ওয়ান-ইলেভেন বা এক-এগারোর সরকার নামে পরিচিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মইনুল হোসেন সবশেষ আলোচনায় এসেছিলেন জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময়। মৃত্যুর সাত মাস পরে পুলিশ তাকে ধরতে বা তার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বারিধারার বাসায় গিয়েছিল— এরকম একটি সংবাদ নিয়ে তখন বেশ তোলপাড় শুরু হয়— যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানানজন নানা রকম রসিকতাও করেছেন।
‘আউট স্পোকেন’ হিসেবে খ্যাত ব্যারিস্টার মইনুল বহুবিধ কারণেই আলোচিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে যখন সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী এনে ‘বাকশাল’ নামে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়, তখন হাতেগোণা যে দু-চারজন মানুষ প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করেছিলেন, মইনুল তাদের অন্যতম।
মিজানুর রহমান চৌধুরী লিখেছেন: “যারা বাকশালের পক্ষে বলেন তাদের যুক্তির চেয়ে আবেগই বেশি প্রকাশিত হতে থাকে। যেমন, ‘বঙ্গবন্ধু আপনি যাই করেন সেটাই ভালো, যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই সঠিক এবং যা বলেন, সেটাই শেষ কথা’ ইত্যাদি। কাজেই পক্ষে বলাটা খুবই সহজ। কিন্তু এর মধ্যে নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ গোপনে আলাপ-আলোচনা করে সাব্যস্ত করেন যে, বাকশাল কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করা যাবে না। সে হিসেবে সভায় জেনারেল ওসমানী, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও নূরে আলম সিদ্দিকী অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ জোরালো বক্তব্যের মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতা করলেন।” (মিজানুর রহমান চৌধুরী, রাজনীতির তিন কাল, অনন্যা/২০০৩, পৃ. ১৫৩)।
বস্তুত এরপরে মইনুল হোসেন আর সেভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। দীর্ঘদিন পরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি যখন ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়, তখন তিনি এই সরকারের আইন ও তথ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব পান।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যেমন ‘সংস্কার’ শব্দটি খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলেও শব্দটি ব্যাপক আকারে ব্যবহৃত হচ্ছিল। বিশেষ করে রাজনৈতিক সংস্কার এবং ওই সংস্কারের অংশ হিসেবে তখন মাইনাস টু (হাসিনা-খালেদা) ফর্মুলা নিয়েও বেশ আলোচনা হয় এবং এক-এগারোর সরকারের বিরুদ্ধে অন্যতম বড় অভিযোগ হলো তারা দেশের প্রধান দুই দলের নেত্রীকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসনামলের অভিজ্ঞতার আলোকে একটি বইতে মইনুল হোসেন লিখেছেন: “মাইনাস টু ফর্মুলা আমাদের সময়ের অত্যন্ত আলোচিত একটি বিষয় ছিল। কিন্তু মাইনাস টু ফর্মুলা আমাদের কোন ফর্মুলা বলিয়া আমি বা আমরা কখনও দাবি করি নাই। তবে ইহা সত্য যে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রেক্ষাপটে দুই প্রধান দলের দুই নেত্রীর কি ভূমিকা হইবে তাহা নিয়া অনেকের নিকট হইতে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ আসিয়াছে। রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়া তখন কম-বেশী সবাই দুশ্চিন্তায় ছিলেন। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতারা একত্রে বসিয়া কোন রাজনৈতিক সমস্যা নিয়া আলোচনা করিতে পারিবেন না, বিদেশীদের ছোটাছুটি করিতে হইবে আমাদের দলীয় রাজনীতির বিভেদ দূরীকরণের জন্য— এই ধরনের পরিস্থিতি সঠিক রাজনীতির কথা হইতে পারে না। এই ধরনের উপলদ্ধি আমারও ছিল। যে কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যাপারে আমি বহুদিন হইতেই উদ্বেগ প্রকাশ করিতেছিলাম।” (মইনুল হোসেন, গণতন্ত্রের সাফল্য চাহিয়াছি, সিটি পাবলিশিং হাউজ/২০০৯, পৃ. ৪৮)। দেশের রাজনীতিতে ফের ওয়ান-ইলেভেন বা এক-এগারো শব্দটি উচ্চারিত হচ্ছে সম্প্রতি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি বক্তব্যের সূত্র ধরে এক-এগারোর প্রসঙ্গ টেনেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তারপর এ নিয়ে চলছে কথার লড়াই। সত্যিই কি রাজনীতিতে এক-এগারোর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে?
এক-এগারো কী?
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, সেটিকেই সংক্ষেপে ওয়ান ইলেভেন বা এক-এগারোরর সরকার বলে অভিহিত করা হয়। এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার জন্য আরও তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০১, ১৯৯৬, ১৯৯১) দায়িত্ব পালন করলেও সেসব সরকারের এরকম কোনো বিশেষণ দেয়া হয় না। কারণ ওই সরকারগুলো নির্ধারিত তিন মাস সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু ২০০৭ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি সাংবিধানিকভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেও এটি নির্ধারিত তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে পারেনি। তারা দুই বছর সময় নিয়েছে— যার উদ্দেশ্য ছিল নতুন করে ভোটার তালিকা তৈরি এবং রাজনৈতিক দল ও নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কার। কিন্তু নানা কারণেই এই সরকার বিতর্কিত হয় এবং ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরে তাদেরকে এক-এগারোর সরকার বলে অভিহিত করা হয় মূলত নেতিবাচক অর্থে। যে কারণে ‘এক-এগারোর কুশীলব’ শব্দটিও রাজনীতিবিদরা ব্যবহার করতে থাকেন। তারা এই সরকারের বিরুদ্ধে নানাবিধ ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন।
এক-এগারো সরকারের আমলে কী হয়েছিল তা দেশবাসীর অজানা নয়। ওই আমলে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বাইরেও অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীও গ্রেপ্তার হয়েছেন। সেরকম একজন মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম। সরকারের কিছু পরিত্যক্ত সম্পত্তি (প্লট) বিক্রির প্রক্রিয়ায় রাজউকের মূল্যায়ন ও দরপত্র কমিটির সভার কার্যবিবরণীতে স্বাক্ষর থাকার কারণে যোগসাজশ/অনিয়মের সহযোগী হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বছরখানেক তিনি বন্দি ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। জেল থেকে বেরিয়ে লিখেছেন সেই অভিজ্ঞতার কথা।
তার ভাষায়, “দেশের স্বার্থান্বেষী ও পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে পুঁজি করে উচ্চাভিলাষী সেনাসদস্যদের সমর্থনে একটি বুদ্ধিজীবী চক্র (!) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নেয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের অনভিজ্ঞতা ও ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করে ধরে রাখার প্রয়াসে স্বল্পতম সময়ের ব্যবধানে সর্বক্ষেত্রে অস্থিরতা ও হতাশার সৃষ্টি হয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ভেঙে জরুরি অবস্থা বহাল রেখেই এই তথাকথিত নিরপেক্ষ সরকার দুবছর দেশ পরিচালনা করে। শুরুতে তারা অনেক বাগাড়ম্বর কথাবার্তা বলে, অনেক কিছু করতে চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত আবার পিছটান দেয়, যা ছিল প্রকান্তরে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচির মতো।…দুর্নীতি দমনের নামে বাড়াবাড়িতে একটি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নে বিপুল ধস নামে, যার দায়-দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে তা ভবিতব্যই জানে। (মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম, ১/১১-এর একজন বন্দির কথা, আগামী প্রকাশনী/২০১০, পৃ. ৯)।
প্রশ্ন হলো, এক-এগারোর সরকারের সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কি কোনো মিল আছে? দুটি জায়গায় মিল আছে। প্রথমত এক-এগারোর সরকার ছিল সেনা নিয়ন্ত্রিত একটি নির্দলীয় বা সুশীল সরকার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও সেনা সমর্থিত— ওই বিষয়ে সম্ভবত কারও দ্বিমত নেই এবং এই সরকারটি নির্দলীয়। এই সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যারা আছেন, তাদের মধ্যে তিনজন ছাত্র উপদেষ্টা বাদে বাকি সবাই বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের লোক অথবা শিক্ষক। তার মানে এটিও একধরনের সেনা সমর্থিত সুশীল সরকার। দ্বিতীয়ত, এক-এগারোর সরকারের সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আরেকটি মিল হলো, এক-এগারোর সরকার এসেছিল রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা তথা তাদের মধ্যে অনৈক্যের কারণে সৃষ্ট একটি ভয়াবহ সংঘাতময় পরিস্থিতির ভেতরে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও একটি বড় অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে— যেখানে রাজনৈতিক ব্যর্থতাই প্রধান।
ফের কেন আলোচনায়?
গত ২৩ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদের ৫৬তম শাহাদতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বেশ কিছু বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি নিরপেক্ষ না থাকে তাহলে একটা নিরপেক্ষ সরকার দরকার হবে নির্বাচনের সময়ে। কারণ হচ্ছে, আমরা দেখছি যে, বেশ কিছু বিষয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষতা পালন করতে পারছেন না।”
মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্য নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। নিজের ভেরিফায়েড ফেইসবুক ওয়ালে পোস্ট দেন জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি লিখেছেন: “বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা এক-এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে। এক-এগারো -এর বন্দোবস্ত থেকেই আওয়ামী ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটেছিলো। বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে সামনে আরেকটা এক-এগারো সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকান্ডের বিচার না হওয়ার আলামত রয়েছে।”
নাহিদ আরও লিখেছেন, “আমরা চেয়েছিলাম ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ও নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে একটা জাতীয় সরকার। জাতীয় সরকার হলে ছাত্রদের হয়তো সরকারে আসার প্রয়োজন হতো না। জাতীয় সরকার অনেকদিন স্থায়ী হবে এই বিবেচনায় বিএনপি জাতীয় সরকারে রাজী হয় নাই। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরেই দেশে জাতীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি ছিল। অথচ বিএনপি জাতীয় সরকারের কথা বলতেছে সামনের নির্বাচনের পরে।” নাহিদের ভাষায়: “মির্জা ফখরুলের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে এবং ছাত্র-জনতা কোনোভাবেই এটা মেনে নেবে না।”
মির্জা ফখরুল সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সরকারে থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করা উচিত নয়। এই বক্তব্যের জবাবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ লিখেছেন: “উপদেষ্টাদের কেউ রাজনীতি করলে সরকার থেকে বের হয়েই করবে।” সরকারের কাজে দলীয় হস্তক্ষেপ করা উচিত নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমও তাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। সারজিস আলম তার ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “নাহিদ ইসলামের আজকের পোস্টটা দিনে ৩ বার করে আগামী ৭দিন পড়বেন। অবশ্যই পড়বেন।” তিনি কাকে পড়তে বললেন, বিএনপির মহাসচিবকে না দেশবাসীকে— সেটি অবশ্য পরিষ্কার নয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বিএনপিকে ইঙ্গিত করে ফেইসবুকে লিখেছেন: “যারা আগে আন্দোলনের ডাক দিয়ে মাঠ থেকে সরে যেতো, তারাই এখন আঁতাতের রাজনীতি, ভারতনির্ভর কূটনীতির মাধ্যমে আওয়ামী পুনর্বাসন চাচ্ছে। দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় কার সাথে কে ব্যবসা করেছে, আর গ্রেফতারের পর কে কার জন্য তদবির করেছে এই খবর আমাদের কাছে আছে।”
একই দিন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ফেইসবুকে লিখেছেন: “গণঅভ্যুত্থানের অঙ্গীকার ছিল—ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলোপ ও একটি গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা। ৩ তারিখে লাখো জনতার সামনে নাহিদ ইসলাম সাহসিকতার সঙ্গে এই ঘোষণা প্রদান করেন। এখন সময় এসেছে এই প্রতিশ্রুতিকে লিখিত আকারে রূপ দেওয়ার, যা হবে আগামীর গণপরিষদ নির্বাচনের ভিত্তি এবং যার মাধ্যমে জনগণ তাদের স্বপ্নের সংবিধান প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাবে। জনগণের এই ঐতিহাসিক লড়াইয়ে কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর বাধা প্রদান মেনে নেওয়া হবে না। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, আর এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই সত্য প্রতিষ্ঠিত।”
