জোহরান মামদানির জয়, বাস্তবতা নাকি ক্যারিশমা?

ড. সুজিত কুমার দত্ত
  ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:৩৪


নিউইয়র্ক সিটির নতুন ইতিহাস রচিত হলো ২০২৫ সালের নির্বাচনে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে জোহরান মামদানি যখন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহরের মেয়র নির্বাচিত হলেন, তখন তা শুধু প্রজন্মগত পরিবর্তনের প্রতীক নয়, বরং আদর্শিক পুনর্জাগরণের এক ঘোষণাও।
আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া, ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই তরুণ অভিবাসী রাজনীতিক এমন এক সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, যখন আমেরিকান রাজনীতি আবার নতুন করে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে প্রগতিশীলতা বনাম স্থবির ঐতিহ্যবাদের সংঘর্ষে। এমন এক নির্বাচনে, যেখানে সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু মার্ক কুওমো নিউইয়র্ক রাজনীতির এক প্রভাবশালী নাম এবং রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়ার মতো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, সেখানে মামদানির জয় ছিল বিস্ময়কর।
ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার মাত্র ৩৫ মিনিটের মধ্যেই অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস তার জয় ঘোষণা করে। নিউইয়র্কবাসী শুধু একজন নতুন মুখকে বেছে নেননি; তারা এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, এক নতুন রাজনীতির ভাষা গ্রহণ করেছেন।
জোহরান মামদানির বিজয়কে ‘জেনারেশনাল আপরাইজিং’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ মেয়র হিসেবে তার অভিষেক ইঙ্গিত দিচ্ছে নিউইয়র্কবাসী এখন এমন নেতৃত্ব চায়, যা তাদের বাস্তব জীবন ও ভবিষ্যতের সাথে সংযুক্ত।
এই প্রজন্ম জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক বৈষম্য, আবাসন সংকট, পুলিশ সংস্কার এবং অভিবাসী অধিকার এসব ইস্যুকে কেবল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, জীবনের প্রাত্যহিক বাস্তবতা হিসেবে দেখে। মামদানি ঠিক সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি, যিনি বারবার বলেছেন, ‘নিউইয়র্ক শুধু ধনীদের শহর নয়, এটি শ্রমিকদের, শিক্ষার্থীদের, অভিবাসীদের এবং স্বপ্নদর্শীদের শহর।’
তার প্রচারণা তরুণ ভোটারদের মধ্যে বিরাট সাড়া ফেলেছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি ছিলেন সরাসরি, সৎ ও ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক ভাষার জটিল অলংকারের পরিবর্তে ব্যবহার করেছেন মানবিক গল্প। অনেক তরুণ কর্মী বলেছেন, মামদানির প্রচারাভিযান ছিল ‘রাজনীতি নয়, আন্দোলন’ যেখানে মানুষ নিজেদের ভবিষ্যতের অংশীদার হিসেবে দেখেছে।
মামদানির প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ‘ইকোনমিক জাস্টিস ফর অল’ অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি। নিউইয়র্কের ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য, গৃহহীনতার সংকট এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির মধ্যে তিনি প্রস্তাব করেছেন এমন এক শহরব্যাপী পরিকল্পনা, যেখানে উন্নয়ন মানে কেবল আকাশচুম্বী ভবন নয়, বরং মানুষের মর্যাদাপূর্ণ জীবন।
তিনি বলেছেন, ‘যদি নিউইয়র্ক বিশ্বের রাজধানী হয়, তবে এখানে কোনো নাগরিকের ঘুমানোর জায়গা না থাকা সভ্যতার ব্যর্থতা।’ তার বাজেট প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন প্রকল্প, শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা, ও গণপরিবহন ব্যবস্থার সংস্কার। ‘রেন্ট জাস্টিস’ ভাড়ার ন্যায্যতা মামদানির অন্যতম মূল ইস্যু ছিল, যা নিম্ন আয়ের নিউইয়র্কবাসীদের মধ্যে গভীর সাড়া তোলে। এই ইস্যুগুলোর মাধ্যমে মামদানি নিজেকে এমন এক রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, যিনি অর্থনৈতিক শক্তির বিপরীতে সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে সাহস করেন।
