গত সপ্তাহে ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাজে স্থানীয় যানবাহন এডমিনিস্ট্রেশন অফিসে যাওয়া জরুরি হয়ে পড়ল আমার। আমি থাকি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডের অঙ্গরাজ্যের কলেজ পার্ক বলে শহরের যে এলাকায় আছি, সেখান থেকে প্রায় পাঁচ মাইল দূরের বেলটসভিল এলাকায় সেই অফিস। শহরে কিছু পাবলিক বাস চললেও, বেলটসভিলের ওই দিকটায় যায় না। অগত্যা পয়সার মায়া ছেড়ে রাইড শেয়ার সার্ভিসের দ্বারস্থ হতে হল।
মোহাম্মদ হোসাইন নামের একজন ড্রাইভার এলেন। গাড়িতে চড়েই দেখি, তিনি মোবাইলে একটা গানের ভিডিও দেখছেন—অনেকটা কাওয়ালি ধরনের সুর ও আয়োজন, কিন্তু ভাষাটি আমার অজানা। প্রায়ই নানান দেশের চালকরা আসেন, তাদের নিজেদের ভাষার গান চলতে থাকে গাড়িতে, কখনো আগ্রহ করে জিজ্ঞেস করা হয়, কখনো হয় না।
এবার আলাপ শুরু হল তার দিক থেকেই। আমার নাম শুনে প্রথমে ভেবেছিলেন, আমি পাকিস্তান কিংবা ভারতের নাগরিক। বাংলাদেশ শুনে হালকা হেসে ধর্ম জিজ্ঞেস করলেন—নিশ্চিন্ত হলেন আমরা দুজনেই ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তার দেশ অনুমানে আমিও ভুল করেছিলাম, ভেবেছিলাম তিনি ইরানি, নয়তো মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো দেশের অভিবাসী, কিন্তু জানালেন, তিনি আফগানিস্তানের মানুষ। আমেরিকায় আছেন প্রায় পাঁচ বছর।বাংলাদেশি পোশাক
গণমাধ্যম আর রাজনীতি নিয়ে কৌতূহল থেকেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমাদের দেশের লোকজন, এমনকি খবরের কাগজেও প্রায়ই বলা হয়, আমেরিকান সেনারা দেশ ছাড়ার পর তালেবান সরকারের অধীনে আফগানিস্তান বেশ ভালো চলছে, তোমরা উন্নতি করছ—সত্যিই কি তাই?”
হোসাইন কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললেন, “এটাকে তুমি সরকার কেন বলছ? তারা তো অস্ত্রের মুখে ক্ষমতা দখল করে রাখা একটা গোষ্ঠী।” একটু থেমে যোগ করলেন, “তালেবানরা দেশে টিকে আছে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে। সব সরকারি পদে, প্রতিষ্ঠানে, চাকরিতে তারা নিজেদের লোক বসিয়ে রেখেছে। যারা এখন দেশ চালাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই নিরক্ষর। এরা আজ দেশের ‘ম্যানেজার’। উইদাউট এনি এডুকেশন!”
আমার পালটা প্রশ্ন, “তাহলে, মিডিয়া যে তালেবান সরকারকে ভাল বলছে এর কারণ কী?” তার উত্তর, “সব মিডিয়া তো তারা দখল করে রেখেছে, তারা যা বলতে চায় মিডিয়া তাই বলে, হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া আর কোনো সোশ্যাল মিডিয়া নেই আফগানিস্তানে।”
নিজেই নারীদের প্রসঙ্গ তুললেন। বললেন, “আমাদের মেয়েরা-বোনেরা এখন ঘরবন্দি। ষষ্ঠ শ্রেণির পর তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ তো বহু আগেই শেষ। এখন শুনছি, নারীদের লেখা বইও পাঠ্যসূচি থেকে সরিয়ে দিয়েছে—মানে জ্ঞানের দরজাই বন্ধ করে দিচ্ছে।”
তার কণ্ঠে তখন গভীর হতাশা। “তালেবান বলে তারা শরিয়তের নামে এসব করছে, কিন্তু তারা যা করছে, তার অনেক কিছুই ইসলামের বাইরে। ইসলাম মানুষকে হত্যা করতে বলেনি, ইসলাম জ্ঞান অর্জন থেকে সরে যেতে বলেনি। ইকরা শব্দ দিয়ে কোরান শুরু হয়েছে—পড়, শিখ, জান।”
