গণতন্ত্র মানে জনগণের শাসন। যে ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ ও জনগণের কল্যাণের কথা নিশ্চিত করে বলা আছে, সেটাই হচ্ছে গণতন্ত্র। বিশ্বের সর্বত্র যে গণতান্ত্রিক সংজ্ঞাটি খুব বেশী গ্রহণযোগ্য, সেটা হল মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সেই ঐতিহাসিক বক্তব্যটি- ডেমোক্রেসি মিনস গভর্নমেন্ট অফ দ্যা পিপল, বাই দ্যা পিপল ফর দ্যা পিপল।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর বিশ্বের সব দেশে যখন ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে বের হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পথ চলা শুরু করলো প্রত্যেক রাষ্ট্র নায়ক এবং জনগণের মধ্যে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে একটা মানষিকতা প্রবল ভাবে কাজ করছিল। কারণ তারা সক্ষম হয়েছিল এত দিন যে রাষ্ট্রসমূহ ঔপনিবেশিক শাসন আর শোসনে নিস্পেষিত ছিল, সেখানে কোন গণতন্ত্র ছিল না, ছিল না কোন মানবাধিকার, ছিল না জনগণের বাক স্বাধীনতা। জনগণকে ঔপনিবেশিক শক্তির নির্দেশ মেনেই চলা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। ঔপনিবেশিক তা থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ যেমন স্বাধীনতা পেল এবার সে গণতন্ত্রের কথা ভাবতে শুরু করলো। পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষের মধ্যে নবজাগরণ তৈরী হল।
মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র নিয়ামক শক্তি হিসেবে নির্বাচনকে মনে করলো। জনগণ ভোট দিয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিল, সেই নির্বাচিত প্রতিনিধির উপর জনগণ অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়লো। ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনা হবে জন কল্যাণ মূলক চিন্তা চেতনা মাথায় রেখে। দিনে দিনে যখন বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্র সফল হলো, গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হল। ফলে গণতন্ত্রই সারা বিশ্বে একটি মডেল ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেল। তবে ইউরোপ আমেরিকার মত উন্নত বিশ্বে আজও গণতন্ত্র একটি মডেল। রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থা হিসেবে টিকে থাকতে দেখা গেলেও এশিয়া আফ্রিকার অনেক দেশে গণতন্ত্র বার বার হোঁচট খেয়ে অনেকটা আতুর ঘরে পড়ে আছে। এশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারত ও বর্তমানে জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে দেশটি ও দ্বিতীয় স্থানে আছে চীন। এত বিশাল দেশ নানা ধর্ম, বর্ণ, গৌত্র, ভাষা-ভাষির ও নানা সংস্কৃতির মানুষের বসবাস থাকলেও প্রত্যেকের সহঅবস্থানের কারণে দেশটিতে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে, দেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ আছে।
সময়মত নির্বাচন হয়। মানুষ ভোট কেন্দ্রে যায়। নিজের প্রার্থীকে ভোট দেয়। সেই ব্যবস্থা যেন মানুষের সজ্জায় মিশে আছে। আর ভারতের নির্বাচনী আইন, নির্বাচন কমিশন আইন, নির্বাচন কমিশন এতটা শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোন বাঁধা বা প্রতিবন্ধকতা নেই। এবার আসছি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। আমাদের দেশ বা আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন করেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ডাকে সাড়াঁ দিয়ে। স্বাধীনতার মূল চেতনা ছিল পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের বৈষম্যমূলক আচরণ আর সেই বৈষম্যের কারণেই বাঙালি বিদ্রোহ ঘোষণা করে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগারে দীর্ঘ নয় মাস বন্দী থেকে ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে যখন রাষ্ট্রপতির দ্বায়িত্ব নেন, স্বপ্ন দেখছিলেন দেশটিকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়বেন সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য দূর করে বৈষম্যহীন সমাজ গড়বেন এবং সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়বেন। এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতা বিরোধীদের নতুন তৎপরতা, সর্বহারা সিরাজ সিকদার বাহিনীর সন্ত্রাস, বিদেশী ষড়যন্ত্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিও পরাজিত পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার স্বরযন্ত্র দেশে অর্থনৈতিক সংকট ক্রমশ বাড়ছে।
