প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে কাজ করছেন। আসছে জাতীয় নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু বলাটা যত সহজ, বাস্তবায়ন তত নয়। পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে একদিনে ভোট দেওয়া সম্ভব নয় বলেই সরকার এখন ভাবছে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কোনো সমাধান—ডিজিটাল পোস্টাল ভোটিং বা অনলাইন ভোটিংয়ের কথা।
প্রতিবছর গড়ে ১০ লাখ মানুষ কাজের খোঁজে দেশ ছাড়ছেন। এর বাইরেও বড় একটা সংখ্যা আছে, যারা পর্যটন ভিসায় গিয়ে আর দেশে ফেরেন না। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এর প্রতিক্রিয়া আমরা সরাসরি দেখেছি—বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশিদের ভিসা দিতে অনিচ্ছুক হচ্ছে। অনেকে এটাকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দায় বলে ব্যাখ্যা করেন, কিন্তু আসল কারণটা অনেক সময় অন্য জায়গায়—এক দেশের ভিসা নিয়ে আরেক দেশে গিয়ে স্থায়ী হয়ে যাওয়া, আর কার্যত না ফেরা।
অভিবাসন আসলে মানুষের প্রাচীন অভ্যাস। যাযাবর বেদুইন থেকে শুরু করে আধুনিক সমাজেও মানুষ অভিবাসনমুখী।
বিগত ও বর্তমান—সব সরকারই ক্যালকুলেটরের বোতাম টিপে প্রবাসীর সংখ্যা ধরেন সোয়া কোটির কাছাকাছি। আশ্চর্যের বিষয়, এই সংখ্যাটা বছরের পর বছর প্রায় অপরিবর্তিত থেকে গেছে। অথচ এর ভেতরে কতজন দেশে ফেরত এসেছেন, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আবার কতজন কলকাতা-মুম্বাই-দুবাই হয়ে লিবিয়া বা অন্য দেশে গেছেন শুধু পর্যটন ভিসা নিয়ে—সেটারও নির্ভরযোগ্য হিসাব মেলে না।
সরকারের কাছে এই প্রবাসীরা যেন স্রেফ ‘আদম’। তবে এই আদমের সংখ্যাটা কত, সেটা সরকারও জানে না, আমরাও না।
কাজেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশংসা করতে হবে। এই সরকার ভাবছে, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার কথা। যারা বিদেশে ঘাম ঝরিয়ে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন, তাদের তো প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার অধিকার থাকবেই। আমার কাছে এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক উদ্যোগ। ভোট এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে অংশগ্রহণ মানুষকে রাষ্ট্রের প্রতি শুধু দায়বদ্ধই করে না, বরং ভালোবাসাও বাড়িয়ে তোলে।
আমার দেখা কিছু প্রবাসী আছেন, যারা সারা বছর দেশে না আসলেও ভোটের সময় ঠিকই দেশে ফেরেন। কারণ এই ভোট আসলে শুধু একটি প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম নয়—এটা আমাদের জন্য উৎসবও বটে, আর সে উৎসবে তারাও সামিল হতে চান।
উন্নত দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, নাগরিকদের ভোটাধিকার বাস্তবায়নের জন্য নানা সুবিধা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকোসহ অনেক দেশে পোস্টাল বা এবসেন্ট ব্যালটের ব্যবস্থা রয়েছে। ফ্রান্স এবং জাপানের প্রবাসীরা নিকটস্থ দূতাবাসে গিয়ে ভোটের আগে বা ভোটের দিনই ভোট দিতে পারেন।
কিছু দেশ আরও এগিয়ে গেছে—এস্তোনিয়া, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের প্রবাসীরা অনলাইনের মাধ্যমে ভোট দিতে পারেন। এশিয়াতেও উদাহরণ আছে; যেমন পাকিস্তান, যেখানে প্রবাসীরাও অনলাইনে ভোটের সুযোগ পান, যদিও সব দেশ থেকে এই সুযোগ পাওয়া যায় না।
ভারতের ক্ষেত্রে এখনও ডাকযোগে ভোট দেওয়ার সীমিত ব্যবস্থা আছে, মূলত সরকারি কর্মীদের জন্য। তবে সম্প্রতি Overseas Indian Postal Ballot চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যা ভবিষ্যতে প্রবাসী ভারতীয়দের জন্য সুবিধাজনক হবে।