আজ যখন আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্তে সংঘাত চলছে, আর কূটনৈতিকভাবে সেখানে ভারতকে দেখা যাচ্ছে কাবুলের পাশে, তখন হোসাইনের কথাগুলোই বারবার মনে পড়ছে। যে আদর্শে ভারত ও আফগানিস্তান—দুই দেশের বর্তমান ক্ষমতার অক্ষ—ঘুরছে, তা তো মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। একদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে ইসলামি শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্রচিন্তা। তবুও কূটনীতি ও আঞ্চলিক রাজনীতির স্বার্থে তারা এখন এক অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়েছে— মজেছে এক ‘প্রয়োজনের প্রেমে’। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান এখন তাদের প্রতিপক্ষ আর হিন্দু জাতীয়তবাদী সরকারের অধীনে চলা ভারত এখন তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের ‘কৌশলগত মিত্র’, নতুন অংশীদার। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এ দৃশ্য কূটনীতিতে ‘বাস্তববাদিতার’ আরেক যুগান্তকারী উদাহরণ। আর ধর্ম ও তাকে পুঁজি করা আবেগ যে কেবল রাজনীতি আর ক্ষমতার হাতিয়ার তাও স্পষ্ট।
অক্টোবরের শুরুতে কাবুল ও পাকতিকা প্রদেশে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের দায় পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে তালেবান সরকার এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিয়েছে। একসময় ইসলামাবাদের আশ্রিত হিসেবে বিবেচিত এই সরকার এখন তার সাবেক মিত্রকেই অভিযুক্ত করছে সন্ত্রাসী হামলার জন্য। ঘটনাটি ঘটেছে এমন এক সময়, যখন তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারতে উচ্চপর্যায়ের সফরে ছিলেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে, তালেবান সরকার পাকিস্তানের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে একটি স্বতন্ত্র কূটনৈতিক পরিচয় গড়তে চাইছে।
অন্যদিকে পাকিস্তান এখন একই সঙ্গে দুই দিকের চাপের মুখে—একদিকে তালেবানের আশ্রয়ে থাকা পাকিস্তান তালেবান (টিটিপি)–এর হামলা, অন্যদিকে আফগানিস্তানের দিক থেকে কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদ। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক অক্ষ এখন ইসলামাবাদ নয়, বরং কাবুল ও নয়াদিল্লির নতুন সমীকরণের দিকে ঘুরছে—যেখানে আদর্শ নয়, বাস্তবতা ও স্বার্থই নতুন সম্পর্কের ভিত্তি।
এটা অবশ্য হওয়ারই ছিল। কেননা এই প্রেমের যে স্বার্থ তার উপকারভোগী কাবুল ও নয়াদিল্লি দুই পক্ষই। ভূরাজনীতির বাস্তবতায় ভারতের কাছে আফগানিস্তান মধ্য এশিয়ার প্রবেশদ্বার, আবার পাকিস্তানের সঙ্গে তার যে ঐতিহাসিক টানাপোড়েন, সেখানে পাকিস্তানকে কৌশলগত চাপে রাখার হাতিয়ারও আফগানিস্তান। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সাম্প্রতিক নয়াদিল্লি সফরের দিকেই তাকানো যাক। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর এটাই ছিল তাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভারত সফর—যা আগে অকল্পনীয় ছিল। সফরের তাৎপর্য শুধু কূটনৈতিক নয়, দিকনির্ধারকও—পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতির প্রেক্ষাপটে তালেবান এখন ভারতের দিকে ঝুঁকছে, আর দিল্লি তাদের সঙ্গে বাস্তববাদী যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। এই সফরে মুত্তাকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং এর পরই দিল্লি ঘোষণা দিয়েছে, চার বছর আগে বন্ধ করে দেওয়া কাবুল দূতাবাস তারা পুনরায় খুলবে। মুত্তাকিও বলেছেন, ভারত তাদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
তালেবান শাসিত কাবুল যে এখন নিজস্ব কূটনৈতিক পরিচয় গড়তে চাইছে তা সাদা চোখেই বোঝা যাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে পুঁজি করে তারা আঞ্চলিক সমর্থন ও বৈধতার লক্ষ্যে কাজ করছে। এটি এক নতুন সমীকরণ যেখানে বিজেপিশাসিত ভারত ও তালেবান শাসিত আফগানিস্তান, দুই বিপরীত মতাদর্শের সরকার, নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একই টেবিলে বসেছে। ইসলামাবাদের সঙ্গে ক্রমশ দূরত্ব তৈরি হওয়ায় তালেবান এখন দিল্লিকে দেখছে নতুন দরজার মতো—যেখান থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বিনিয়োগ এবং রাজনৈতিক বৈধতার বাতাস আসতে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই বাস্তববাদী। দিল্লি জানে, তালেবানের সঙ্গে সীমিত সম্পর্ক রাখলে অন্তত দুটি লাভ রয়েছে—প্রথমত, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের সুযোগ; দ্বিতীয়ত, ইরান ও মধ্য এশিয়ার করিডোর ধরে বাণিজ্যপথে প্রবেশাধিকার। চাবাহার বন্দর, আফগান ট্রানজিট রুট এবং উত্তর–দক্ষিণ ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আফগান ভূখণ্ডে স্থিতিশীলতা ও নিয়ন্ত্রণের ওপর। ফলে, কাবুলের সঙ্গে কূটনৈতিক সাক্ষাৎ কেবল রাজনৈতিক সৌজন্য নয়—এটি ভারতের আঞ্চলিক অর্থনীতিতে অবস্থান সুদৃঢ় করার পরিকল্পিত পদক্ষেপ।
অন্যদিকে তালেবানেরও প্রয়োজন নতুন বন্ধু—যে বন্ধু তাদের ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ তকমা থেকে ধীরে ধীরে বের করে আনতে সাহায্য করবে। তাই ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তাদের কাছে একধরনের রাজনৈতিক জীবনরক্ষার কৌশল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্যাংশনস কমিটির তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির ভারত সফরের জন্য সাময়িক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি এসেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বললেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কমিটি আমির খান মুত্তাকিকে এই সফরের অনুমতি দিয়েছে। এক অর্থে এটি তালেবানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রথম দরজা—যে দরজায় ওপারে ছাতা হাতে দাঁড়ানো ভারত। তালেবান সরকার এখন সেই ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে দেখাতে চায়, তারা আর সম্পূর্ণ একঘরে নয়; বরং বাস্তব রাজনীতির টেবিলে তারাও এখন একটা চেয়ার রাখে।
তবে এই ঘনিষ্ঠতা একধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বাস্তববাদও। কারণ তালেবান এখনো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়, তাদের মানবাধিকার ও নারীশিক্ষাবিষয়ক অবস্থান ভারতের মতো দেশের নৈতিক ও সাংবিধানিক অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আবার মুত্তাকির সফরের সময় কাবুল দূতাবাসে তালেবানের পতাকা তোলার চেষ্টা এবং নারী সাংবাদিকদের বাদ দিয়ে আয়োজন করা প্রথম প্রেস কনফারেন্সকে কেবল আনুষ্ঠানিক ভুল হিসেবে না দেখলে—এগুলো কূটনীতির টেবিলে নীতির সঙ্গে প্রয়োজনের নীরব সমঝোতার অংশ। ভারত সরকারের অবস্থান দেখিয়ে দিচ্ছে—দিল্লি এখন প্রয়োজনের কূটনীতিতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে নৈতিক অবস্থান আর অগ্রাধিকারে নেই। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নৈতিকতা অনেক সময় বাস্তবতার কাছে পরাজিত হয়। ভারত বুঝেছে, যদি কাবুলে প্রভাব না রাখে, তবে সেই জায়গা দখল করবে চীন কিংবা রাশিয়া।
তালেবান শাসিত কাবুল ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী দিল্লি—দুই বিপরীত মতাদর্শের মিলনে দক্ষিণ এশিয়া লিখছে কূটনীতির নতুন অধ্যায়। অথচ দূর আমেরিকার এক আফগান চালকের প্রশ্ন মনে করিয়ে দেয়, এই সব রাষ্ট্রীয় কূটনীতিতে হোসাইনদের মতো মানুষের জায়গা কোথায়? তাদের জীবনে কি ফিরবে আলোর দিগন্ত, নাকি থাকবে কেবল পাহাড়ের মতো কঠিন বাস্তবতা—যেখানে ধর্ম আছে, কিন্তু শিক্ষা নেই; রাষ্ট্র আছে, কিন্তু নাগরিকের কোনো কণ্ঠ নেই?
সূত্র: বাংলানিউজ ২৪.কম