ট্রাম্পকে রুখতে চীন-ইউরোপ কি হাত মেলাবে

ন্যান্সি কিয়ান
  ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৫৭

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিকভাবে বিশেষ কোনো যুক্তি ছাড়াই বিগত শত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ শুল্ক আরোপ করেছেন এবং তা প্রায় সব দেশের ওপরই কার্যকর করেছেন। তারপর হঠাৎই (যদিও তিনি আগেই বলেছিলেন, এই শুল্কগুলো স্থায়ী হবে) তিনি সব দেশের জন্য নতুন ‘পারস্পরিক’ শুল্ক স্থগিত রাখেন, শুধু একটি দেশ ছাড়া।
বাকি সব দেশের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প ১০ শতাংশ হারে শুল্ক রাখেন। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে তিনি আরও কঠোর ব্যবস্থা নেন। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে দুই দফা ১০ শতাংশ করে শুল্ক আরোপের পর ‘মুক্তির দিন’ ঘোষণা করে ৩৪ শতাংশ নতুন শুল্ক আরোপ করেন এবং পরে তা বাড়িয়ে ৮৪ শতাংশ করেন। সব মিলিয়ে চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য সর্বনিম্ন কার্যকর শুল্ক দাঁড়ায় ১৪৫ শতাংশ (তবে ভোক্তাপণ্যের ক্ষেত্রে সাময়িক ছাড় রয়েছে)।
চীন প্রথম দুই দফা ১০ শতাংশ শুল্কের প্রতিক্রিয়ায় সমপরিমাণ শুল্ক আরোপ করেছিল এবং ট্রাম্পের সঙ্গে একটা চুক্তির আশা করেছিল। কিন্তু শেষ দফার শুল্ক বৃদ্ধির পর চীনও সমানহারে পাল্টা শুল্ক বাড়িয়ে দেয়। ফলে এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর মোট ১২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের ধারণা হলো, চীন সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য হ্রাসের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি সহ্য করতে পারবে না। চীনের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২০ শতাংশ আসে রপ্তানি থেকে। আর এই রপ্তানির ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ছিল চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য। এই রপ্তানির ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক চাপলে চীনের ব্যবসা, শ্রমজীবী মানুষ এবং পরিবারগুলোর ওপর বড় রকমের প্রভাব পড়বে, বিশেষ করে যখন চীনের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ছে এবং নতুন গতি সঞ্চারের চেষ্টা চলছে।
তবে ট্রাম্প যেভাবে হঠাৎ এবং অদ্ভুতভাবে এই শুল্ক আরোপ করেছেন, তা চীন সরকারের জন্য একটি বড় রাজনৈতিক সুবিধা তৈরি করেছে। সাধারণত অর্থনৈতিক মন্দা হলে জনগণ দেশীয় নীতির দোষ খুঁজে পায়। কিন্তু ট্রাম্প যেভাবে এলোমেলোভাবে এমনকি দরিদ্র দেশ যেমন লেসোথো কিংবা পেঙ্গুইনে ভরা দ্বীপগুলোর ওপরও শাস্তিমূলক শুল্ক চাপিয়েছেন, তা দেখে সাধারণ চীনারা এই অর্থনৈতিক কষ্টের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ‘সন্ত্রাসী আচরণের’ জন্য দায়ী করবে।
চীন সরকার বারবার বলছে, বাণিজ্য দুই পক্ষের জন্যই লাভজনক এবং বাণিজ্যযুদ্ধে কেউ জয়ী হতে পারে না। একই সঙ্গে তারা জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যত বেশি যুক্তিহীন আচরণ করবে, তত বেশি চীন সরকার দেশের ভেতরে জনসমর্থন পাবে।
চীন এখন আর একা নয়। বাইডেন প্রশাসন যেখানে মিত্রদেশগুলোকে নিয়ে চীনকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছিল, সেখানে ট্রাম্পের নীতির কারণে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী মিত্রদেশগুলো এখন এক কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক বাড়িয়েছেন। এর জবাবে ইইউ চীনের মতোই পাল্টা শুল্কের ঘোষণা দিয়েছিল। তবে শেয়ারবাজারে ধস এবং মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত কিছুটা পিছু হটে শুল্ক স্থগিত করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের চীনের ওপর সাম্প্রতিক মনোযোগকে কেউ কেউ দেখছেন ইউরোপ ও অন্য দেশগুলোকে চীনের বিরুদ্ধে একত্র করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে। এটা কিছুটা সফলও হয়েছে। যেমন মেক্সিকো বলেছে, তারা চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের সঙ্গে মিল রেখে নিজেদেরও শুল্ক আরোপ করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে অনেকটা নিজেরই ক্ষতি করে ফেলেছে। এমনকি যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফলভাবে আলোচনাও করে, তবু এই শুল্ক এবং ইউক্রেন ও গ্রিনল্যান্ড নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনার ফলে ইউরোপের দৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র আর একটি বিশ্বাসযোগ্য অর্থনৈতিক অংশীদার বা কৌশলগত মিত্র হিসেবে দেখা হবে না।
