ভারত-বাংলাদেশ ইনফরমেশন ওয়ারফেয়ার

মো. সামসুল ইসলাম
  ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:০৬

বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের পর ভারত-বাংলাদেশ ইনফরমেশন ওয়ারফেয়ার, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের প্রোপাগান্ডা, আমাকে অনেকটাই নস্টালজিক করে তুলেছে। বেশ আগে দেশের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ থিংকট্যাংকে কাজ করার সময় আমি যখন ছুটি নিয়ে ব্রিটেনে পোস্ট-গ্রাজুয়েশন করতে যাই‌, তখন আমি মিডিয়া অ্যান্ড সিকিউরিটি বিষয়ে স্পেশালাইজেশনে আগ্রহী হই। প্রোপাগান্ডা, সাইকোলজিক্যাল অপারেশনস, ইনফরমেশন ওয়ারফেয়ার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমাকে তখন পড়তে হয়েছিল।
পরে বিভিন্ন জার্নালে, পত্র-পত্রিকায় আমার এ সংক্রান্ত বিষয়ে লেখা ছাপা হয়। এছাড়া বিভিন্ন কনফারেন্সে আমি এসব বিষয়ে পেপার প্রেজেন্ট করি। বাংলায় প্রকাশিত আমার বইয়ে এসব নিয়ে বেশ কিছু লেখা আছে।
বিগত কয়েক শতক ধরে সামরিক ক্ষেত্রে আলোচিত রেভ্যুলিউশন ইন মিলিটারি অ্যাফেয়ার্স বা RMA এর ধারণা অনুসারে যোগাযোগ ও গণমাধ্যম একটি দেশের পক্ষে শুধু যে জনমত গঠন বা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর আচরণ পরিবর্তন করে তা নয় বরং এটি সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে প্রয়োজনের মুহূর্তে ব্যবহৃত হয়।
ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের দেশের মিডিয়ায় বা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যে প্রচারণা চালাচ্ছে সেটাকে এক ধরনের যুদ্ধের অংশই বলা যেতে পারে যা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের কথা তো সবার মনে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া তো বিশ্বব্যাপী প্রচার করেছিল যে ইরাকের ব্যাপক মাত্রায় বিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে যার মধ্যে আছে রাসায়নিক এবং জীবাণু অস্ত্র। বিশ্ব জনমতের সমর্থনের জন্য এই ন্যারেটিভ যুক্তরাষ্ট্র এবং  তার সহযোগী দেশগুলো খুব ভালোভাবে ব্যবহার করে এবং বিশ্ববাসী তা বিশ্বাস করা শুরু করে।
যদিও পরবর্তীতে ইরাক ধ্বংসের পরে এর কোনও সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্ত এর মূল্য তো ইরাককে দিতে হয়েছে।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন বা দেশের কথিত ইসলামাইজেশন নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার বাড়াবাড়িতো ইতিমধ্যে অনেকদূর গড়িয়েছে। ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের পর এ প্রচারণার ফলাফল কী হতে পারে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক হচ্ছে। নির্বাচনের আগমুহূর্তে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে  ট্রাম্পের টুইটের কারণে এ শংকা জাগিয়েছে।
দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা তো কেউ অস্বীকার করে না। দক্ষিণ এশিয়ায় তো এটি একটি অপরিহার্য বাস্তবতা। ভারতেও মুসলমানরা তো ব্যাপকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। বিগত সরকারের সময় যে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়নি তা নয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রধান বিচারপতিকে তো ভয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। এরকম অনেক ঘটনাই রয়েছে। কিন্তু সে সময় ভারতীয় মিডিয়াতো বংলাদেশের বিরুদ্ধে এরকম ভয়াবহ প্রচারণা চালায়নি!
এটা ভুলে গেলে চলবে না যে ভারতীয় যে বয়ান সে দেশের মিডিয়া প্রচার করেছে তা অনেকাংশেই বিগত সরকারের সময়ে সৃষ্ট। আওয়ামী লীগের সরকার ভারত এবং পশ্চিমের অনেক দেশকেই বোঝাতে চেয়েছে যে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও জঙ্গিবাদের উত্থান ঠেকাতে আওয়ামী লীগ অপরিহার্য। সেটা গণতন্ত্রের বিনিময়ে হলেও হোক। সেই প্রচারণা যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়নি সেটা আওয়ামী লীগের দীর্ঘশাসন প্রমাণ করে।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ এক্ষেত্রে কী করতে পারে? ভারতের সাথে অবশ্যই আমাদের সুসম্পর্ক থাকতে হবে এবং তা হতে হবে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে। ভারতকে এটা বোঝাতে হবে যে, তাদের দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক হতে হবে বাংলাদেশের জনগণের সাথে, কোনও নির্দিষ্ট একটি দলের সাথে নয়। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সকল পথই বাংলাদেশকে খুঁজতে হবে।
তবে আমি শুরুতেই যেটা বলতে চেয়েছি যা মিডিয়ায় কোনও দেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা সে দেশের স্ট্র্যাটেজিক অবজেকটিভস বা কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের একটি পদ্ধতি। সুতরাং ভারতীয় প্রচারণাকে হালকা ভাবে নেওয়ার কোনও অবকাশ নেই। আরো ভয়ংকর ব্যাপার যে ভারতের সব রাজনৈতিক দল এবং মিডিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মোটামুটি একই ভাষায় কথা বলছে। অনেক বিদেশি রাষ্ট্রও ভারতের ভাষায় কথা বলা শুরু করেছে।
সম্প্রতি ভারতে ইসরায়েলি এক কূটনীতিক বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের নিন্দা জানিয়েছেন বলে মিডিয়ায় খবর এসেছে।  
সুতরাং ভারতের এই ডিসইনফরমেশন ক্যাম্পেইনকে বাংলাদেশের সার্বিক প্রতিরক্ষা কৌশলের আঙ্গিকে দেখতে হবে এবং সে অনুযায়ী দেশের প্রতিরক্ষা নীতি ও পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংস্কার আনতে হবে এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে যা করণীয় তাই করতে হবে। জনপরিসরে এবং সুশীল সমাজের মধ্যে আমাদের মতো একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে হবে এবং বাংলাদেশকে তার করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যে কোনও বিশেষজ্ঞ এই কথাই বলবেন। কোনও কোনও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে কথা বলা শুরুও করেছেন।
ডিসইনফরমেশন ক্যাম্পেইনকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মিডিয়া, এবং প্রবাসে অবস্থিত বিদেশি মিডিয়ার কিছু বাংলাদেশি সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টরা কাজ করছেন এবং তারা ভালো ভূমিকা রাখছেন। নিঃসন্দেহে তারা প্রশংসার দাবিদার।
কিন্তু ডিসইনফরমেশনের ক্ষেত্রে শুধু সত্য প্রকাশ বা debunk করাই যথেষ্ট নয়।  শুধু রি-অ্যাক্টিভ হলেই হবে না বরং প্রো-অ্যাক্টিভ হতে হবে। ন্যাটোর হোমপেজে pre-bunk কৌশলের কথা বলা হচ্ছে অর্থাৎ প্রতিকূল বা hostile ন্যারেটিভ এর ক্ষেত্রে আগাম সতর্কতার কৌশল। দেশকে এব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ কাজে লাগাতে হবে।  
বাংলাদেশের সফট পাওয়ার বাড়ানোর কোনও বিকল্প নেই। এব্যাপারে আমি অনেক লিখেছি। কালচারাল ডিপ্লোম্যাসিতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। অন্যান্য দেশের সাধারণ নাগরিকরা বাংলাদেশের হয়ে কতটুকু কথা বলবে?
ভারত প্রতিবছর বিভিন্ন সেক্টর থেকে ১০০জন তরুণকে সে দেশে নিয়ে যায় ভারত সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য।
ভারতসহ বিশ্বের কয়টি দেশের সাথে বাংলাদেশের এধরনের প্রোগ্রাম আছে? বিশ্বের কয়টি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফ্যাকাল্টি ও স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম আছে? ধরা যাক আজ যদি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর অনেক ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি থাকতো, তারাই তো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে কথা বলতেন!
এদেশে কতটুকু সংখ্যালঘু নির্যাতন বা ইসলামাইজেশন হচ্ছে তার সঠিক চিত্র জানাতে পারতেন। কালচারাল ডিপ্লোম্যাসিতো এভাবেই কাজ করে। এসব নিয়ে তো প্রচুর লেখা যায়। কিন্তু স্বল্পপরিসরে সেটা সম্ভব নয়।
সামরিক ক্ষেত্রে যুদ্ধ নিয়ে সনাতন ধারণার কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে। যুদ্ধ যে শুধু মাত্র যুদ্ধক্ষেত্রেই হয় এখন সেরকম ভাবা হয় না। সামরিক বিশেষজ্ঞরা জানেন third wave warfare এখন C4I warfare এ পরিণত হয়েছে অর্থাৎ command, control, communications, computers, intelligence warfare । ইংল্যান্ডে আমার শিক্ষক বিশ্বখ্যাত প্রোপাগান্ডা বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ফিলিপ টেইলর, যিনি ন্যাটোর একজন মিডিয়া কনসালট্যান্ট ছিলেন মজা করেই এটিকে তার বইয়ে লিখেছিলেন C5I হিসেবে। অর্থাৎ command, control, communications, computers, intelligence – and the CNN! অর্থাৎ আধুনিক যুদ্ধে টেলিভিশন তথা সিএনএন এর ভুমিকা কম নয়।
ভারতীয় রিপাবলিক টিভিসহ বেশ কিছু মিডিয়া বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, ভৌগলিক অখণ্ডতা ইত্যাদি নিয়ে যেসব প্রশ্ন তুলছে সেটা কিন্তু এক ধরনের আধুনিক যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির প্রচেষ্টাই বলা যায়। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ঝুঁকি ভেবে দেশের জনগণ এটাকে সহজভাবে নিতে পারছে না। আমরা ভারতের কাছে সৎ প্রতিবেশীমূলক আচরণ প্রত্যাশা করি।  
লেখক: কলামিস্ট
সূত্র : বালা ট্রিবিউন