আমি আজ আপনাদের সামনে আলোচনা করতে বসেছি যে আপনি আপনার আয় কীভাবে বাড়াবেন। আসলেই কি তা সম্ভব? আপনার এখন যে আয় এটা ধরে রাখা কষ্টকর কিন্তু সত্যিকার অর্থে আপনার যদি ঐকান্তিক প্রচেষ্টা থাকে আপনি যদি প্রকৃতপক্ষে চান যে আপনার আয় বাড়াবেন তাহলে এটা সম্ভব। কিন্তু আপনাকে কিছু বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে।
কয়েকদিন আগে পথ চলতে চলতে এক ভদ্রলোক সালাম দিলেন। পেছনে তাকিয়ে দেখি যে একটা ছেলে ফুডপান্ডার ব্যাগ ঘাড়ে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটি বলল, ‘স্যার আমাকে চিনতে পারছেন”? আমি বললাম যে হ্যাঁ চিনতে পেরেছি। ছেলেটি ব্যাংকে আমার সাথে কাজ করতো। তারপর আমি বললাম, ‘কি ব্যাপার তুমি এই ব্যবসায় কবে নামলে’?
ছেলেটা বললো যে সে ব্যাংকের চাকরিটাও করছে, পাশাপাশি ফুডপান্ডার কাজটাও করছে। আমি খুব খুশি হলাম। সে আর একটি আয়ের পথ তৈরি করেছে।
একটু চিন্তা করে দেখেন তার ইনকামের কিন্তু একটা ফ্লো আছে। অফিস ছুটি হয় সন্ধ্যায়। ছুটির পর সে বেরিয়ে পড়ে ফুডপান্ডার সার্ভিস দেওয়ার জন্য । এই কাজটা সে করে রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত। নিঃসন্দেহে অনেক কষ্ট হয়। সারাদিনের ক্লান্তির পরে আবার সাইকেল চালানো, কাস্টমারকে সার্ভ করা, কিন্তু এই কষ্টটাকে সে বরণ করেছে। কি জন্য? বাড়তি ইনকামের জন্য। ওই ছেলেটা পারতো এত কষ্ট না করে ব্যাংক থেকে বাসায় এসে বাসায় শুয়ে থাকতে, ফ্যামিলিকে সময় দিতে কিন্তু সেটা না করে সে আরাম-আয়েশকে ত্যাগ করে আরেকটা শ্রমের পথ বেছে নিয়েছে কারণ তার আরেকটি বাড়তি ইনকামের পথ তৈরি করা দরকার।
আপনাকে আপনার কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে আসতে হবে, নিজের ভাগ্য গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। দেখবেন আল্লাহ আপনাকে আপনার যোগ্য জায়গায় পৌঁছাতে সহযোগিতা করছেন।
তার যোগ্যতার চেয়ে অধিকাংশ মানুষের যোগ্যতা কম নয়। বরং কারও কারও যোগ্যতা তার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু তারা আয়ের কোনো পথ পাচ্ছেন না, ইনকাম বাড়ানোর কোনো বুদ্ধি করতে পারছেন না। কেন, এখানে বাধা কোথায়? কারণ আপনি নিজেই হচ্ছেন নিজের বাধা। নিজে কেন বাধা কারণ আপনি চাচ্ছেন কিন্তু চাওয়াকে পাওয়ায় পরিণত করতে যে কাজ করা দরকার সেটা করছেন না, তাই পারছেন না।
