গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের পক্ষে জার্মান সরকারের সমর্থন অনেককেই বিস্মিত করেছে। ২০২৩ সালের ১২ অক্টোবর দেশটির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেছিলেন, ‘এ মুহূর্তে জার্মানবাসীর একটাই পথ। আমরা ইসরায়েলের পাশে আছি। ইসরায়েলের নিরাপত্তা জার্মান রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত– এর মধ্য দিয়ে মূলত আমরা সে কথাই তুলে ধরি।’ জার্মান সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যকাররা আন্তর্জাতিক আদালত-আইসিজে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলাটিকে ‘স্পষ্টত একতরফা’ ঘোষণা করে একে অবৈধ প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। জার্মানির অর্থমন্ত্রী রবার্ট হেব্যাক তো বিষয়টি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে গিয়ে বলেছেন– ‘আমার মতে, গণহত্যার জন্য ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করা ঠিক নয়। মূলত এই মামলায় অপরাধের শিকার ও অপরাধীদের উল্টো করে উপস্থাপন করা হয়েছে।’ এখানেও নাৎসি বাহিনীকে উসকে দিতে জার্মান পুঁজিবাদী শ্রেণির ভূমিকার সঙ্গে ইসরায়েলের ব্যাপারে সব জার্মান যে ‘বিশেষ ঐতিহাসিক দায়িত্ব’ পালন করছে, তাকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। ‘ইতিহাসে আমাদের সবচেয়ে কালো অধ্যায়ের কারণে জার্মানিকে এ মুহূর্তে চলমান গণহত্যার জন্য ভয়াবহ দায় নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। (…) জার্মানের নাৎসি বাহিনী ইউরোপে ইহুদিদের বিরুদ্ধে যে হলোকাস্ট ঘটিয়েছে, তা মানবেতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধের মধ্যে একটি। এসব মাথায় রেখে আমরা মনে করি, যারা বেসামরিক লোকদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তাদের সর্বোচ্চ ভোগান্তিতে ফেলতে এবং প্রতিরক্ষার নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল আত্মরক্ষার্থে এ পদক্ষেপ নিয়েছে। এখানে গণহত্যা সংঘটিত করা উদ্দেশ্য নয়।’
এই যুক্তি বিপুলসংখ্যক জার্মান নাগরিককে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু গ্লোবাল সাউথ এসব শুনতে রাজি নয় এবং তারা জার্মান সরকারের ভন্ডামির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। প্রথম গুরুতর অভিযোগটি এসেছিল ২০২৪ সালের শুরুর দিকে। নামিবিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হেগ গেইনগব এক বিবৃতিতে বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘১৯০৪-০৮ সালের মধ্যে জার্মানি প্রথম গণহত্যা চালিয়েছিল। তখন দশ হাজার নিরপরাধ নামিবিয়ানকে সবচেয়ে নৃশংস ও সহিংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল।’
২০২৪ সালের মার্চের শুরুতে গ্লোবাল সাউথের জনগণের কাছ থেকে পরবর্তী চ্যালেঞ্জটি আসে। নিকারাগুয়া আইসিজেতে সরাসরি জার্মানির বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের করে। এতে বলা হয়, বার্লিন ১৯৪৯ সালের ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ ভঙ্গ করেছে। একদিকে দেশটি ইসরায়েলকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সমর্থন দিয়েছে এবং অন্যদিকে নিকটপ্রাচ্যের উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের জন্য জাতিসংঘকে চাঁদা না দিয়ে গণহত্যা সংঘটনে সহায়তা করেছে। তা ছাড়া গণহত্যা ঠেকাতে যেসব করণীয় ছিল, তা মানতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে।’ তবে জার্মান উদারবাদীরা দ্রুত এই বলে বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছে যে, ‘স্বৈরশাসকরা নিজেদের নাগরিকদের আইনের শাসনের কোনো নিশ্চয়তা দিচ্ছে না এবং তা থেকে মনোযোগ সরানোর জন্য বিষয়টিকে সস্তা একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে।’
সাম্প্রতিক এ পরিস্থিতি দেখিয়ে দেয়, পশ্চিমা আদর্শিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক ভিন্নমত ঠেকিয়ে দিতে ‘নিয়মের ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক নির্দেশ’ এবং জার্মানির ‘রাষ্ট্রসংক্রান্ত’ ধারণা আগের মতো যথেষ্ট প্রভাব ফেলে না। গ্লোবাল সাউথে ‘নতুন এই ভাবের’ প্রকাশ মূলত আইসিজের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ওপর তাদের স্বত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইকেই তুলে ধরে।
জার্মানি এখনও পুরোনো কঙ্কালসার পুঁজিবাদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ইসরায়েলের প্রতি দেশটির নিঃশর্ত সমর্থনের পেছনে দুটি দিক কাজ করেছে– এক. মূলত অঞ্চলটিতে নিজেদের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক আগ্রহ; দুই. হলোকাস্টের দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা এবং পশ্চিম জার্মানির সমাজকে নাৎসিহীন করার অনিচ্ছা। তাদের তুলনায় জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক একেবারে ভিন্ন ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। এটি কমিউনিস্ট ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরাই পরিচালনা করত। নাৎসিদের কথিত তৃতীয় সাম্রাজ্যে তাদের নির্বাসন ও হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে যেতে হয়েছিল। ‘আর কখনও নয় বা নেভার অ্যাগেইন’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে শুধু জার্মানদের যৌথ অনুশোচনাই তুলে ধরা হয় না, বরং স্বৈরাচার ও জাতিবাদকে উপড়ে ফেলার সশস্ত্র প্রচেষ্টারও বার্তা দেয়। এ কারণে জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকানরা ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার অধিকার ও দখলদারদের প্রতিরোধকে কট্টরভাবে সমর্থন করে। বর্তমানে জার্মানিতে এ বিষয়ে সাধারণের তর্ক করার সুযোগ ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন সরাসরিভাবে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এরপরও জার্মান সরকার খুব সহজেই গ্লোবাল সাউথের রাষ্ট্রগুলোকে থামিয়ে দিতে পারছে না।
ম্যাথিউ রিড: বার্লিনভিত্তিক জেটকিন ফোরামের একজন গবেষক; পিপলস ডেসপাচ থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম