পোড়াবাড়ি ভাঙতে ফের বুলডোজার এবং কয়েকটি সরল প্রশ্ন

আমীন আল রশীদ
  ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:০৯


আগের দুই দফায় বাড়িটা পুড়িয়ে এবং প্রায় গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর তৃতীয় দফায় বাড়িটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে ১৭ নভেম্বর দুটি বুলডোজারসহ যারা ওখানে গেলেন—পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদেরকে প্রতিহত করেছে। এটাই করার কথা, যে কোনো আইন-শৃঙ্খলা বহির্ভূত কাজ প্রতিহত করতে হয়, করার দায়িত্বও তাদের।

তবে এর আগের দুবার তা করা হয়নি। প্রথমবার বাড়িটায় প্রথম আগুন দেওয়া হয় অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার পতনের দিন। এর ৬ মাসের মাথায় গত ৬ ফেব্রুয়ারি বাড়িটা এস্কেভেটর দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই দুটি ঘটনার সময়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্লিপ্ততায় মানুষ মনে করেছে এসবের পেছনে রাষ্ট্রীয় মদদ, সমর্থন ও সহযোগিতা রয়েছে। আগেও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, উত্তেজিত লোকজন তাদেরকে লক্ষ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিচ্ছে এবং একপর্যায়ে তারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ওই বাড়িটি থেকে বেরিয়ে যায়। ফলে এবারের ঘটনায় কিছু সরল প্রশ্ন সামনে আসছে, প্রশ্নগুলো সহজ হলেও উত্তরগুলো এত সহজ নয়।

১. দুই দফায় অগ্নিসংযোগ ও বুলডোজার দিয়ে ম্যাসাকার করে দেওয়ার ফলে যে বাড়িটার কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে, সেই বাড়িটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে দুটি বুলডোজার নিয়ে যেতে হলো কেন?

২. কেন এই বাড়িটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে এবং তারপর এখানে কী হবে?

৩. একটি ইটের দালান বা জড়বস্তুর প্রতি তাদের এই রাগ ও ক্ষোভের পেছনে আসলে কোনো রাজনীতি নাকি ভয় কাজ করছে?

৪. যারা বারবার এই বাড়িটা ভাঙার জন্য যাচ্ছেন, তাদের সবাই কি ছাত্র-জনতা?

৫. যারা এই বাড়িটা ভাঙার জন্য যাচ্ছেন এবং যারা মনে করেন যে এটি সম্পূর্ণ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবেন, তারা সত্যিই কি কোনো আদর্শ বা রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য যাচ্ছেন নাকি তাদের অনেকেই তৃতীয় কোনো পক্ষের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য যাচ্ছেন? অর্থাৎ এটি স্যাবোটাজ কি না?

৬. এর আগে দুই দফায় যখন বাড়িটায় আগুন দেওয়া হলো এমনকি বুলডোজার দিয়ে বাড়িটা পুরোপুরি ভেঙে দেওয়া হলো, এমনকি এখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বিরাট নারিকেল গাছও ভেঙে ফেলা হলো, সেই বাড়িটার কঙ্কাল রক্ষায় এবার সরকার বাহাদুর বা তার পুলিশ ও সেনাবাহিনী কেন এতটা তৎপর হলো? কেন বাড়ির অবশিষ্টাংশ রক্ষায় তারা ঢাল হয়ে দাঁড়াল? অথচ এই পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরাই এর আগে দুই দফায় যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয় এবং বুলডোজার দিয়ে প্রায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন কথিত অহিংস নীতির আলোকে নিশ্চুপ ছিলেন। তারা চাইলেই বাড়িটা রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু করেননি।

তখন কি বাড়িটা রক্ষার ব্যাপারে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশনা ছিল না? এখন কি তাহলে রাজনীতির হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাচ্ছে নাকি সরকার তার নিরপেক্ষতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও সেনাবাহিনী তাদের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে চাইছে—যেহেতু আগামী ফেব্রুয়ারিতে একই দিনে জাতীয় সংসদ ও গণভোট হওয়ার কথা। যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যমান ব্যবস্থা ও পুলিশ দিয়ে একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য-নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে, ফলে সেই সংশয় দূর করা তথা যে, নির্বাচনে সেনাবাহিনী ও পুলিশ নিরপেক্ষ থাকবে; আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে—জনমনে এই প্রতীতির জন্ম দেওয়ার জন্যই কি ১৭ নভেম্বর সেনা ও পুলিশ বাহিনীকে অন্য ভূমিকায় দেখা গেল?

৭. দুই দফায় বাড়িটা ভাঙার পরে কিছুটা বিরতি দিয়ে কেন সোমবার আবার বাড়িটা ভাঙার আয়োজন করা হলো? চাইলে তো এই মধ্যবর্তী সময়েই বাড়িটা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যেত। কোনো আওয়াজ না দিয়ে যে কোনো রাতে একটি বুলডোজার নিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাড়িটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যেত। পরদিন সকালে হয়তো আশেপাশের লোকেরা এই দৃশ্য দেখে তার ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিতেন। সাংবাদিকরা দলে দলে সেখানে গিয়ে লাইভ করতেন। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে একটি বিরাট আয়োজন করে, ১৭ নভেম্বরেই কেন দুটি বুলডোজার নিয়ে দলে দলে লোকজন ওখানে গেলেন? বাড়ি ভাঙা বা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে এটাকে জাতীয় পর্যায়ের ইস্যু তৈরি করা বা এটা নিয়ে শোরগোল তৈরি করে বিশ্বকে জানানোই কি মূল উদ্দেশ্য? অর্থাৎ যেদিন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় হলো, সেদিনই এই বাড়িটা ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না?

সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনাগুলো বাড়তে পারে—এই আশঙ্কা থেকে কি সরকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ভগ্নাংশ রক্ষায় তৎপর হলো নাকি শুরু থেকেই এই সরকার ও তার স্টেকহোল্ডারদের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ উঠেছে, সেখান থেকে কিছুটা দায়মুক্তি পেতে চাইছে?

৮. সবশেষ ১৭ নভেম্বর যারা এখানে বিক্ষোভ করেছেন, তাদের অনেকের বক্তব্য এরকম: এই বাড়িটা ফ্যাসিজমের আঁতুড়ঘর; এটা আওয়ামী লীগের কেবলা—অতএব এর কোনো অস্তিত্ব রাখা হবে না।

প্রশ্ন হলো, যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান হলো, তার ফ্যাসিস্ট বা একনায়ক কিংবা স্বৈরাচার হয়ে ওঠার সঙ্গে এই বাড়ির কী সম্পর্ক? শেখ হাসিনা থাকতেন সরকারি বাসভবন গণভবনে। সুতরাং, ফ্যাসিজমের আঁতুড়ঘর বললে মনে হবে এই বাড়িতে বসে শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তার মানে যারা এই বাড়িটা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চান, তারা বঙ্গবন্ধুকেই ফ্যাসিস্ট বলছেন?

এটা অস্বীকার করলে ঐতিহাসিক সত্যের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে যে, ১৯৭১ সালে এই দেশের সাত কোটি মানুষ যে মানুষটির ডাকে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল; যে কৃষক লাঙ্গল ফেলে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল; যে মানুষটিকে এই দেশের মানুষ দলমতের ঊর্ধ্বে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসত; যে মানুষটি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার সময় তার মুক্তি ও প্রত্যাবর্তনের জন্য এই দেশের হাজারো মানুষ নামাজ পড়েছে, রোজা রেখেছে—তার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি সরকার প্রধান হলেন। সরকার প্রধান হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন সহজ কাজ নয়। একদিকে ভেঙে যাওয়া অর্থনীতি, টাকার সংকট, অন্যদিকে তার দলের নেতাকর্মীদের অপকর্ম এবং পরাজিত দেশি-বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্র; উপরন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের তৎপরতা—সবকিছু সামাল দিয়ে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার যে কঠিন চ্যালেঞ্জ, সেখানে সরকারপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভুল ও ব্যর্থতার নির্মোহ আলোচনা হতে পারে। কিন্তু তার সেই ভুল কিংবা সময়োচিত সঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারার ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে তার যে অবদান—সেটি ম্লান হয়ে যায় না।

বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই বাড়িতে থাকতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬১ সালের পয়লা অক্টোবর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১–এর শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন—নানা চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী এই বাড়ি। এই বাড়িতে বসে বঙ্গবন্ধু দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এখান থেকেই তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠিয়েছিলেন। ওই বছরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরুর পরে বঙ্গবন্ধুকে এই বাড়ি থেকেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট এই বাড়িতেই সপরিবারে নিহত হন তিনি।

১৯৮১ সালে তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পরে তার কাছে বাড়িটি হস্তান্তর করা হয়। শেখ হাসিনা বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করেন। বাড়িটি যে সড়কে, আগে এর নম্বর ছিল ৩২। নতুন নম্বর ১১। কিন্তু সড়কের আগের ৩২ নম্বর নামেই বাড়িটি পরিচিতি। বাড়িটার নম্বর আসলে ৬৭৭।

সুতরাং ১৬ বছরের দীর্ঘ শাসনে শেখ হাসিনা, তার সরকার দলের নেতাদের অপরাধের সঙ্গে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িকে গুলিয়ে ফেলার উদ্দেশ্য হলো শুধু শেখ হাসিনাকেই নয়, বরং এই ‍সুযোগে বঙ্গবন্ধুকেও বিতর্কিত করা, অসম্মানিত করা। যেহেতু এই বাড়িটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনের আঁতুড়ঘর—সে কারণেই এখন এটিকে ফ্যাসিজমের আঁতুড়ঘর তকমা দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং এই রাজনীতিটা বোঝা খুব কঠিন নয়।

প্রশ্ন হলো, এই বাড়িটা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে এখানে একটি খেলার মাঠ, হকার মার্কেট কিংবা পাবলিক টয়লেট অথবা এখানে অন্য কোনো স্থাপনা নির্মাণ করলেই কি ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান পাল্টে যাবে? মানুষ কি ভুলে যাবে তার অবদান বা মানুষের স্মৃতি থেকে শেখ মুজিবের নাম ও ছবি মুছে যাবে? দেশ-বিদেশের কোটি কোটি বইতে তার নাম আছে। ছবি আছে। হাজার হাজার ডকুমেন্টারিতে তার বক্তব্য, ভাষণ ও সাক্ষাৎকার আছে। সুতরাং একটি বাড়ি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেই সবকিছু মিথ্যা হয়ে যাবে?

ইতিহাসে যার যার অবস্থান নির্ধারিত হয়েই আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ মুজিবের কী অবস্থান, খন্দকার মোশতাকের কী অবস্থান—সেটি যেমন স্পষ্ট, তেমনি গোলাম আজমেরও। সুতরাং একটি বাড়ি ভেঙে মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া কিংবা ইতিহাসের নতুন বয়ান তৈরির মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এই দেশের মানুষের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে কি না—এখন সেই প্রশ্নটি তোলার সময় এসেছে।
সূত্র: বিডি নিউজ২৪.কম