জোহরান মামদানির জয় বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়; এটি যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রগতিশীল পুনরুত্থানেরই অংশ। এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যে সাফল্য দেখিয়েছে। দ্য গার্ডিয়ান এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মামদানির ঐতিহাসিক জয়ের দিনই ভার্জিনিয়ায় অ্যাবিগেইল স্প্যানবার্গার প্রথম নারী গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত হন; নিউ জার্সিতে সাবেক নৌবাহিনী কর্মকর্তা মিকি শেরিল রিপাবলিকান ব্যবসায়ী জ্যাক সিয়াটারেলিকে পরাজিত করেন এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর গ্যাভিন নিউজমের রিডিস্ট্রিকটিং প্রস্তাব (‘প্রপ ৫০’) পাস হয়েছে, যা ডেমোক্র্যাটদের জন্য কংগ্রেসে পাঁচটি নতুন আসন তৈরি করতে পারে।
রয়টার্স লিখেছে, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের পর এটি ছিল প্রথম বড় নির্বাচন, যেখানে ডেমোক্র্যাটরা তাদের শক্তি প্রদর্শন করেছে। মামদানির বিজয় সেই ধারার অংশ।’ অর্থাৎ, মামদানির জয় কেবল নিউইয়র্কের নয় এটি জাতীয় পর্যায়ে প্রগতিশীল রাজনীতির শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতীক।
নিউইয়র্ক, যার ইতিহাস অভিবাসন, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের সংমিশ্রণে গঠিত, বরাবরই ছিল আমেরিকার রাজনৈতিক মাইক্রোকসম। সেই শহর আজ এমন এক তরুণকে নেতৃত্বে দেখছে, যিনি আফ্রিকায় জন্মগ্রহণ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরিবারে বড় হয়েছেন এবং পরে আমেরিকাকে নিজের দেশ বানিয়েছেন।
এই পটভূমি অবশ্যই প্রতীকী, কিন্তু মামদানির জয় শুধুমাত্র পরিচয়ের জয় নয়। তার আসল শক্তি ছিল তার নীতিতে, দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং জনগণের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষমতায়। অ্যান্ড্রু মার্ক কুওমোর মতো এক প্রভাবশালী রাজনীতিককে পরাজিত করা সহজ ছিল না। কিন্তু মামদানি প্রচারণায় বড় অর্থের বদলে ছোট অনুদান ও স্বেচ্ছাসেবী কর্মীর ওপর নির্ভর করেছেন।
‘গ্রাসরুটস পাওয়ার’ মূল থেকে উঠে আসা রাজনৈতিক শক্তির এই নতুন উদাহরণ ভবিষ্যতের মার্কিন রাজনীতির জন্য অনুপ্রেরণামূলক। বিবিসি তাদের বিশ্লেষণে সতর্ক করেছে, ‘মামদানির বিজয় নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক, কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জ এখন শুরু।’ নিউইয়র্কের মতো জটিল শহর পরিচালনা করা সহজ নয় বিশাল প্রশাসন, পুলিশ সংস্কার, বাজেট ঘাটতি, জলবায়ু অভিযোজন এবং ক্রমবর্ধমান আবাসন সংকট সবই তার সামনে কঠিন পরীক্ষা হিসেবে দাঁড়াবে।
তাছাড়া তার প্রগতিশীল নীতিগুলো বাস্তবায়নে শহরের কর্পোরেট ও রিয়েল এস্টেট লবির সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য। অনেকে মনে করেন, তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ‘প্রচারণার আদর্শ’ এবং ‘প্রশাসনের বাস্তবতা’র মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। তবে মামদানি বারবার বলেছেন, ‘আমরা যে পরিবর্তন চেয়েছি, তা রাতারাতি আসবে না; কিন্তু আমরা যদি সৎ থাকি, একদিন অবশ্যই তা সম্ভব।’ তার এই আশাবাদই হয়তো নিউইয়র্কের নাগরিকদের তাকে ভোট দেওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ।
জোহরান মামদানি ভারতীয় বংশোদ্ভূত ও আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী একজন অভিবাসী নেতা হলেও, তার কর্মজীবন এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্র নিউইয়র্কের বৃহৎ দক্ষিণ এশীয় ও অভিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। বিশেষত কুইন্সে বসবাসকারী বিশাল বাংলাদেশি অভিবাসী সম্প্রদায় তার নির্বাচনী এলাকার অংশ।
যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই: ইতিহাস ও মানবতার পক্ষের আহ্বান
মেয়র হিসেবে মামদানি সম্ভবত বাংলাদেশের সাথে সরাসরি কূটনৈতিক সম্পর্ক পরিচালনায় ভূমিকা রাখবেন না, কারণ এটি ফেডারেল সরকারের এখতিয়ার। তবে একজন প্রগতিশীল নেতা হিসেবে এবং নিউইয়র্কের অভিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি তার দায়বদ্ধতার কারণে, তিনি নিম্নলিখিত ক্ষেত্রগুলোয় ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেন:
১। অভিবাসী অধিকার: বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা এবং কাজের অধিকারের মতো বিষয়ে তার প্রগতিশীল নীতিগুলো সরাসরি সহায়ক হবে।
২। অর্থনৈতিক সহযোগিতা: প্রগতিশীল আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে, তিনি নিউইয়র্কের মতো বহুজাতিক শহর থেকে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার দেশগুলোর (যেমন বাংলাদেশ) জন্য নীতিগত বা প্রতীকী সমর্থন বাড়াতে পারেন।
৩। সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন: দক্ষিণ এশীয় ঐতিহ্য বহনকারী প্রথম মেয়র হিসেবে, তিনি নিউইয়র্ক সিটিতে বাংলাদেশিসহ সব দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতির প্রচার ও সম্মান বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবেন, যা দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারে।
জোহরান মামদানির বিজয় বৃহত্তর জাতীয় প্রেক্ষাপটে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রগতিশীল শাখার শক্তির উত্থানকেও নির্দেশ করে। এটি এমন এক সময়ে ঘটলো যখন দেশের প্রথম প্রধান নির্বাচনগুলোয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচনের পরেও ডেমোক্র্যাটরা তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করছে।
ভার্জিনিয়ায় কংগ্রেসওম্যান অ্যাবিগেইল স্প্যানবার্গার রাজ্যের প্রথম মহিলা গভর্নর হন, নিউ জার্সিতে মিকি শেরিল রিপাবলিকান প্রতিপক্ষকে হারান এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় রিডিস্ট্রিক্টিং ম্যাপের জন্য গ্যাভিন নিউসোমের প্রস্তাব বিপুল ভোটে পাস হয় এই সবগুলো ঘটনাই ডেমোক্রেটিক পার্টির একটি পুনরুজ্জীবন এবং প্রগতিশীল এজেন্ডার প্রতি জনগণের সমর্থনের ইঙ্গিত দেয়।
মামদানি নিজেকে ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে খারাপ দুঃস্বপ্ন’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তার বিজয়কে ট্রাম্প সরাসরি ‘শুরু হলো মাত্র!’ বলে প্রতিক্রিয়া জানালেও, এই জয় প্রমাণ করে যে, ডেমোক্র্যাটদের একটি অংশ মনে করে, ট্রাম্পকে পরাজিত করার এবং তার রাজনীতিকে থামানোর কৌশল হলো মাঝারি বা কেন্দ্রপন্থি রাজনীতিতে না ঝুঁকে একটি সাহসী, প্রগতিশীল এজেন্ডাকে আলিঙ্গন করা।
জোহরান মামদানির উত্থান এক নতুন ধরনের প্রগতিশীলতার প্রতীক যা ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে সামাজিক ন্যায়, অর্থনৈতিক সমতা ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি এমন এক প্রজন্মের কণ্ঠস্বর, যারা ‘পরিবর্তন’ শব্দটিকে আর স্লোগান হিসেবে নয় বরং জীবনের শর্ত হিসেবে দেখে।
তার নেতৃত্বে নিউইয়র্ক যদি সফলভাবে প্রগতিশীল নীতি বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য শহরের জন্যও এক অনুকরণীয় মডেল হতে পারে। জোহরান মামদানির বিজয় নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এটি কেবল একজন তরুণ রাজনীতিকের সাফল্য নয়; এটি আমেরিকার রাজনৈতিক চেতনার এক পুনর্গঠন।
এক শতাব্দী পর নিউইয়র্ক আবার প্রমাণ করল এই শহর এখনো স্বপ্নের শহর, যেখানে আদর্শ, মেধা ও মানবিকতা একসাথে জয়ী হতে পারে। তবে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন এখন শুরু হলো—এক তরুণ মেয়রের কাঁধে ভর করে, যিনি বিশ্বাস করেন, ‘শহরের সত্যিকারের শক্তি তার মানুষ।’

ড. সুজিত কুমার দত্ত : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
datta.ir@cu.ac.bd
সূত্র: ঢাকা পোস্ট