এরই মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসায়ীদের কারসাজী দেশে কৃত্তিম সংকট শুরু করে দেশে দূর্ভিক্ষ অবস্থার সৃষ্টি করা নিক্সন প্রশাসন চখ-৪৮০’-এর অধীনে মার্কিন এনজিও কেয়ারের খাদ্য ভর্তি জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে সে খাদ্য নদীতে ফেলে দেওয়ার মত জঘন্য অমানবিক বর্বরতা সদ্য স্বাধীন দেশের সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য যথেষ্ঠ্য ছিল। এমন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু দেশীয় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করবেন? নাকি দুর্ভিক্ষ সামলে দেশে না কী সমাজতন্ত্র কায়েম করবেন? স্বল্প সময়ে বঙ্গবন্ধু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতীক সম্পর্ক তৈরি করা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সদস্য ভুক্ত হওয়া। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিশ্ব ব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সাহায্য নিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্থ স্বাধীন দেশটাকে পুর্নগঠন করে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আর তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্ব পরিবারে নৃশংসভাবে খুন করে সেনাবাহিনীর কিছু পাকিস্তানপন্থী সন্তান স্বাধীন বাংলাদেশের গতি থামিয়ে দিলে বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানী ভাব ধারায় দিয়ে যায় স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে। থেমে যায় স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পথ, থেমে যায় গোটা বাংলাদেশ, শুরু হয় অন্যায় অবিচার দুর্নীতি। সেই থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কবর রচনা হয়।
স্বৈরাচারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় জনগণকে পিটিয়ে লোহার শিকলে আটকিয়ে রেখে। বলা শুরু হল উন্নয়ন আর গণতন্ত্রের কথা। কি আজব কান্ড, পায়ে মিলিটারি বুট গায়ে জল্পাই রংয়ের জামা, চোখে কালো চশমা আর হাতে লাঠি নিয়ে এক অজানা গন্তব্যের দিকে হাঁটটে শুরু করলো বাংলাদেশ। কিভাবে এ দেশে গণতন্ত্র কায়েম হবে আর কিভাবে হবে উন্নয়ন? ১৯৮১ সালে এই স্বৈরাচারের পতন হলে ১৯৮২ সালে ক্ষমতায় আসে এরশাদ। স্বৈরাচার তিনি ক্ষমতায় থাকেন দীর্ঘ সাড়ে নয় বছর। সেই স্বৈরাচার জামানার শেষ হলে এবার ক্ষমতায় আসে স্বৈরাচারের উত্তরাধিকার বেগম জিয়া। তিনি ভোটে নির্বাচিত হয়ে ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশটাকে যদি গণতন্ত্রের পথে যদি নিয়ে যেতেন তাহলে পরবর্তী সরকার অবশ্যই সে পথে হাঁটতেন, দেশে হয়তো বা গণতন্ত্রের পথ চলার পথ সুগম হতো তিনি কি করলেন স্বৈরাচার স্বামীর পদাঙ্ক অনুস্মরণ করলেন হুবহু, পাকিস্তানি কায়দায় দেশ পরিচালনা শুরু করেছিলেন, পুনর্বাসন করলেন স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের। আওয়ামী লীগ যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। অর্থাৎ এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে আওয়ামী লীগের হাত ধরেই করতে হবে, এ দেশের মানুষ সেটা জানে, আর সেটা যাতে হতে না পারে আওয়ামী লীগকে থামিয়ে দেওয়া হল।