এ কথা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হতাশা থেকেই ইউরোপ হঠাৎ চীনের মিত্র হয়ে যাবে না। ইউরোপেরও চীনের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে চীনের সস্তায় বিপুল হারে বৈদ্যুতিক গাড়ি রপ্তানি এবং রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধের সময় সমর্থন দেওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। কিন্তু ট্রাম্প যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যকে সবার জন্য ব্যয়বহুল এবং অনিশ্চিত করে তুলেছেন, তা ইউরোপকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করার দিকে আগ্রহী করে তুলেছে।
ট্রাম্প আবারও যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বের করে এনেছেন। কিন্তু ইউরোপ ও চীন উভয়েই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। চীন এখন বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) এবং সোলার প্যানেল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশ। সেই সঙ্গে তারা সব থেকে দ্রুত হারে সবুজ জ্বালানি প্রযুক্তি ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে এগিয়ে চলেছে, যা ইউরোপেও নতুন করে আগ্রহ তৈরি করেছে।
নিশ্চিতভাবে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চীনা রপ্তানি ইউরোপীয় উৎপাদনকারীদের ওপর যে প্রভাব ফেলছে, তা জটিল বিষয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে নিজেদের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখতে চীন ও ইউরোপ একে অপরের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে আগ্রহী হতে পারে। এই চুক্তি কেমন হবে, তা বলা কঠিন, তবে সম্ভাবনার অভাব নেই।
চীন ইউরোপ থেকে আরও পণ্য আমদানি করতে পারে, ইউরোপে রপ্তানির পরিমাণ সীমিত করতে পারে এবং তাদের মুদ্রার মূল্য বাড়াতে পারে। তারা ইউরোপীয় শিল্প খাতকে যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইভি ব্যাটারি এবং বৈদ্যুতিক গ্রিড উন্নয়নে সাহায্য করার জন্য প্রযুক্তি ভাগাভাগি করতে পারে। এতে ইউরোপের দৃষ্টিতে যেসব চীনা সরকারি ভর্তুকি অসাধু প্রতিযোগিতা তৈরি করে, তা ইউরোপীয় ভোক্তা ও উৎপাদনকারীদের জন্য বরং উপকারে আসবে। ইউরোপ চাইলে চীনকে আরও বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে উৎসাহ দিতে পারে, যা চীনের নেতারা দীর্ঘদিন ধরে চাইছে।
চীন পুরোপুরি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, এমনটা সম্ভব নয়। কিন্তু নিজেদের স্বার্থে তারা বাস্তববাদী কিছু কাজ করে থাকে। যদি চীন ইউরোপের কাছে একটি ভালো ইচ্ছার বার্তা দিতে চায়, তাহলে তারা কিছু কাজ করতে পারে। যেমন ইউক্রেন থেকে বেশি খাদ্যপণ্য কিনতে পারে, যাতে আমেরিকার কৃষিপণ্যের ঘাটতি কিছুটা পূরণ হয়। তারা ইউক্রেনের শরণার্থীদের সাহায্য করতে পারে, ইউক্রেনের ধ্বংস হওয়া অবকাঠামো আবার গড়ে তুলতে নিজেদের নির্মাণকাজে দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারে এবং এমন ব্যবস্থা নিতে পারে, যাতে চীনা ভাড়াটে সৈন্যরা রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করতে না পারে।
সম্প্রতি স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বেইজিং সফর করেছেন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং জুলাইয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠকের আয়োজন করছেন। এসব স্পষ্ট করে দেয়, বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি পারস্পরিক সহযোগিতার সুফল সম্পর্কে সচেতন। যদি তারা সফলভাবে এ সহযোগিতা গড়ে তুলতে পারে, তাহলে এই বাণিজ্যযুদ্ধ চীনের জন্য একেবারে খারাপ হবে না, বরং যেটাকে অর্থনৈতিক সংকট মনে হচ্ছে, সেটাই হয়তো একটি ভূরাজনৈতিক সুযোগে পরিণত হতে পারে।

ন্যান্সি কিয়ান নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক, চায়না ইকন ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
সূত্র: প্রথম আলো