প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, প্রাচীন গ্রিসে দুই বৃহৎ শক্তি স্পার্টা ও এথেন্স এক অনিবার্য সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। স্পার্টা ছিল প্রতিষ্ঠিত শক্তি, আর এথেন্স ছিল উঠতি শক্তি। থুসিডাইডিস, প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ, এ সংঘাতের কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। তার মতে, এথেন্সের দ্রুত উত্থান স্পার্টার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত তাদের যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। এই তত্ত্ব, যা ‘থুসিডাইডিস ট্র্যাপ' নামে পরিচিত, আমাদের বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বোঝার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে একই রকম চিত্র ফুটে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এবং প্রতিষ্ঠিত শক্তি হিসেবে আধিপত্য ধরে রেখেছে। অন্যদিকে, চীন এক অভাবনীয় গতিতে বিশ্বমঞ্চে উঠে এসেছে। এ প্রতিযোগিতা শুধু অর্থনীতি বা প্রযুক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি সামরিক শক্তি, ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব, এমনকি মানসিক আধিপত্যের দিকেও বিস্তৃত।
চীনের উত্থান: নেপোলিয়ন বোনাপার্ট প্রায় দুই শতাব্দী আগে বলেছিলেন, 'চীন ঘুমন্ত সিংহ; তাকে ঘুমাতে দাও । যদি সে জাগে, সারা বিশ্ব কাঁপবে।' তার এই ভবিষ্যদ্বাণী আজ বাস্তব। নব্বইয়ের দশকেও চীন ছিল কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল একটি দেশ। কিন্তু মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে তারা বিশ্বের শীর্ষ শিল্প উৎপাদনকারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তারা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চীনের বর্তমান আচরণ স্পষ্টতই শক্তি প্রদর্শনের দিকে ইঙ্গিত করে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী ভূমিকা, তাইওয়ানের প্রতি তাদের কৌশলগত অবস্থান এবং সারা বিশ্বে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ'-এর মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা প্রমাণ করে যে চীন বিশ্ব আধিপত্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের চীন নীতি কী এবং সামনে কী হতে পারে? ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি (২০১৭-২০২১) যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কের গতিপথ পালটে দেয়। । পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টরা চীনের উত্থানকে মোকাবিলায় কূটনৈতিক বা নরম নীতি অবলম্বন করলেও, ট্রাম্প তার নীতিকে আগ্রাসী ও অকপট রাখেন। তার প্রশাসন চীনকে ‘অর্থনৈতিক প্রতিপক্ষ’ এবং ‘ভূ- রাজনৈতিক হুমকি' হিসেবে ঘোষণা করে ।
ট্রাম্পের চীন নীতির প্রধান দিকগুলো ছিল
(ক) ট্রেড ওয়ার: ট্রাম্প প্রশাসন চীনের বিরুদ্ধে বিশাল অঙ্কের শুল্ক আরোপ করে । তাদের অভিযোগ ছিল চীন দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, মার্কিন প্রযুক্তি চুরি করছে, এবং ‘বাজারে ন্যায্য প্রতিযোগিতা' নষ্ট করছে। ট্রাম্প প্রায় ৩৭০ বিলিয়ন ডলারের চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেন। চীনের পালটা শুল্ক আরোপে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ধস নামিয়ে দেয় ।
(খ) টেকনোলজি রেস : ট্রাম্প চীনের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। বিশেষ করে, হুয়াওয়ে এবং টিকটকের মতো কোম্পানিগুলোকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেন । এই নীতির ফলে চীনা কোম্পানিগুলোর উপর পশ্চিমা বাজারে প্রবেশে সীমাবদ্ধতা আরোপিত হয়।
(গ) তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর : ট্রাম্প প্রশাসন তাইওয়ানের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দেখান এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ করে। চীনের দক্ষিণ চীন সাগরে আগ্রাসী ভূমিকার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনী মোতায়েন করে, যা চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে আরো উত্তপ্ত করে তোলে ।
(ঘ) চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা : ট্রাম্প চীনের উইঘুর মুসলিমদের ওপর দমননীতি এবং হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনের ওপর দমনমূলক আচরণের সমালোচনা করেন। তিনি এই ইস্যুগুলোকে চীনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কূটনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন ।
বর্তমান সময়ে ভূ-রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি। একসময় এই শিল্পে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপ এবং চীন তাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে এই প্রতিযোগিতাকে তীব্র করে তুলেছে। সেমিকন্ডাক্টর শুধু ইলেকট্রনিক ডিভাইস নয়; এটি সামরিক সরঞ্জাম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মহাকাশ গবেষণার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন এখন চিপ আমদানিতে তেল আমদানির চেয়েও বেশি ব্যয় করছে। তাদের লক্ষ্য স্পষ্ট : চিপ তৈরির ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল হওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাওয়া ।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা রোধ করার জন্য সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি সরবরাহের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এর ফলে চীনের সামরিক আধুনিকীকরণ এবং অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ানোর প্রচেষ্টা ধীরগতিতে পড়েছে। তবে চীন এই খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে, যা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অতীত থেকে শিক্ষা : বিশ শতকের শুরুতে জাপানের উত্থান চীনের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ। ১৮৫৩ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর কমডোর ম্যাথিউ পেরি জাপানকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য তাদের বন্দর খুলে দিতে বাধ্য করেছিলেন । এরপরে জাপান দ্রুত শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং তাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়িয়ে তুলতে থাকে। তবে প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে বিরোধ এবং রাশিয়ার মতো প্রতিষ্ঠিত শক্তির সঙ্গে সংঘাত জাপানকে একাধিক যুদ্ধে জড়িয়ে দেয় । জাপানের এই ইতিহাস আমাদের বর্তমান সময়ের চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা বুঝতে সাহায্য করে। চীনের অর্থনৈতিক উত্থান, সামরিক আধুনিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা অনেকটাই জাপানের আগ্রাসী মনোভাবের পুনরাবৃত্তি।
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই চীনের এই উত্থান সম্পর্কে সচেতন। তারা শুধু সামরিক বা অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়; প্রযুক্তি, তথ্য প্রবাহ এবং কৌশলগত জোট গঠন করেও চীনের প্রভাবকে সীমিত করার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্র দেশগুলো, বিশেষত জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপের সঙ্গে জোট গড়ে তুলছে। এছাড়া, তাইওয়ানকে কৌশলগতভাবে সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে তারা চীনের আধিপত্য বিস্তারের পথে বড় বাধা তৈরি করছে। তাইওয়ান হলো সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল, যা চীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাইওয়ান ইস্যুতে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে পারে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতি থুসিডাইডিসের তত্ত্বের যথার্থ উদাহরণ । যখন একটি নতুন শক্তি একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তির আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে, তখন যুদ্ধের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। প্রশ্ন হলো, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র কি এই সংঘাত এড়াতে পারবে, নাকি তারা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করবে?
বিশ্ব রাজনীতির বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, এই সংঘাত যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে তা একটি বড় যুদ্ধ বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হতে পারে। তবে কূটনৈতিক সমাধান এখনো সম্ভব। দুই পক্ষের মধ্যকার সংলাপ এবং সহযোগিতা থুসিডাইডিস ট্র্যাপ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় ।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু । এটি শুধু এই দুই দেশের জন্য নয়; গোটা বিশ্বের জন্যই গভীর উদ্বেগের কারণ । যদি তারা ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে ফলাফল হবে ভয়াবহ। তবে কূটনৈতিক আলোচনা, যৌথ উদ্যোগ এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতার মাধ্যমে এই সংঘাতকে এড়ানো সম্ভব। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে দুই রাষ্ট্রের নেতৃত্ব এবং তাদের দূরদৃষ্টির ওপর। যুদ্ধ কিংবা শান্তি—চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ওপরই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ বিশ্বের স্থিতিশীলতা ।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল স্টাডিজ
সূত্র: ইত্তেফাক