
বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নতুন রূপ পাওয়া বিতর্ককে কেন্দ্র করে—জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও তার পরবর্তী গণভোট আয়োজনের দাবিকে ঘিরে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা মতভেদ, দ্বন্দ্ব ও আদর্শিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে চলা এ দাবিকে সামনে রেখে সবচেয়ে সরব হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এই দুই রাজনৈতিক দল ঘোষণা দিয়েছে, তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি এবং এরপর গণভোট আয়োজন না হওয়া পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসবে না।
এই দৃঢ় অবস্থানের পেছনে একদিকে রয়েছে রাজনৈতিক প্রত্যয়, অন্যদিকে জনগণের মধ্যে নিজেদের অবস্থান নতুনভাবে প্রতিষ্ঠার কৌশল। তবে এই দাবির মধ্যে যেমন আদর্শের প্রশ্ন আছে, তেমনি রয়েছে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ, যা বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে—গণভোট হলে কী হবে? যদি গণভোটে জুলাই সনদ বা প্রস্তাবটি পরাজিত হয়, তবে সেটি কি জনগণের প্রত্যাখ্যান হিসেবে গণ্য হবে? সেই পরাজয় জুলাই সনদের ভাবধারাকে শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, নৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যারা জুলাই সনদকে দেশের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা হিসেবে দেখতে চান, তাদের জন্য এটি হবে একরকম প্রতীকী ‘হত্যা’।
বিষয়টি কেবল একটি নীতিনির্ধারণী প্রস্তাব নয়—এটি এখন এক রাজনৈতিক চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। জুলাই সনদের কট্টর সমর্থকরা এটিকে গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠার দলিল হিসেবে উপস্থাপন করছেন, অপরদিকে অন্যরা বলছেন, এটি কেবল একটি কৌশলগত চাল, যার মাধ্যমে কিছু দল তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চাইছে।
তুলনা করা হচ্ছে বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক আচরণের সঙ্গে। শেখ হাসিনা তার প্রয়াত পিতাকে অতিমাত্রায় গৌরবান্বিত করতে গিয়ে একরকম ‘রাজনৈতিকভাবে পুনরায় হত্যা’ করেছেন। অতিরিক্ত গৌরবের এই প্রয়াস তার পিতার মানবিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আড়াল করেছে। একইভাবে, যদি এনসিপি ও জামায়াত জুলাই সনদকে ঘিরে এমন এক রাজনৈতিক অবস্থান নেয়, যা জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিফলন নয়, তবে তারাও জুলাইকে রাজনৈতিকভাবে ‘হত্যা’ করার দায় থেকে মুক্ত থাকতে পারবে না।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে কোনও দল বা নেতৃত্ব নিজেদের মতামতকে জনগণের মত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। ফলাফল কখনই শুভ হয়নি। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে শুরু করে সামরিক শাসন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন—সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যখন নেতারা জনগণের ইচ্ছার ওপর নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিয়েছেন, তখন তা শেষ পর্যন্ত বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
রাজনীতিতে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস অনেক সময় আত্মবিনাশের কারণ হয়। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রশ্নেও সেই ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি উভয়েই বলছে, জনগণ তাদের সঙ্গে আছে, তারা জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশের জনগণ কখনই একমুখী নয়। তারা কখনও ধর্মীয় আবেগে, কখনও জাতীয়তাবাদী উচ্ছ্বাসে, আবার কখনও পরিবর্তনের প্রত্যাশায় সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে কোনও রাজনৈতিক শক্তি যদি ধরে নেয় যে জনগণ তাদের পক্ষে নিশ্চিত, তবে সেটি হতে পারে আত্মপ্রবঞ্চনা।
তাছাড়া, গণভোটের মাধ্যমে একটি জাতীয় ইস্যু নির্ধারণের প্রস্তাব যতই গণতান্ত্রিক শোনাক না কেন, বাস্তবে এর প্রয়োগ অনেক বেশি জটিল। গণভোট মানে জনগণের প্রত্যক্ষ মতামত নেওয়া, কিন্তু সেই মতামতকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা বিশাল। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় গণভোটের আগে, চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা এবং জনমতের স্বাধীনতা কতটা নিশ্চিত করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