তবে অনেকেই আছেন যারা আসলেই চাচ্ছেন কিন্তু পারছেন না। আপনার যে আয় হচ্ছে, মাসে যে টাকাটা আসছে, সেই টাকা যাকে আমরা ক্যাশ ফ্লো বলি সেই টাকা বাড়ানোর কথা বলছি। মানে ক্যাশ আপনার কাছে আসতে হবে। আপনি বেতন পাচ্ছেন সেই ক্যাশ আসছে আপনার কাছে, যদি কোথাও ইনভেসমেন্ট থেকে থাকে সেখান থেকে ক্যাশ আসছে, আপনি যদি কারও কাছ থেকে টাকা পেয়ে থাকেন যদিও সেটা আর্নিং না সেটাও আপনার কাছে আসছে, সেটাতেও আপনার ইনফ্লো বেড়ে যাচ্ছে। আপনি কোথাও টাকা খাটিয়েছেন, প্রফিট পাচ্ছেন, ভাড়া পাচ্ছেন ব্যাংকে টাকা রেখেছেন সুদ আসছে, শেয়ার থেকে ডিভিডেন্ট আসছে। যে টাকা আপনার অ্যাকাউন্টে ঢুকছে সেটা আপনার ইনফ্লো। ইনফ্লো যত বেশি তত আপনার জন্য ভালো।
কিন্তু ধরুন আপনার ইনফ্লো বেশি আবার আউটফ্লোও বেশি। তাহলে তো হলো না। আপনি এক লাখ টাকা আয় করলেন বিভিন্ন খাত থেকে, আবার এক লাখ টাকা আপনার পকেট থেকে বেরিয়ে গেলো । তাহলে আপনার সেভিংস কিন্তু শূন্য। আপনার যে টাকাটা ইনফ্লো হচ্ছে তার থেকে কম আউট ফ্লো হতে হবে। আবার একটা বিষয় হতে পারে যে আপনার ইনফ্লো আছে ধরুন এক লাখ টাকা আপনার আউট ফ্লোর ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু যদি এই আউট ফ্লোকে কমিয়ে ৮০ হাজার টাকায় আনতে পারেন তাহলে দেখবেন ২০ হাজার টাকা আপনার সঞ্চয় হচ্ছে।
এখন যারা চাকরি করছেন বা ছোট একটা ব্যবসা করছেন বা কনসালটেন্সি করছেন বা কোনোভাবে নিজের জীবন নির্বাহ করছেন তারা ইনকাম কে কীভাবে বাড়াবেন। আমি একটু আগে যেই ছেলেটির কথা বলেছি সে চাকরির পাশাপাশি আরেকটি কাজ করছে। আপনি প্রথমত যে কাজটি করবেন আপনার ইনভেন্টরি করবেন।
আপনি আপনার সাথে বসবেন। বসে দেখবেন যে আপনি যে টাকা ইনকাম করছেন সেখান থেকে আর ইনকাম বাড়ানো যায় কি না। যারা গার্মেন্টসে চাকরি করছেন, অনেকে বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিকের কাজ করছেন তাদের ওভারটাইম করার সুযোগ আছে। যারা রিকশা চালাচ্ছেন, যারা ট্যাক্সি চালাচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে আরও একটু বেশি সময় দেওয়ার সুযোগ আছে। করবেন কি করবেন না সেটা আপনাদের ব্যাপার।
অধিকাংশ চাকরিজীবীর ওভারটাইম করার সুযোগ নেই। কিন্তু তাদের একটা সুযোগ আছে। নিজের দক্ষতা উন্নয়ন করে বেতন বাড়ানোর চেষ্টা করার সুযোগ আছে। তারপরে যদি নিজেকে আরেকটু উন্নত করে প্রমোশনটা নিয়ে নেওয়া যায় তাহলে সে সাথে আপনার বেতন বাড়ানোর সুযোগ আছে। আপনার নিজের অবস্থান ও যোগ্যতার বিষয় চিন্তা করে বুঝে নিতে হবে যে আপনার আর কোথা থেকে টাকা বাড়ানোর সুযোগ আছে। যখনই আপনি চিন্তা করবেন তখনই দেখবেন যে কোনো না কোনো পথ বের হয়ে এসেছে।
ধরুন কেউ একজন গাড়ি কিনবে, হয়তো সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনবে সেখানে আপনি সহায়তা করতে পারেন। আপনি তাকে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি অ্যারেঞ্জ করে দিতে পারেন। তার থেকে আপনি একটা কমিশন আয় করতে পারেন। বা কেউ একজন অ্যাপার্টমেন্ট কিনবে সেখানে আপনি কিনে দিতে সহায়তা করতে পারেন সেখান থেকে আপনি এক বা দুই পার্সেন্ট কমিশন পেতে পারেন। আমি আপনাদের এক একটা পথ বলছি আপনি আপনার মতো চেষ্টা করবেন কীভাবে কি করা যায়। কিন্তু চিন্তার দরজা বন্ধ করা যাবে না। চিন্তা করতে হবে যে কীভাবে কি করা যায়।
যেমন ধরুন আউটসোর্সিং অনেক দুর্দান্ত একটি পেশা। অনেক প্রতিষ্ঠান দেশে-বিদেশে আউটসোর্সিং করে। আপনি আউটসোর্স করতে পারেন। আপনি অন্যের কাজ করে দিয়ে ইনকাম করতে পারেন। আপনি হয়তো চিন্তা করবেন যে আপনার দক্ষতা নেই কিন্তু দক্ষতা অর্জন করার তো সুযোগ আছে।
সুতরাং আপনি ইউটিউব ঘাঁটেন, ফেসবুক ঘাঁটেন, গুগল করেন, ট্রাই টু ফাইন্ড আ ওয়ে আউট। আপনি দেখবেন কোনো না কোনো পথ ঠিকই রয়েছে। কিন্তু সেই পথ দিয়ে আপনার ভ্রমণ করা হয়নি সেই পথ দিয়ে আপনার হাঁটা হয়নি কখনো। এখন আপনি চিন্তা করুন যে আপনি ইনকাম বাড়াবেন, আপনি একটা ইনকামের ওপরে নির্ভর করবেন না।
বিশ্বাস করুন, যখন আপনি চিন্তা করবেন তখন একটা না একটা পথ সামনে চলে আসবে। কিন্তু খবরদার সবসময় আপনি তথাকথিত সম্মানের কথা চিন্তা করতে যাবেন না। আপনি চুরি করবেন না কিন্তু পরিশ্রম করে কাজ করবেন। ধরুন আপনি ৬টা পর্যন্ত চাকরি করেন পরে ৬টা থেকে ১০টা তো আপনি উবারের গাড়ি চালাতে পারেন। মোটরসাইকেল চালাতে পারেন এখানে তো কোনো বাধা নেই। আপনি যে কোনো কাজ করতে পারেন চুরি ছাড়া, যেখানে আপনার ইনকাম জড়িত। আপনি লিখতে পারেন, বই পাবলিশ করতে পারেন, আপনি বক্তৃতা দিতে পারেন, আপনি অন্যের সমস্যা সমাধান করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনার অন্যের পেইন পয়েন্ট কোনগুলো, যন্ত্রণার দিক কোনগুলো সেগুলো খুঁজে বের করে তাদের সহায়তা করতে পারেন।
কথায় বলে যে আপনার যদি চেষ্টা থাকে কোনো বাধাই বাধা নয়। কিন্তু আপনার চেষ্টাটা খুব জরুরি। আপনার ডিসিশনটা জরুরি যে আপনি আসলে কি করবেন। যখনই আপনি ডিসিশন নেবেন যে আপনি কিছু করবেন তখন দেখবেন চারপাশে সুযোগ । আর যখন দেখবেন যে আপনি কিছুই করবেন না তখন চারপাশে কোনো সুযোগ নেই।
তবে একটা জিনিস মাথায় রাখবেন যে ইনকাম বাড়লেই খরচ বাড়িয়ে দেবেন না। যেমন ধরুন আপনি একজনের কাছে এক লাখ টাকা পান ১ লাখ টাকা না পাওয়া পর্যন্ত আপনি কষ্ট করে চলছেন কিন্তু যখনই দেখবেন যে এক লাখ টাকা আপনার হাতে চলে এসেছে, আপনি পানির মতো খরচ করে ফেলবেন। এই কাজটি করবেন না আপনি মনে মনে ভাববেন যে এই টাকাটা পাননি। আপনার কোনো কিছু ইনভেস্ট করার জন্য, সঞ্চয় করার জন্য সেক্রিফাইস করতে হবে। বর্তমানের আরাম আয়েশ আপনার ত্যাগ করতে হবে। সত্যি কথা বলতে পৃথিবীতে কেউই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়নি স্যাক্রিফাইস ছাড়া।
