ভূমিকম্প: করণীয় ঠিক না করলে বিপদ আসন্ন

মোহন কুমার দাশ
  ২২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৩৪


বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে, যা বিভিন্ন দিক থেকে প্রমাণিত। অতীতে এ অঞ্চলে অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে বড় ভূমিকম্পের ঘটনাও ঘটেছে। ১৫, ১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯ শতকে বড় ভূমিকম্প হয়েছে। তাতে আমাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তার মধ্যে তিস্তা নদীর গতিপথ বদলে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। গবেষণা বলে, বড় ভূমিকম্প হওয়ার পর একশ কিংবা দুইশ বছরে আবার তা ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে। এই প্রেক্ষাপটে আমরা বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছি।
বাংলাদেশের যে কোনো অঞ্চলে এ ভূমিকম্প হতে পারে। এর পরও কিছু এলাকা রয়েছে, যেগুলো তুলনামূলক বেশি ঝুঁকিপ্রবণ। যেমন সিলেট অঞ্চল। ঢাকার কথা আলাদাভাবে বলা হয়। কারণ এলাকাটি অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। এ ছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় অন্যান্য অঞ্চলও ঝুঁকিপূর্ণ বলে দেখা যাচ্ছে। গতকালকের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর ঘোড়াশালে, যার গভীরতা প্রায় ১০ কিলোমিটার এবং মাত্রা ৫.৭ রিখটার স্কেল। অর্থাৎ মাঝারি ভূমিকম্প। এ ধরনের ভূমিকম্পকালে প্রায় ৩০ সেকেন্ড পরিমাণ দুলতে থাকে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভূমিকম্পটি আমরা টের পেয়েছি। এর চেয়ে দীর্ঘ হলে আমরা বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তাম। এরই মধ্যে পুরান ঢাকায় ছাদের রেলিং পড়ে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জে দেয়াল ধসে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এখানে ভূমিকম্পের পর ক্ষয়ক্ষতি গুরুত্ব দিয়ে পরিমাপ করা হয় না। যদি করা হতো, তাহলে আমরা আরও জোরালো পদক্ষেপ দেখতাম। 
দেশে ভূমিকম্পের ব্যাপারে আগাম কোনো প্রস্তুতি বা নীতি গ্রহণ করা হয়নি। শহরের বেশির ভাগ এলাকায় ভূমিকম্পকালে নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এরই মধ্যে কিছু ভবন হেলে পড়েছে। এগুলো ভূমিকম্পের মাত্রা সামান্য বাড়লেই ধসে পড়ত। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত এবং এগুলো নিয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা দরকার। বলা হয়ে থাকে, ঢাকাতে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা প্রায় ২১ লাখ। এর মধ্যে যদি ৫-৬ লাখ ভবন ধসে পড়ে তাহলে কী ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে? কত লাখ মানুষ হতাহত হতে পারে? তার কি কোনো হিসাব আমাদের আছে? 
গতকালের ভূমিকম্পকালে আমরা বেশ কিছু উদ্বেগের চিত্র দেখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে লাফ দিয়েছে এবং অনেকে ভয়াবহভাবে আহত হয়েছে। একটা প্রতিষ্ঠানে যখন এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়, তৎক্ষণাৎ তারা কীভাবে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাবে, তার ব্যবস্থা থাকা দরকার। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও জরুরি। ছোট হলেও ভূমিকম্প কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘন ঘনই হচ্ছে। এর পরও আমরা কোনো প্রস্তুতিমূলত নীতি গ্রহণ করিনি। হলগুলোতে এ ব্যবস্থা থাকলে শিক্ষার্থীরা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতো না। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ অনেকে বারবার গুরুত্ব দেওয়ার পরও কর্তৃপক্ষগুলো সেসব আমলে নেয়নি। 
এলাকাভিত্তিক কিছু করণীয় ঠিক করে সেগুলো বাস্তবায়ন করলেই এ ধরনের দুর্যোগের ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে পদক্ষেপ টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়া দরকার, যে ক্ষেত্রে আমাদের বড় ঘাটতি রয়েছে। দেশে ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণাও অত্যন্ত নগণ্য। অপারেশন এজেন্সিগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাপক দূরত্ব। এগুলোর কোনোটাই সমাধান করা যাচ্ছে না। সুনির্দিষ্ট কিছু ভূমিকম্পের ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণ, গবেষণা এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলে বহু কিছু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে নীতি গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে একটা কার্যকরী যোগাযোগ তৈরি করা জরুরি। এদের কারা কখন মাঠে থাকবে, নিজেদের ভূমিকা পালন করবে– সবকিছুর একটা স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। এখনও কয়েক মাসের মধ্যে আরেকটা ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যেটাকে দুর্যোগ-পরবর্তী ধাক্কা বলা যায়। এহেন পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা কতটুকু প্রস্তুত, ভেবে দেখার সময় এসেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে যে ধরনের সমন্বয় দরকার, সেটা দ্রুত তৈরি করতে হবে। ইতোমধ্যে যেসব সরঞ্জাম দুর্যোগ মোকাবিলায় বসানো হয়েছে, সেগুলো আদৌ কাজে আসছে কিনা তাও বিচার করা দরকার। এ ক্ষেত্রে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে গবেষণা করা প্রয়োজন। 
ঢাকার মতো যেসব এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলোতে ভবনগুলো চিহ্নিত এবং তার ভিত্তিতে উপযুক্ত উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় আমরা প্রাণহানির পাশাপাশি সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হবো। ভূমিকম্পকালে কীভাবে টিকে থাকা যায় তার সমন্বিত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, বিদ্যুৎ স্থাপনাগুলো ঠিক রাখা দরকার। এগুলোর কোনোটাই এখন সুগঠিত নয়। ফলে আমরা সবাই ঝুঁকিতে রয়েছি। আজকে ভবনগুলো থেকে কীভাবে নামবে, কী দিয়ে নামবে তার সঠিক কোনো নির্দেশনা কিংবা প্রস্তুতির কোনোটাই কার্যকরভাবে ছিল না। যেমন লিফট ব্যবহার করবে, নাকি অন্য কোনো বিকল্প গ্রহণ করবে, তার কোনোটাই নীতিগতভাবে স্পষ্ট নয়। অথচ এ ধরনের দুর্যোগকালে জানমালের অকল্পনীয় ক্ষতি হয়। তাই এসব ক্ষেত্রে টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী প্রস্তুতই কাম্য। 
আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটা প্রবণতা হলো, বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হলে নড়েচড়ে বসি। তবে এটাও পুরো সত্য নয়। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিকাণ্ড থেকে শুরু করে ভবন ধসে পড়ার বহু ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এখনও সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষগুলোকে স্থায়ী কোনো প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। চারপাশে এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে মানুষের মধ্যে সব সময় আতঙ্ক বিরাজ করে। ফলে দুর্যোগকালে জনসাধারণ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। 
এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে এবং ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। এতে গৃহীত নীতিগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের পাশাপাশি শহরগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও এলাকাগুলো পুনর্গঠনে দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটার বিকল্প নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, করণীয় নির্ধারণ না করলে ভয়ংকর বিপদ আসন্ন। 
ড. মোহন কুমার দাশ: জয়েন্ট সেক্রেটারি, সাউথ এশিয়ান মিটিওরোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (সামা)
সূত্র: সমকাল