নিজের স্বামীর সৃষ্ট রাজনৈতিক প্লাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে সেনা সমর্থন নিয়ে বিএনপি তৈরি করে গণতন্ত্রের কথা বলে এ জাতির উপর চেপে বসে স্বেরাচারী আদলে গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার খালেদা জিয়া। দেশের সাধারণ মানুষের একাংশ তাকে সমর্থন করে কোন কিছু না বুঝে সে রাজনীতিতে এসে তিনি জীবনটাকে খুব বিলাসী করে তুলেছেন, নিজেদের ধন সম্পদ আত্মীয় স্বজনদের জন্য দলীয় কিছু নেতা কর্মীর জন্য ধন সম্পদ অর্জনের মধ্য দিয়ে এই দলের যাত্রা শুরু হয়। মূলত এখানে গণতন্ত্র বলতে কিছুই নাই। মানুষকে বোকা বানিয়ে মানুষের সমর্থন আদায় করা ছাড়া এক বার বলা হয়, দেশে দেশে গণতন্ত্র দিবেন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন, আবার ধর্মের সুরসুরি দিয়ে সাধারণ ধর্ম প্রাণ মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করেন। অথচ নিজের জীবনে কোন ধর্ম কর্ম নাই, সারা দিন নিজেকে মেকাপের কভারে আচ্ছাদিত করে রাখেন এবং তার জন্য রয়েছে আলাদা বিউটিশিয়ানও। অথচ তিনি ভান করেন তিনি ইসলামের ধারক বাহক। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কোন কিছুই বুঝে না। তাদেরকে যেভাবে বলা হয়, তারা সেভাবে রাজী হয়ে যায়। যদি দল থেকে বলা হয় আজকের সমাবেশ হাজার হাজার লোককে হাজির করতে হবে, তখন দলের সিনিয়র নেতারা নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে কর্মীদের নানা প্রলোভোন দেখিয়ে কখনও কখনও অর্থ দিয়ে তাদেরকে ম্যানেজ করে ট্রাক বাস ভর্তি করে সমাবেশ স্থলে নিয়ে যায়। নেত্রী খুশী হন লক্ষ জনতার উপস্থিতি দেখে।
এসব সাধারণ মানুষ কি করে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অর্থ্যাৎ মিটিং শেষ হওয়া পর্যন্ত শুধু স্লোগান দেয়, দিন শেষে অনাহার, অর্ধাহারে থেকে খুব ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরে। হয়তো ঘরে ফেরার সময় পারিশ্রমিক হিসেবে তার পকেটে কিছু দিয়ে দেওয়া হয়। এমন চিত্র বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের। জিয়ার আমলে যেমন দেখেছি, এরশাদ, খালেদা জিয়া সর্বশেষ মেখ হাসিনার আমলেও আমরা একই চিত্র দেখেছি। সব দল ক্ষমতায় এসে সাধারণ জনগণকে ব্যবহার করে নিজেদের শক্তির জানান দেয়। কিন্তু সেই সাধারণ জনগনের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। ভাগ্যের পরিবর্তন হয় দলের শীর্ষ নেতা থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত নেতাদের, তারপর ভাগ্য পরিবর্তন হয় নেতাদের স্বজনদের। তারপর পরিবর্তনের তালিকায় আছেন যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সময়ের সরকারী আধা সরকারী স্বায়ত্ব শাসিত কর্মকর্তা কর্মচারীদের। গ্রামের খেঁটে খাওয়া কৃষক, দিন মজুর সাধারণ মানুষ যাদের কোন কর্ম নেই। অনাহারে অর্ধাহারে যাদের জীবন চলে কল কারখানার শ্রমিকসহ গ্রাম-গঞ্জের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যাদের ঘর-বাড়ি নাই, আশ্রই নাই, নদী ভাঙ্গা গৃহহীন মানুষ যারা ঝড়-বৃষ্টি, বাতাস-তুফান উপেক্ষা করে বস্তীর মধ্যে নদীর পাঁড়ে। বেড়ী বাধেঁ যাদের অবস্থান- এ রকম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কোন ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না।
আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা পৃথিবীর সেরা দুর্নীতিবাজে পরিণত হয়েছে, দেশে এমন কোন রাজনীতিবিদ খুঁজে পাওয়া যাবে না। যিনি নিজেকে দুর্নীতি মুক্ত রেখে নিজেকে সৎ জীবন যাপন করেছেন। তবে যিনি আবার সৎ জীবন যাপন করেন তার কোন মূল্যও থাকে না। দলীয় কোন কর্মকান্ডেও তাদের রাখা হয় না, তাকে বাদ দিয়ে সন্ত্রাসী, মাস্তান, দুর্নীতিবাজ, ডাকাত ও প্রভাবশালী এমন একজনকে বেঁছে নেয়া হয়। আবার আমাদের দেশে রাজনীতিতে আদর্শ বলতে কোন কিছুই নাই। বড় দুই দলের একজন স্বামীর পরিচয় দিয়ে অপরজন পিতৃ পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সমর্থন আদায় করেন। দুই বড় দলের ক্ষেত্রে আদর্শ বলতে কিছুই নাই। একজন প্রভাবশালী আমলা, ব্যবসায়ী অথবা কূটনীতিক বা রাজনীতিবিদ যদি তার প্রভাব খাটিয়ে ভোট নিতে পারে, পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত করতে পারে, দুই দল ওদের মত টাউট আর বাটপারদের দলে ভেড়াবে। সংসদে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করার জন্য, সেই মানুষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে লুটপাট আর দুর্নীতিতে নিমর্জ্জিত থাকে, তখন তার আর সাধারণ মানুষকে নিয়ে ভাবার সময় থাকে না। সে চিন্তা করে বনানী, গুলশান, ধানমন্ডীতে কিভাবে বিলাসী বাড়ি বানাবে।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী রাজনৈতিক নেতা