শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি: দুর্ভাগ্য যার নাম

মাহবুব আলম
  ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৪:০৬

বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার সংখ্যার দিক থেকে অন্যতম বৃহৎ। কিন্তু চাকরির সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা একটি ক্যাডার। এই ক্যাডারে না আছে সঠিক সময়ে পদোন্নতি, না আছে যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা। অথচ অন্যান্য ক্যাডারে কর্মরতদের মতো আমরাও বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস তথা বিসিএস পরীক্ষা নামক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করি। কিন্তু যোগদানের পর থেকে জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের বঞ্চনার ইতিহাস দেখে দেশকে সেবা দেওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করেছিলাম, সেই উচ্ছ্বাসের স্রোতে ভাটা নেমে আসে। তা সত্ত্বেও ভেবেছিলাম, সামনে সুদিন আসবে।
কিন্তু দিনে দিনে সেই বঞ্চনা ও বৈষম্যের পরিধি বাড়তেই থাকে। আমাদের চেয়ে জুনিয়র কর্মকর্তা, যারা অন্য ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করেছেন; তারা সময়মতো পদোন্নতিসহ চাকরিতে প্রাপ্য সব সুবিধা পাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, অন্যান্য সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পদোন্নতি হচ্ছে; অথচ আমাদের সিনিয়র ব্যাচ থেকে শুরু করে আমাদের পরবর্তী ব্যাচগুলোতে পদোন্নতি যেন ডুমুরের ফুল হয়ে গেছে। বিগত সরকারের সময়ে, অর্থাত্ ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মাত্র এক বার ২০২১ সালে প্রভাষক (নবম গ্রেড) থেকে সহকারী অধ্যাপক (ষষ্ঠ গ্রেড) পদে পদোন্নতি হয়। অর্থাত্, পাঁচ বছরের শাসনামলে মাত্র একবার পদোন্নতি হয়, যা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। তার পরও অনেকে পদোন্নতিবঞ্চিত হন। অথচ এর মধ্যে ক্যাডার সার্ভিসের অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিয়মিত পদোন্নতি পেয়েছেন। এর জন্য বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিলেও অজানা কারণে আমাদের পদোন্নতি বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের রুল অনুযায়ী, একজন বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা বিভাগীয় পরীক্ষা, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ সমাপন ও সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় পাশ করা সাপেক্ষে পাঁচ বছর মেয়াদান্তে উচ্চতর স্কেল পাবেন। এ নিয়ম প্রশাসন ক্যাডারে যথাযথভাবে মানা হয়। অর্থাত্ প্রশাসন ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তা উপরোক্ত ধাপ পেরোনোর পর ঠিক পাঁচ বছর পর উচ্চতর স্কেল বা ষষ্ঠ গ্রেড পেয়ে আসছেন। এজন্য উঁচু স্তরে পদ খালি থাকা সাপেক্ষে পদোন্নতির কথা বলা হচ্ছে না।
ইদানীং অন্যান্য ক্যাডারেও এই নিয়ম প্রতিপালন করা হচ্ছে। যেমন—২০১৮ সালে কৃষি ও মত্স্য ক্যাডারে যোগদান করা কর্মকর্তারা ঠিক পাঁচ বছর পর অর্থাত্, ২০২৩ সালেই তাদের প্রথম পদোন্নতি পেয়েছেন। অথচ ক্যাডার সার্ভিসের অন্যতম বৃহত্ ক্যাডার শিক্ষা ক্যাডারের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। ‘পদোন্নতির জন্য উঁচু স্তরে পদ খালি নেই’—এ কথা বলে আমাদের বারবার বঞ্চিত করা হচ্ছে। এতে যেমন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি, তেমনি সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছি।
যাই হোক, অনেক দেনদরবার করার পর বিগত সরকারের শেষ সময়ে, অর্থাত্ নভেম্বরে প্রভাষকদের পদোন্নতির জন্য বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি (ডিপিসি) বসে। বিভিন্নভাবে কালক্ষেপণ করে সেই ডিপিসি শেষ হয় বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর। যাই হোক, প্রায় তিন বছর পর পদোন্নতির খবরে সাত বছর থেকে বারো বছর ধরে পদোন্নতিবঞ্চিত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু দীর্ঘ এক মাস ধরে সেই পদোন্নতির সরকারি আদেশ (জিও) ঝুলে যায়। কিন্তু কথায় আছে, অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকিয়ে যায়। এর মধ্যে শোনা যায়, শিক্ষাসচিব বিদেশে গেছেন বলে পদোন্নতির জিও প্রকাশিত হচ্ছে না। এই ডিজিটাল সময়ে বিশ্বের যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো নথি স্বাক্ষর করে ওয়েবসাইটে আপলোড করা যাচ্ছে, অথচ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সূচনাকারী বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তখন দেখা যায় শিক্ষাসচিবের বিদেশে অবস্থান করার কারণে আমাদের পদোন্নতি আটকে যায়। যাই হোক, তিনি জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে দেশে ফিরলেন, তখন আবার আশায় বুক বাঁধা শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন তাদের পদোন্নতির জন্য।
এর মধ্যে নতুন আরেক বিপদ হাজির হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, শূন্য পদের বিপরীতে একটার বেশি পদে পদোন্নতি দেওয়া যাবে না। অথচ, যেহেতু শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বিগত সময়ে দুই-তিন বছর পর পর হচ্ছে, আর সে কারণে পদোন্নতির যোগ্য শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংখ্যা প্রতি বছরই সেইভাবে বাড়ছে, এজন্য পদোন্নতিপ্রাপ্তদের ইনসিটু (পূর্বের পদে চাকরি করা) রাখা হয়। এতে সরকারের এক টাকাও বাড়তি দিতে হয় না। সেই ধারাবাহিকতা বিগত বছরগুলোতে চলে আসছে। একইভাবে আমরা দেখছি, প্রশাসন, পুলিশ ক্যাডারেও সুপারনিউমারি (সংখ্যাতিরিক্ত) পদে পদোন্নতি দিচ্ছে। এমনকি প্রশাসন, পুলিশ ক্যাডারে বছরে দুটি পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। শূন্য তো দূরের কথা, পদের চেয়ে তিনগুণ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
যেহেতু ২০১৫ সালের পে-স্কেল অনুযায়ী বর্তমানে যারা পদোন্নতির যোগ্য হচ্ছেন, তাদের পদোন্নতি দিলে সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ থাকছে না, বিশেষ করে যারা নবম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতির জন্য দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছেন, সেহেতু পদোন্নতি দিলে এসব কর্মকর্তার মধ্যে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। সেই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা ক্যাডারে সর্বশেষ ২০২১ সালে পদোন্নতি হয়েছে আর অন্যান্য ক্যাডারে তো নিয়মিত হচ্ছেই।
কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম হতাশা ও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। একবিংশ শতাব্দীতে এগিয়ে চলার জন্য যখন উন্নয়নমুখী বাংলাদেশ সরকার নানা রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে, বিভিন্ন চাকরিতে দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ দিয়ে সর্বস্তরের জনগণের আশা-ভরসা ও প্রশংসার জোয়ারে ভাসছে, ঠিক তখন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে জনপ্রিয় এই সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপপ্রয়াস চলছে। ২০১৫ সালের পে-স্কেল ঘোষণার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন ক্যাডারে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশ দীর্ঘ প্রায় আট বছর ধরে উপেক্ষিত। বরং দিনে দিনে সেই বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। এতে যেমন বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে, অন্যদিকে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটা সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ার প্রয়াস বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, আমাদের পদোন্নতিজনিত সমস্যার সমাধানে আপনার দৃঢ় অবস্থান ও হস্তক্ষেপ দিয়ে আমাদের শিক্ষা ক্যাডারকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা রাখার সুযোগ প্রদান করবেন।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, গোপালগঞ্জ