৫ দিনে ৩ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

নাশকতা কিনা তদন্তে বেরিয়ে আসুক

একেএম শাকিল নেওয়াজ
  ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:২৮

দেশে পাঁচ দিনে তিনটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমরা দেখেছি। রাজধানীর মিরপুরে পোশাক কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউন, চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি কারখানা এবং সবশেষ দেশের প্রধান বিমানবন্দর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এসব অঘটন নিয়ে স্বভাবতই জনমনে উদ্বেগ ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সরকার এ বিষয়ে ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছে, যেখানে নাশকতার ইঙ্গিতও এসেছে। ঘটনাগুলো একটার পর একটা যেভাবে সামনে এসেছে তাতে নাশকতাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একই সঙ্গে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধী অবকাঠামো নির্মাণ, সমন্বয়হীনতাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ও ভুলে গেলে চলবে না।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ড অত্যন্ত ভয়াবহ বলতে হবে। সেখানে আমরা দেখেছি, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। যে কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থার অনেক কিছুই থাকে; ফায়ার ফাইটিং টিম, স্প্রিংকলার, ফায়ার হাইড্রেন্ট ইত্যাদি। এসব থাকলে আগুন এমনিতেই নিভে যাওয়ার কথা। অথচ খবর বলছে, আগুন নেভাতে সাত ঘণ্টা সময় লেগেছে।  তা ছাড়া আগুন লেগেছে ছুটির দিনে। কাজের দিনে বিদ্যুতের লোড বেশি থাকে। ছুটির দিনে অতটা না থাকলেও আগুন লাগার হেতু কী? 
আগুন এতটাই বিস্তৃত হয়েছিল; ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট এসেও নিয়ন্ত্রণে আনতে এত সময় লেগে গেল! সেখানে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম ছিল। কার্গো ভিলেজ ব্যবহার করে মূলতহালকা যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রনিক পণ্যের আমদানি এবং তৈরি পোশাক ও নমুনা, অল্প পরিমাণ অ্যাক্সেসরিজ, দলিলপত্র ও পার্সেল আমদানি-রপ্তানি করা হয়ে থাকে। সেখানে যেভাবে কোটি কোটি টাকার আমদানি পণ্য চালান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; কীভাবে হলো, কেন এত ক্ষতি হলো– তদন্ত করলে নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে।
চট্টগ্রামে যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল, তা এত দ্রুত ছড়িয়ে গেল কীভাবে? ছড়িয়ে গেলেও সেখানে স্প্রিংকলার সিস্টেম থাকার কথা। এটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, যাতে আগুন লাগলেই পানি ছিটানো যায়। ২০০ গজ দূরে ফায়ার স্টেশন থাকার পরও আগুন এত দেরিতে নিভল কেন– এ প্রশ্নগুলো উঠবেই। 
মিরপুরের রূপনগরের অঘটন ঘটেছে মঙ্গলবার। সেখানে রাসায়নিক গুদাম থেকে আগুন ছড়িয়ে পার্শ্ববর্তী চারতলাবিশিষ্ট পেশাক কারখানায় লেগে ১৬ জনের বেদনাদায়ক মৃত্যু আমরা দেখেছি। ভবনটি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, বলার অপেক্ষা রাখে না। সেখানে শ্রমিকের নিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থা ছিল না। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি লাগে। অথচ তার তোয়াক্কা এ ভবনসহ ঢাকা শহরের অনেক ভবনের ক্ষেত্রেই দেখা যায় না। ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি নিলে তারা একটি সিঁড়ির পরিবর্তে দুই-তিনটি সিঁড়ি তৈরি করতে বাধ্য করত। ভিন্ন দুটি সিঁড়ি দিয়ে মানুষ সহজেই বের হয়ে যেতে পারত। চারতলা এই ভবনে কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা, অ্যালার্ম কিংবা ডিটেকশন ব্যবস্থা ছিল না। তা ছাড়া সেখানে সবচেয়ে বেশি আগুন ছড়ানোর উপকরণ সুতা ছিল। এগুলোর কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তাপ যে বের হবে, তার জন্য ভেন্টিলেশন ব্যবস্থাও ছিল না।  
আগুন লাগার পর উদ্ধার তৎপরতায় ফায়ার সার্ভিস দ্রুততম সময়ের মধ্যে এলেও অনেক সময় উদ্ধারকার্যে যে ধরনের অবকাঠামো লাগে তা পাওয়া যায় না। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে করণীয় কী, সেটা এমন পরিস্থিতিতে অনেকের মাথায়ই থাকে না। এখানে মালিকের দায় বেশি। ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভাবে। কিন্তু তারা আসার আগেই প্রাথমিক কাজ করতে হয়। সেখানে ভবনের ব্যবস্থাপনায় যারা থাকেন তাদেরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা। তেমনটা হয়নি। হলে এত মানুষের প্রাণহানি হয়তো ঘটত না।
ঢাকা শহরে রয়েছে হাজার হাজার ভবন। এসব ভবনের অগ্নি সুরক্ষা একা ফায়ার সার্ভিস কীভাবে নিশ্চিত করবে? আগুন থেকে সুরক্ষা পেতে হলে সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তাও এককভাবে ফায়ার সার্ভিস করতে সক্ষম নয়। প্রতিষ্ঠানটির এত জনবল নেই। সে জন্য পাঠ্যপুস্তকে এটি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 
বিদেশে দেখেছি, শিশুরা ছুটির দিনে ফায়ার সার্ভিসে এসে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। বাবা-মা তাদের নিয়ে আসে। আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষায় দুর্যোগ সম্পর্কে কতটা আলোচনা করা হয়? শিক্ষাক্রমে এগুলো ঠিকভাবে না দেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা কীভাবে শিখবে? তা ছাড়া বাণিজ্যিক ভবন ও প্রতিষ্ঠানে ফায়ার অফিসার থাকা চাই। আমাদের সংস্কৃতিটা সেভাবে গড়ে তুলতে হবে।
বাড়িতে কীভাবে রান্না করবে, চুলা জ্বালানো-নেভানোর বিষয়ে সতর্কতাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই সঙ্গে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কীভাবে সবাই ভবন থেকে বের হবে, সেই সচেতনতা চাই। প্রথমেই মনে রাখতে হবে– আপনার নিরাপত্তা আপনাকেই সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হবে।
অগ্নিকাণ্ডের পর দুর্যোগ-পরবর্তী তৎপরতায় আমাদের নির্ভরশীলতা কেবল ফায়ার সার্ভিসের ওপর। ফায়ার সার্ভিসের কাজ কেবল আগুন নেভানো। অথচ তাদের চতুর্মুখী কাজ করতে হয়। মনে রাখতে হবে, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কিন্তু রাসায়নিক পদার্থ বিশেষজ্ঞ নন। কেমিক্যালের আগুন লাগলেও তাদের দৌড়াতে হয়। দালান ভেঙে গেলেও সেখানে উদ্ধার তৎপরতায় ফায়ার সার্ভিস।
পশুপাখি এমনকি নায়িকা উদ্ধারেও আমরা ফায়ার সার্ভিসকে দেখছি। সে জন্য সংস্থাটির জনবল বাড়িয়ে কিছু বিশেষায়িত টিম গঠন করা দরকার। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস আইন পরিবর্তন করাও জরুরি। কারণ বর্তমান আইন (২০০৩) এবং বিধিমালা (২০১৪) বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং এতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে অগ্নিনিরাপত্তার আধুনিকীকরণ ও উন্নততর সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব।  
কথা হলো, এবার একসঙ্গে এত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে একেবারে বিচ্ছিন্ন বলা যায় না। পোশাক কারখানা, বিমানবন্দর, সরকারি দপ্তর, গুদামঘর, শপিং কমপ্লেক্সসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সরলভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। এসব অগ্নিকাণ্ডের বেশ কিছু ঘটনার উৎস রহস্যজনক হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে– এসব কি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে আছে নাশকতা?
 সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব দুটি ফায়ার স্টেশন রয়েছে। মাত্র ৫০ থেকে ১০০ গজ দূরে। তারা কি সময়মতো সংবাদ পেয়েছিল? পেলে তারা যথাসময়ে সঠিকভাবে সাড়া দিতে পারল না কেন? সে জন্য প্রতিটি ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখতে হবে। এমনকি বিমানবন্দর এলাকায় যেখানে দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থাই সক্রিয়, তাদের কাছে বিষয়টি ধরা পড়েছে কিনা তাও দেখতে হবে। 
প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও আমরা ঘটনার পরই সজাগ হওয়ার ভান করি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যথাযথ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। আর নাশকতা হলেও যথাযথ তদন্ত এখানে জরুরি।
মেজর (অব.) একেএম শাকিল নেওয়াজ: অগ্নি ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ; সাবেক পরিচালক (অপারেশন্স), ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর 
সূত্র: সমকাল