গত পরশু থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবিকে কেন্দ্র করে বেশ আলোচনা হচ্ছে। সেই ছবিটি অবশ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। ছবিটি হচ্ছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার মেয়ের ছবি। তবে ছবিটি কি আসল নাকি নকল, নাকি আর্টিফেসিয়াল ইনটেলিজেন্স দিয়ে করা- সেটি নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক। ছবিটি অবশ্য গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস বিভাগ থেকেই। তারা দাবি করেছেন ছবিটি ট্রাম্পের কার্যালয় থেকেই প্রকাশ এবং প্রচার করা হয়েছে। আর বাংলাদেশে এবং বাইরের অনেকেই এই ছবির পোস্টমর্টেম করছেন। তারা কোথায় প্রধান উপদেষ্টার হাত, তার গ্রামীণ চেকের পাঞ্জাবির নকশা আর কোথায় ট্রাম্পের কোর্ট আর কোথায় তার আঙুল সেগুলোর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আর উচ্চতা মাপছেন।
ছবিটি সত্য কি নকল সেই বিষয় নিয়ে আলাপে আমার আগ্রহ কম। বরং আমি আগ্রহী এটা জানতে, যেসকল রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বিশেষ করে রাষ্ট্র প্রধানরা জাতিসংঘের এই অনুষ্ঠানে এবং অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছেন তারা সবাই কি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ছবি তোলেন বা তুলেছেন এবং তারা কি তাদের দেশের রাজনীতিতে এই ছবিকে কাজে লাগান? কেন এই ছবি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এত গুরুত্ব পেলো? এর মধ্য দিয়ে কী কোনও ধরনের বার্তা দেওয়া হয়? এই ধরনের ছবি কী আসলে সত্যিই কাউকে ক্ষমতায় রাখতে পারে?
যদিও ছবি কূটনীতি বলে একটি টার্ম অনেকটাই প্রচলিত। এবং ছবি দিয়ে কূটনীতি এবং রাজনীতি যে বাংলাদেশে এই প্রথম ঘটলো, তা নয়। বরং এই ছবিটি দুই বছর আগের একটি ছবির কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। অনেকরই হয়তো মনে আছে যে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে একটি সেলফি তুলেছিলেন। সেই ছবিতে হাস্যোজ্জ্বল বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনা এবং তার মেয়ে পুতুলকেও দেখা গিয়েছিল, যেমনটি এই ছবিতে আছে ড. ইউনূসের কন্যা দিনা। তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়েছিল, বাইডেন নিজেই এ সেলফি তুলতে চেয়েছেন।
ওই সময় সেই ছবিটি রাজনৈতিক ময়দানে অনেক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। কারণ তখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্ক খারাপ ছিল। সেই ছবি বিশেষত বিএনপি’র রাজনীতিই শুধু নয়, বিএনপি নেতাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে বলে দাবি করেছিল আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদানের জন্য আমেরিকায় সফররত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাইডেনের সঙ্গে সেলফি তোলা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমার পরামর্শটা নেবেন। এই ছবিটা (জো বাইডেনের তোলা সেলফি) বাঁধিয়ে গলায় দিয়ে ঘুরে বেড়ান। ওটা আপনাদের যথেষ্ট সাহায্য করবে। এটা দিয়ে জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে বাইডেন এখন আমার সঙ্গে আছে।’
এর পরবর্তী বাংলাদেশ কেমন ছিল আমরা সবাই তা কম বেশি জানি। জো বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সেলফি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় তুলতে পারলেও ওই সরকারের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক উন্নয়নে সেলফিটি তেমন কাজে যে আসেনি সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ তার প্রমাণ দিয়েছে। শেখ হাসিনা ওগুলো করেছেন, কারণ তিনি ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছেন।
কিন্তু ড. ইউনূস? তিনি কেন করছেন? আমি সত্যিই এটি জানতে আগ্রহী- কেন অধ্যাপক ইউনূসকে হাসিনার দেখানো তরিকা অনুসরণ করতে হচ্ছে? কেন তার সময়ও আমেরিকার সঙ্গে তিনি কতটা ঘনিষ্ঠ সেটি প্রমাণ করতে হচ্ছে? তিনি তো ক্ষমতায় থাকতে আসেননি। তার ভাষ্য অনুযায়ী তাঁকে অনুরোধ করাতে তিনি এই দায়িত্ব নেন। সেই হিসেবে ধরেই নিচ্ছি তিনি ক্ষমতার সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চান না। তিনি কোন রাজনৈতিকও দল করেন না। তাহলে তাকে কেন প্রমাণ করতে হবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা? তিনি তাহলে কী চাচ্ছেন? তবে তিনি কি এই ধরনের উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তার কোনও আগ্রহ আ আকাঙ্ক্ষা বোঝাচ্ছেন?
ক্ষমতার সঙ্গে নয় বরং তার তো অন্য কিছু প্রমাণের কথা। বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি ঘনিষ্ঠ, আস্থাভাজন, কতটা আপন- সেটাই তো তার প্রমাণ করার কথা। কিন্তু সেই দিকে তিনি আমলে দিচ্ছেন না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্র থেকে জানা যায়, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব একটি জরিপের বরাত দিয়ে কিছুদিন আগেই বলেছেন দেশের ৭৮ শতাংশের বেশি মানুষ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট। কিন্তু এই জরিপের সঙ্গে তো কাজ মিলছে না। যে কারণে সরকারকে ক্ষমতার সঙ্গে ছবি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হচ্ছে। এ যেন, শেখ হাসিনাকেই অনুকরণীয় চরিত্র হিসেবে হাজির করা!
শেখ হাসিনাকে পারেনি, সেই হিসেবে এসময় ট্রাম্পের সঙ্গে ছবি তাই কতটা পারবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে রক্ষা করতে সেটি এখন বলার বিষয় নয়, এটি এখন দেখার বিষয়। তবে ছবি প্রচার করে কিংবা সেটি ছড়িয়ে দিয়ে কেউ কখনও গদি টিকিয়ে রাখতে পারেনি, অন্তত ইতিহাসে সেই সাক্ষ্যই দেয়। আর বিএনপি মহাসচিব কি এবারও প্রধান উপদেষ্টাকে এই ছবি গলায় ঝুলিয়ে রাখার পরামর্শ দেবেন?
কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি মেয়ের ছবি দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। মেয়েটিকে তার স্বামী হত্যা করেছে। অথচ তার আগের দিনেই সেই মেয়েটি স্বামীর সঙ্গে একটি রোমান্টিক ছবি পোস্ট করেছিল। তাই ছবি দিয়ে যত কিছুই উপস্থাপনা করুক না কেন, ছবি আসলে কাউকেই রক্ষা করে না। তাই ছবি রাজনীতি-কূটনীতির সত্য-মিথ্যা আদতেই কোনও ভবিতব্য নির্ধারণ করে না।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন