuse of Resources): ব্যক্তি যখন প্রতিষ্ঠানের অর্থ, সম্পদ বা সুযোগ-সুবিধা নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে, এটি একটি সাধারণ স্তরের একক দুর্নীতি। যেমন: অফিসের গাড়ি বা জিনিসপত্র ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা। কর্মঘণ্টা ঠিকভাবে পালন না করা এবং কাজের সময় অন্য কাজে ব্যস্ত থাকা।
• সুবিধাজনক অবস্থানের অপব্যবহার (Abuse of Power): এ ধরনের দুর্নীতি তখন ঘটে যখন ব্যক্তি তার অবস্থান বা ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের সুবিধার্থে বা অন্য কারও পক্ষ থেকে অর্থ বা সুবিধা নেয়। যেমন: সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্যায় প্রভাব প্রয়োগ। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ প্রভাব খাটানো।
একক দুর্নীতি ধীরে ধীরে বৃহত্তর দুর্নীতির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যেখানে একটি সংস্কৃতি তৈরি হয় যার মাধ্যমে অনৈতিক কাজকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখা হয়। এছাড়াও, একক দুর্নীতি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের প্রতি বিশ্বাস এবং আস্থা কমিয়ে দেয়, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়।
দুর্নীতি দমনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার, নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইনশৃঙ্খলা ও বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা প্রয়োজন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানো অপরিহার্য।
দুর্নীতি ও বৈষম্যের সম্পর্ক
দুর্নীতি ও বৈষম্যের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতি সাধারণত সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি করে এবং বৈষম্যের মাধ্যমে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়।
• দুর্নীতির ফলে বৈষম্য: দুর্নীতি সমাজে অবিচার ও অসমতা সৃষ্টি করে। যারা অর্থ বা ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা সুবিধা পেয়ে যায়, এবং যাদের সেই সুযোগ নেই, তারা বঞ্চিত হয়। এর ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এবং অন্যান্য সুযোগে বৈষম্য তৈরি হয়।
• বৈষম্যের কারণে দুর্নীতি: বৈষম্যপীড়িত মানুষদের জন্য দুর্নীতি কখনও কখনও একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়। তারা বৈধ উপায়ে সুযোগ না পাওয়ায় অনৈতিক উপায় অবলম্বন করে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে।
বাংলাদেশে দুর্নীতির মূল কারণ
• দুর্বল সুশাসন ও আইনের শাসনের অভাব: সুশাসনের অভাব এবং আইনের শাসনের দুর্বলতা দুর্নীতিকে বৃদ্ধি করে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতা কম থাকায় সরকারি কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করেন।
• রাজনৈতিক প্রভাব ও পৃষ্ঠপোষকতা: রাজনীতির সাথে জড়িত অনেক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে অবৈধ উপায়ে অর্থ সংগ্রহ বা সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। রাজনৈতিক দল বা নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির চক্র গড়ে ওঠে, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রশাসনের হাতেও পৌঁছে যায়।
• দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য: বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য অত্যন্ত বড় সমস্যা। অনেকেই চাকরি বা অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার জন্য ঘুষ প্রদান করেন বা দুর্নীতির আশ্রয় নেন। ফলে, দুর্নীতির প্রভাব সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
• স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব: সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার অভাব থাকলে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। অর্থ ব্যয়ের হিসাব এবং নিয়ন্ত্রণের অভাব দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে।
• নাগরিক সচেতনতার অভাব: জনসাধারণের মধ্যে নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতার অভাব দুর্নীতির বিস্তারকে সহায়তা করে। জনগণ প্রায়ই দুর্নীতি সম্পর্কে জানলেও অভিযোগ বা প্রতিবাদ করেন না, যার ফলে দুর্নীতি চলতেই থাকে।
• অর্থনৈতিক অবকাঠামোর দুর্বলতা: দুর্বল আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং অবকাঠামোর অগ্রগতির ঘাটতির কারণে নানা খাতে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। বিশেষ করে সরকারি প্রকল্প ও উন্নয়ন খাতগুলোতে দুর্নীতির প্রবণতা বেশি থাকে।
• সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি: বাংলাদেশে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতি সহ্য করে বা চোখে পড়েও এড়িয়ে যায়। এটি দুর্নীতির প্রতি জনসাধারণের অন্ধ সহিষ্ণুতাকে বৃদ্ধি করে, যা এই সমস্যাকে গভীর করে তোলে।
দুর্নীতির মূল চক্র
• রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ: অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির সাথে সরাসরি জড়িত থাকেন উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদরা, যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দুর্নীতির বিভিন্ন রূপ গড়ে ওঠে।
• সরকারি কর্মকর্তা ও প্রশাসন: সরকারের বিভিন্ন দপ্তর এবং প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে জড়িত থাকতে পারেন, যারা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ গ্রহণ বা অন্যায় সুবিধা আদায় করেন।
• ব্যবসায়িক গোষ্ঠী: বড় বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলো তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। ঘুষ, রাজনৈতিক লবিং এবং অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে তারা নিজেদের সুবিধা নিশ্চিত করে।
• আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী: অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দুর্নীতিতে জড়িত থাকতে দেখা যায়। তারা অপরাধী গোষ্ঠীর সাথে আঁতাত করে ঘুষ বা অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করে।
• বিচার বিভাগ: বিচারিক প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি থাকতে পারে, যেখানে ঘুষ বা রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে মামলা বা রায়ে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করা হয়।
• শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতেও দুর্নীতি দেখা যায়, যেখানে ভর্তি প্রক্রিয়া, সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থ লেনদেন করা হয়।
দুর্নীতি এবং বৈষম্য উভয়ই সমাজের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে এবং একটি দুষ্টচক্র তৈরি করে যেখানে দূর্নীতি বৈষম্যকে বাড়ায়, আবার বৈষম্য দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। দুর্নীতি দমনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার, নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইনশৃঙ্খলা ও বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা প্রয়োজন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানো অপরিহার্য।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।