বাংলাদেশও যে খুব পিছিয়ে নেই, তা এই উদ্যোগে দেখা যাচ্ছে। প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম চালু করেছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় বর্তমানে ১৭টি দেশে ১৭টি স্টেশনে এই কার্যক্রম চলছে। এর মাধ্যমে প্রবাসীরা বিদেশ থেকেই ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারছেন। তবে এখনও তারা সরাসরি বিদেশে বসে ভোট দিতে পারছেন না; এজন্য নির্বাচনের সময় ভোট দিতে চাইলে বাংলাদেশে আসতেই হয়। এবার হয়তো পারবেন বিদেশ থেকেই ভোট দিতে।
ভোট দেওয়ার মূল শর্ত হলো বয়স আঠারো বছর পূর্ণ হওয়া এবং সঙ্গে একটি বৈধ জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) থাকা। প্রবাসীদের জন্য বিদেশে এনআইডি নিবন্ধন কার্যক্রম প্রথম শুরু হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। সেই সময় নির্বাচন কমিশন পরীক্ষামূলকভাবে এই উদ্যোগ নিয়েছিল।
প্রথম ধাপ শুরু হয় মালয়েশিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থানরত প্রবাসীদের জন্য, কারণ এই তিন দেশে মোট প্রবাসীর প্রায় তিন চতুর্থাংশ বসবাস করেন। প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের চাহিদার পর নির্বাচন কমিশন ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে এই কার্যক্রম চালু করা হয়, যাতে প্রবাসীরা বিদেশে বসেই সহজে এনআইডি করতে পারেন এবং দেশে এসে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকে প্রবাসীরা বাংলাদেশ দূতাবাস বা কনস্যুলেটের মাধ্যমে এনআইডি সংগ্রহ করতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইতালি, যুক্তরাজ্য, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং জাপান। সব মিলিয়ে এই ১০দেশে ১৭টি স্টেশন বা দূতাবাসে প্রবাসীরা এনআইডি নিবন্ধন করতে পারছেন।
তবে এখানে রয়েছে একটি বড় বাধা—এই সব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও প্রবাসীরা সরাসরি বিদেশে বসে ভোট দিতে পারেননি এতকাল; ভোট দিতে চাইলে দেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
বিদেশে বসে বাংলাদেশের ভোটে অংশ নেবার কোন সুযোগ ছিল না এতকাল। তাদের ভোট দিতে আসতে হবে। আর তার জন্য এনআইডি বা জাতীয় পরিচয় পত্রও দরকার। দুটো কাজই সমানভাবে চলছে। তবে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে যেন প্রবাসীদের যাদেরই এনআইডি রয়েছে, তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, সেজন্য সরকার অনলাইন ভোটিংয়ের কথা চিন্তা করছে। ই-ভোটিং বা অনলাইন ভোটিংয়ের ধারণাটাই এসেছে, দূরত্ব বিবেচনায়, যেমন কানাডাতে ই-ভোটিং জনপ্রিয়। মানুষ বাসা বা অফিসে বসেই ভোট দিতে পারে। আবার নেপালের মতো দেশ ই-ভোটিং সিস্টেম চালু করেও বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ দেশে থাকুন বা বিদেশে, চায়ের দোকান হোক বা ফাইভ-স্টার হোটেল, সর্বত্রই রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসেন। এখানে নির্বাচন সত্যিই এক ধরনের উৎসব। এই উৎসবে এবার বিশ্বের সব দেশে থাকা প্রবাসীরাও অংশ নেবেন—এমনটাই গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর তার বক্তৃতায় ঘোষণা করেছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
ভোটে অংশ নিতে নতুন করে ১৪৪টি দল আবেদন করেছে। প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে ২২টি দল অনুমোদন পেয়েছে। নতুন দলগুলো এবং নতুন ভোটাররা, দেশ-বিদেশ থেকে মিলিত হয়ে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন।
সূত্র: বিডি নিউজ২৪.কম