জুলাই সনদের কট্টর সমর্থকরা বলছেন, এটি বাস্তবায়িত হলে দেশে নতুন রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে নাগরিক অধিকার, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। তাদের ভাষায়, এটি কেবল একটি ইশতেহার নয়, বরং “বাংলাদেশের নতুন চুক্তিপত্র”। অপরদিকে সমালোচকেরা এটিকে একধরনের রাজনৈতিক রোমান্টিসিজম হিসেবে দেখছেন—যেখানে বাস্তবতার তুলনায় আদর্শের রঙ অনেক বেশি।
অনেকের মতে, জুলাই সনদ নিয়ে এই উত্তাপের পেছনে আসলে আছে রাজনৈতিক অবস্থান দখলের লড়াই। জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে মূলধারার রাজনীতিতে পুনরায় প্রবেশের সুযোগ খুঁজছে। দলটির একটি আদর্শিক ভিত্তি এখনও টিকে আছে। অন্যদিকে এনসিপি তুলনামূলকভাবে নতুন দল হলেও, তাদের আকর্ষণ হলো ‘বিকল্প রাজনীতি’-র স্লোগানে। জুলাই সনদ ইস্যুটি উভয় দলের জন্যই হয়ে উঠেছে এক ধরনের যৌথ মঞ্চ, যেখানে তারা নিজেদের রাজনৈতিক উপস্থিতি নতুনভাবে জানান দিতে পারছে।
তবে এই জোট বা সমন্বয়ের ভেতরেই রয়েছে ভাঙনের বীজ। কারণ দুই দলের লক্ষ্য ও দর্শন এক নয়। জামায়াতের আদর্শ যেখানে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রচিন্তার দিকে ঝোঁকে, সেখানে এনসিপি নিজেদের তুলে ধরে নাগরিক সমাজভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে। জুলাই সনদের প্রতি তাদের সমর্থন যতটা আদর্শিক, তার চেয়ে বেশি কৌশলগত। এ কারণেই আশঙ্কা আছে, অদূর ভবিষ্যতে এই জোটে বর্তমানে দৃশ্যমান মতভেদের চেয়ে আরও বড় বিরোধ দেখা দিতে পারে।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষ এখনও বিভ্রান্ত। তারা বুঝতে পারছে না, জুলাই সনদ আসলে কী পরিবর্তন আনবে। রাজনৈতিক ভাষায় লেখা ঘোষণাপত্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রতিশ্রুতি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা স্পষ্ট নয়। যখন দেশে মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, দুর্নীতি ও সামাজিক বৈষম্যের মতো বাস্তব সমস্যা বিদ্যমান, তখন মানুষ কতটা আগ্রহ নিয়ে এমন একটি তাত্ত্বিক বিতর্কে অংশ নেবে, সেটিই বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশের রাজনীতির অতীত অভিজ্ঞতা বলে, যখন কোনও রাজনৈতিক শক্তি নিজেদের দাবি বাস্তবায়নের জন্য একপেশে পথে হাঁটতে শুরু করে, তখন গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে যেমন প্রশ্ন উঠেছিল, তেমনি জুলাই সনদ ইস্যুকেও কেন্দ্র করে নতুন এক অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।
এখনও সময় আছে—রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতার পথ বের করতে পারে। গণভোট আয়োজনের আগে জনগণকে স্পষ্টভাবে বোঝাতে হবে জুলাই সনদের লক্ষ্য ও প্রভাব কী। আর যদি সত্যিই জনগণের মতামতকে মূল্য দেওয়া হয়, তবে ফলাফল যাই হোক না কেন, সেই মতামতকে সম্মান জানাতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে দলকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এখন সময় এসেছে নীতিনির্ভর রাজনীতির দিকে ফেরার। জুলাই সনদ সেই পরিবর্তনের অনুঘটক হতে পারে—যদি এটি জনগণের জন্য হয়, দলের জন্য নয়। কিন্তু যদি এটি পরিণত হয় আরেকটি ক্ষমতার কৌশলে, তবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে—যেখানে নেতৃত্বের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি শেষ পর্যন্ত নিজেকেই আঘাত করে।
রাজনীতিতে যেমন উদ্দীপনা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সংযম। অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস বা বাড়াবাড়ি—বিশেষ করে যখন তা জনমতের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়—তখন সেটি গণতন্ত্রের জন্য নয়, বরং অরাজকতার জন্য কাজ করে। এ কারণেই বলা হয়, কোনো কিছুতেই বাড়াবাড়ি ভালো নয়। আর ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, নিজের ইচ্ছাকে জনগণের ইচ্ছা বলে প্রচার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাওয়া শেষ পর্যন্ত নিজেদের পতনের পথই প্রশস্ত করে।
জুলাই সনদ হয়তো একদিন বাস্তবায়িত হবে, কিংবা সময়ের স্রোতে মিলিয়ে যাবে। কিন্তু এ বিতর্ক আমাদের মনে করিয়ে দেয়—গণতন্ত্র কেবল একটি ধারণা নয়, এটি একটি চর্চা, যেখানে জনগণের মতই শেষ কথা। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সেই সত্য ভুলে যায়, তবে তাদের সনদ, প্রস্তাব কিংবা আন্দোলন—সবই ইতিহাসের কোলাহলে হারিয়ে যাবে।
লেখক: অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন