দেশে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিয়ে নতুন করে বিতর্ক উঠেছে। স্লোগানটিকে আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় স্লোগান নির্ধারণ করেছিল রীতিমতো আইনি প্রক্রিয়ায়। ২০১৭ সালে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১০ মার্চ হাইকোর্ট রায় দেন– ‘জয় বাংলা’ হবে রাষ্ট্রীয় স্লোগান। দুই বছর পরে সরকার প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের সব অনুষ্ঠানে জাতীয় দিবসগুলোতে জয় বাংলা স্লোগান বাধ্যতামূলক করে। হাইকোর্টের রায়টি স্থগিত চেয়ে গত ২ ডিসেম্বর আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। সেই আবেদনে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে ১০ ডিসেম্বর সেটা স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগ। প্রশ্ন হচ্ছে, জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে আবেদন রাষ্ট্রপক্ষের জন্য কতটা জরুরি ছিল?
আমরা জানি, যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে গণমানুষের সম্পৃক্তি বাড়ানোর জন্য দরকার হয় সর্বজন গ্রহণযোগ্য স্লোগান। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিটি খণ্ডযুদ্ধে জয়লাভের পরও মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের উল্লাস ‘জয় বাংলা’ স্লোগানেই প্রকাশ করত। রাজনৈতিক নেতারা যে কোনো ভাষণ শেষ করত ‘জয় বাংলা’ দিয়ে। প্রবাসে মুক্তিকামী মানুষের ও মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় হয়ে উঠেছিল ‘জয় বাংলার লোক’।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল একাত্তরের জনযুদ্ধকে আওয়ামী লীগের যুদ্ধে পরিণত করে। গণমানুষের স্লোগান জয় বাংলাকে করে তোলে আওয়ামী লীগের স্লোগান। এমন অনেক সর্বজনীন অর্জনকে তারা ক্রমশ দলীয় বিষয়ে পরিণত করার ফলে এ দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করার সঙ্গে সঙ্গে সেসব সর্বজনীন চেতনার সম্পদকেও প্রত্যাখ্যান করেছে।
এমন প্রত্যাখ্যানের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে এ বছর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে করা মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গভীর রাতে স্লোগান উঠেছিল– ‘তুমি কে আমি কে/ রাজাকার রাজাকার’। এটি ছিল মূলত স্যাটায়ার স্লোগান। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে যে অযৌক্তিক ও বায়বীয় বিভাজন রেখায় দেশকে দুই ভাগ করেছিল; দুঃশাসনের প্রতিবাদ, এমনকি শেষ দিকে মৃদু সমালোচনাতেও যেভাবে ‘রাজাকার’ গালি দিত; এই স্লোগান ছিল তারই প্রতিবাদ।
৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত সরকার বা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আন্দাজই করতে পারেনি, ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’ ট্যাগ দিয়ে যাদেরকে ‘অপর’ করে রাখা হচ্ছিল, তারা কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যে শেখ মুজিবের জন্য একসময় মানুষ রোজা রেখেছে, ৫ আগস্ট তারাই শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভেঙেছে। শেখ মুজিবকে নয়, তারা অপমান করতে চেয়েছে স্বৈরাচারের সব প্রতীককে। ঠিক একইভাবে মানুষ এখন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনতে চায় না। স্লোগানটি শুনলে মুক্তিযুদ্ধ নয়; তাদের চোখের সামনে গত দেড় দশকের নির্যাতন, গ্রেপ্তার, গুম, আয়নাঘর, জুলাই-আগস্টে গুলিতে পাখির মতো মানুষ হত্যার হিংস্র ছবি ভেসে ওঠে। কিছুতেই এ দেশের মানুষ আর সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে চায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণমানুষের প্রাণের স্পন্দন শুনে যথার্থই বলেছেন, বাংলাদেশ আর নৈরাজ্য ও বৈষম্যের মধ্যে থাকবে না, ফিরেও যাবে না।
এটা ঠিকই, আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধন করে গণবিরোধী অনেক কিছু করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব সংসদের অধীনে নেওয়া, বাকস্বাধীনতা রোধসহ বহু কিছু। সেগুলো যত দ্রুত সম্ভব বাতিল করা দরকার; করাও হচ্ছে। কিন্তু সেই অগ্রাধিকার তালিকায় স্লোগান বদলের বিষয়টি কি থাকতে পারে?
এটাও ঠিক, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেওয়া রায়টি স্থগিত করায় ২০২২ সালে সরকার জারীকৃত প্রজ্ঞাপনটির কার্যকারিতাও স্থগিত হয়েছে। এখন আর জাতীয় দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মসূচিতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া বাধ্যতামূলক থাকবে না। প্রসঙ্গত, রায়টি স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগ; বাতিল করেননি। বাতিল করা-না করার বিষয়টি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার এসে দেখবে।
কেউ কেউ বলছেন, জয় বাংলা স্লোগান দেওয়ার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি স্থগিত না করলে স্কুল-কলেজ, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে এই স্লোগান দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে যেত। স্লোগানটি না দিলে আইন লঙ্ঘন হওয়ার আশঙ্কা থাকত। কিন্তু এতদিন তো কোনো অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টারা কোথাও এই স্লোগান দেননি! অন্যরাও না দিলে কী অসুবিধা হতো? হয়তো ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে যাতে স্লোগানটি দিতে না হয়, সে জন্য তড়িঘড়ি করে স্থগিতাদেশ চাওয়া হয়েছে।
কথা হচ্ছে, এ দেশের মানুষের আবেগের সঙ্গে, এই রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি যুক্ত। যদিও আওয়ামী দুঃশাসনের কারণে এখন নাগরিকদের বড় অংশ স্লোগানটি পছন্দ করছে না। কিন্তু আমরা আওয়ামী লীগের ওপর রাগ করে আমাদের ঐতিহাসিক সত্য অস্বীকার করব, নাকি জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদগুলোকে বরং সর্বজনীন করে তুলব?
মনে রাখতে হবে, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিত রাষ্ট্র সংস্কার, খুনিদের বিচার, আহতদের সুচিকিৎসা, হতাহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, দুর্নীতি দূর করা, পাচারের অর্থ ফিরিয়ে আনা, নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি এবং উৎপাদন ও অর্থনীতিতে গতি আনা। সেখানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান স্থগিত করার বিষয়টি অগ্রাধিকারের তালিকায় আসে কীভাবে? এ ধরনের কাজ বরং অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলবে এবং অজনপ্রিয় করে তুলতে পারে।
কাজী জহিরুল ইসলাম: কবি, কথাসাহিত্যিক