পৃথিবীতে সবাই এক পথে দৌড়াচ্ছে, টাকার পেছনে দৌড়াচ্ছে। আপনারও যদি টাকা প্রয়োজন হয় আপনার কি পরিশ্রম করতে হবে না? আপনার হয়ে কি অন্য কেউ পরিশ্রম করে দেবে? এর সাথে আপনার আর্থিক জ্ঞান এবং পার্সোনাল ফাইন্যান্স লিটারেসি অর্জন করতে হবে। আমি অনেকের সাথে কথা বলে দেখেছি যে তারা আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি না বোঝার জন্য অনেক ভুল ডিসিশন নিয়েছে। আপনার সেই ভুলটা করা যাবে না।
একদিক থেকে টাকা আসবে আরেক দিক দিয়ে বের হয়ে যাবে এটা হতে দেওয়া যাবে না। আপনার যে দিক দিয়ে টাকা বের হয়ে যাবে সেদিকে আপনার বাঁধ দিতে হবে, খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে দেখবেন আপনার ইনকাম সোর্স বাড়ছে। যে টাকা ইনকাম করছেন সে টাকা থাকছে সেটা আপনি সঞ্চয় করতে করতে ইনভেস্টমেন্টে রূপান্তর করছেন।
এখানে একটা কথা বলা দরকার, যখন আপনার বাড়তি ইনকাম হচ্ছে প্রথম যেটা করবেন সেটা হচ্ছে আপনার লোনগুলো পরিশোধ করবেন। ফলে পরে আপনার টাকার আউটফ্লো কমে আসবে। আপনার কাছে টাকা জমবে। আপনার কাছে যে টাকা আসছে সেটার প্রোপার ব্যবস্থাপনা আপনাকে করতে হবে। আপনার কাছে যে টাকা আসছে সেটা আপনাকে ফিন্যান্সিয়াল ফ্রিডম পেতে সহায়তা করবে। আমার বিশ্বাস, আপনি যদি আজ থেকে লেগে যান তাহলে দেখবেন যে আপনার চারপাশে অনেক সুযোগ আছে আপনার আয় বাড়ানোর।
শুধু আপনাকে ডিটারমাইন্ড হতে হবে,পরিশ্রমী হতে হবে, আপনাকে ক্রিয়েটিভ হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আপনি আয় বাড়াবেন। নিজের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করুন, আপনি এখন আমাকে একটা কমিটমেন্ট করুন যে ইনকাম বাড়াবেন দেখবেন এক মাসের মধ্যে আপনার সাথে ম্যাজিক ঘটবে। তবে সেই ম্যাজিকের জন্য আপনাকে প্রতি মুহূর্তে সুযোগ খুঁজতে হবে, নিজেকে আপডেট করতে হবে, নিজের চোখ কান খোলা রাখতে হবে এবং দারুণ ডিটারমাইন্ড হয়ে কাজ করে যেতে হবে।
আপনাকে আপনার কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে আসতে হবে, নিজের ভাগ্য গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। দেখেবেন আল্লাহ আপনাকে আপনার যোগ্য জায়গায় পৌঁছাতে সহযোগিতা করছেন। ভালো থাকুন।
লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।