এর দুদিন আগে ২১ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিজের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজে লিখেছেন: “জুলাই গণহত্যার খুনীদের আমরা চিনি। কিন্তু গণহত্যায় জড়িত ফ্যাসিবাদের দালাল আর দোসররা কে কোথায় আছে? যাবতীয় দেশি-বিদেশি স্যাবোট্যাজের পিছনে তারা আছে। তাদের নিয়ে কথা বলুন। তাদেরকে আইনগত শাস্তির আওতায় আনতে সরকারকে সহযোগিতা করুন। ফ্যাসিবাদের দালাল ও দোসরদের জনগণের কাছে ঘৃণিত করে তুলুন, ক্ষমাপ্রার্থনা না করলে ও শাস্তিপ্রাপ্তি না হলে তাদের গ্রহণ করবেন না। তাদের বর্জন করুন, তাদের চক্রান্ত রুখে দিন।” মাহফুজ আলম এই পোস্টে সরাসরি কোনো দলের নাম উল্লেখ না করলেও চক্রান্ত শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তার মানে তারা প্রত্যেকেই একটা চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন— সেটি হোক এক-এগারোর মতো বা অন্য কিছু।
মির্জা আব্বাসের প্রতিক্রিয়া
অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা এবং নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মির্জা ফখরুলের বক্তব্য নিয়ে যখন সরকার ও তাদের অংশীজনরা নানাবিধ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, বিশেষ করে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের ভেতরে যে এক-এগারোর ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেলেন, ওই বিষয়ে বেশ কড়া মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। এক-এগারোর সঙ্গে বিএনপিকে যুক্ত করে ভিন্ন শিবিরে ঠেলে দেয়ার চক্রান্ত হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, এর পরিণতি শুভ হবে না।
২৪ জানুয়ারি রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আরাফাত রহমান কোকোর ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া মাহফিলে মির্জা আব্বাস বলেন, “এক-এগারোর ভয়াবহ পরিণতি বিএনপির চাইতে কেউ বেশি ভোগ করেনি। সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া পর্যন্ত ওই এক-এগারোর ষড়যন্ত্র থেকে রেহাই পায়নি। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করারও চেষ্টা হয়েছে।”
কেন এক-এগারোর গন্ধ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক-এগারো মূলত একটি প্রতীকী শব্দ— যেটি ষড়যন্ত্র বা চক্রান্তের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের ভেতরে যে এক-এগারোর গন্ধ পাচ্ছেন, সেটি মূলত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের গন্ধ। প্রশ্ন হলো, এক-এগারোর মতো পরিস্থিতি যদি তৈরি হয়, তাহলে কী হবে? বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ভেঙে দিয়ে আরেকটি সরকার গঠিত হবে যেখানে ২০০৭-০৮ সালের মতো সেনাবাহিনী ফ্রন্টলাইনে থাকবে? ওই সম্ভাবনা আসলে কতটুকু? সম্ভবত সেরকম পরিস্থিতি তৈরি হবে না। কেননা সেনাপ্রধান সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নিজের মেয়াদকালে তিনি রাজনীতিতে নাক গলাবেন না।
নাহিদ ইসলাম বলছেন, “বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে আরেকটা এক-এগারো সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নতজানু পররাষ্ট্র নীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার আলামত রয়েছে।” তার মানে কি এই যে অন্তর্বর্তী সরকার বা ছাত্র সমন্বয়করা মনে করছেন যে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না? ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা’ বলতে তিনি কী বুঝিয়েছে সেটি স্পষ্ট যে, ভারত বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশকে যেভাবে তার রাজ্য বানিয়ে রাখতে চেয়েছিল এবং বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলগুলোও যেভাবে ভারতের সঙ্গে শক্ত ও মেরুদণ্ডসম্পন্ন কূটনীতি বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে— সেটির ধারাবাহিকতা তিনি চান না। দেশের কোনো মানুষই এ ধরনের কূটনীতি চায় না। কিন্তু ‘সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ শব্দ দুটি দিয়ে তিনি কী বুঝতে চাইলেন সেটি একটু বোঝা দরকার। তিনি কি মনে করছেন যে, এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করলে সরকারের যেরকম স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠার শঙ্কা থাকে— বিএনপিও তাই হবে?
মির্জা আব্বাস যে প্রশ্নটি করলেন যে, এক-এগারোর সঙ্গে বিএনপিকে যুক্ত করে ভিন্ন শিবিরে ঠেলে দেয়ার চক্রান্ত হচ্ছে এবং এর পরিণতি শুভ হবে না— সেটিই বা কী ইঙ্গিত বহন করে? তিনি কি মনে করছেন যে, এই ধরনের বিতর্ক দেশকে আরও বড় সংকটের দিকে নিয়ে যাবে এবং তার ফলে নির্বাচনটি অধিকতর বিলম্বিত হবে?
বিএনপিকে ভিন্ন শিবিরে ঠেলে দেয়া নাকি বিএনপি নিজেই ভিন্ন শিবিরে যাচ্ছে বা যেতে চাচ্ছে— ওই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেননা যে জুলাই অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের পতন হলো, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তার সম্মুখসারিতে থাকলেও বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অপরাপর ছোট দলগুলোও সক্রিয় ছিল। কৌশলগত কারণে তারা হয়তো এই আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনি। করলে সরকার এটিকে সরকার পতনের আন্দোলন হিসেবে বিবেচনা করে অন্যভাবে মোকাবেলা করত। কিন্তু এটি মানতে হবে যে, রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া শুধু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একার পক্ষে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব ছিল না।
বিএনপি কি বিরোধী দল?
৫ অগাস্টের পরে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো সেখানে ছাত্রদের পাশাপাশি বিএনপি এবং অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দলই গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার। কিন্তু দেখা গেল, দ্রুতই সরকার এবং সরকারের প্রধান স্টেকহোল্ডার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। তার প্রধান কারণ, বিএনপি যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন চায়। আর সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি এমনকি জামায়াত ও অন্যান্য দলগুলোও নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপির মতো শক্ত অবস্থান নেয়নি। তাছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার দেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে খুব বেশি সফল হতে পারছে বলে বিএনপি মনে করে না। উপরন্তু রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ, জুলাই ঘোষণাপত্র, সংবিধান বাতিল, বিপ্লবী সরকার গঠনের মতো ইস্যুতেও বিএনপির অবস্থান সরকার ও ছাত্র সমন্বয়কদের বিপরীত। তাতে করে মনে হচ্ছে, বিএনপি এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বিরোধী দল।
যে কোনো সরকারের একটি শক্ত বিরোধী দল লাগে। না হলে সে স্বৈরাচার হয়ে ওঠে। বিএনপি যদি সত্যিই অন্তর্বর্তী সরকারের বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করে, সেটি বরং সরকারের জন্য ভালো। কারণ এর মধ্য দিয়ে সরকার একধরনের চাপের মধ্যে থাকবে। সরকারকে চাপে রাখা না গেলে সে সঠিক পথে থাকে না। এটা রাজনীতির ধর্ম।
তবে আলোচনাটা ঘুরপাক খাচ্ছে এক-এগারোতে। অর্থাৎ নাহিদ ইসলাম যে মন্তব্যটি করলেন, যাতে তিনি বলছেন, মির্জা ফখরুলের কথার ভেতরে আরেকটা এক-এগারোর সরকারের ইঙ্গিত রয়েছে এবং নাহিদের বক্তব্যের বিপরীতে মির্জা আব্বাস বলছেন, এই ধরনের কথার পরিণতি ভালো হবে না। এসবের মধ্য দিয়ে একটা দ্বান্দ্বিক তথা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে মনে হয়। প্রশ্ন হলো, এই পরিস্থিতিটা দেশের জন্য ভালো হবে কিনা?
সূত্র : বাংলা নিউজ২৪.কম